এন্টারটেইনমেন্ট ডেস্ক : ১৯৯৬ সালের ঘটনা। লোকে ঠাসবুনট রাজমণি-রাজিয়ার আঙ্গিনা। হলে সিট মাত্র ১২০০টি। কিন্তু গেটের বাইরে অবস্থান করছেন হাজার দশেক লোক। সবারই একটাই লক্ষ্য, ‘কাজের মেয়ে’ চলচ্চিত্রটি দেখা। বেসামাল পরিস্থিতি সামাল দিতে দিতেই মূল ফটক ভেঙে ফেলে দর্শকরা। ‘সেদিন অনেক কষ্টে আমরা দর্শক সামাল দিই। এমন ভিড় এরপর আরও কয়েকবার হয়েছে। অথচ চলতি বছরে এসে সেই হলেরই করুণ দশা দেখেছি। এমনও হয়েছে, হলে একটি টিকিটও বিক্রি হয়নি। তারপরও সিনেমা চালিয়েছি। বেশ কয়েকবার আমাদের এটা দেখতে হয়েছে। আমার জীবনের সবচেয়ে করুণ দৃশ্যগুলোর একটি হলো এটা।’ যখন কথাগুলো বলছেন, গলাটা যেন ভারী হয়ে এলো মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর। ১৯৮২ সালের ৩ মার্চ রাজধানীর কাকরাইল এলাকায় ২৪ কাঠা জমির ওপর ‘রাজমণি’ ও ‘রাজিয়া’ নামের প্রেক্ষাগৃহ দুটি নির্মাণ করেন মুক্তিযোদ্ধা আহসানউল্লাহ। গত কয়েক বছর ধরে প্রেক্ষাগৃহ দুটির দেখভালের দায়িত্বে আছেন তারই ভাতিজা শহীদুল্লাহ। সিনেমা হলের শেষ দিনগুলো তাকেই দেখতে হয়েছে বেশি। এরমধ্যে শুরু হয়েছে হলটি ভাঙার কাজ। এখানেই নির্মিত হবে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন। নিজেকে সামলে নিয়ে শহীদুল্লাহ বলেন, ‘৯৬ সালে হলের গেট ভেঙে ফেললেও সেটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের ঘটনা। কষ্টের ঘটনাও আছে। হলে এমন কর্মচারী আছেন যারা তাদের যৌবনটা ব্যয় করেছেন এর পেছনে। ৩০-৩৫ বছর ধরে তারা কাজ করে চলেছেন। আর কোনও কাজ তারা করতে পারেন না। গত শুক্রবার যখন শেষ শোটা (‘নোলক’ ছবির) হলো তারা হাউমাউ করে কেঁদেছেন। খুব কষ্ট হয়েছে।’
স্বাধীনতার আগে ঢাকাই ছবির ব্যবসা মূলত ছিল ইসলামপুর, ওয়াইজঘাট ও নবাবপুরকে ঘিরে। একটা সময় এটা চলে আসে গুলিস্তানে। এরপর এটা কাকরাইলে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর পেছনেও আছে রাজমণি-রাজিয়া প্রেক্ষাগৃহের অবদান। দোতলা-তিনতলায় ৩৫টির মতো অফিস দেওয়া হয় প্রযোজকদের। বাঘা বাঘা সব প্রযোজক এখানে এসে বসতেন। অফিস ছিল অভিনেত্রী-প্রযোজক সুচন্দা, ববিতা ও চম্পাদেরও। দোতলায় বসতেন ববিতা। ইলিয়াস কাঞ্চনও বসতেন। রাজমণি হলের উদ্যোক্তা চলচ্চিত্র নির্মাতা আহসান উল্লাহ মণি সরাসরি সব দেখভাল করতেন। স্ত্রী রাজিয়া এবং নিজের নামের অংশ যুক্ত করে ‘রাজমণি’ হলের নামকরণ করেছিলেন। পরে রাজিয়া নামে আরেকটি ছোট প্রেক্ষাগৃহ চালু করেন সেখানে। পরবর্তী সময়ে হলের নামের সঙ্গে মিলিয়ে হোটেল রাজমণি ঈশা খাঁ এবং নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে রাজমণি ফিল্ম সিটি প্রতিষ্ঠা করেন আহসান উল্লাহ। সেখানে ‘রাজমণি পিরামিড’ ও ‘তাজমহল’ নামে দুটি দর্শনীয় স্থাপনাও নির্মাণ করেছেন তিনি।
আহসান উল্লাহ মণির মতে, রাজমণি শুধু একটি সিনেমা হল নয়, একটি ছোটখাটো চলচ্চিত্র নগরীর ভাবনাই সেখানে ফুটে উঠেছিল। ভবনের ভেতরে কিংবদন্তি সত্য সাহার গানের রেকর্ডিং স্টুডিও, চিত্র ধারণের স্থান (শুটিং স্পট), ডাবিং স্টুডিও, এডিট প্যানেল থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র নির্মাণের নানান কারিগরি প্রতিষ্ঠানও ছিল। বলা যায়, সিনেপাড়ার অনেক সফলতার বুনন হতো এই রাজমণি ভবনেই।
বাংলা চলচ্চিত্রে চলমান মন্দাবস্থায় দিনের পর দিন লোকসান গুনে গত শুক্রবার (১১ অক্টোবর) বন্ধ হয়ে গেল রাজমণি। শুরুতে ৭০ জন কর্মী নিয়ে রাজমণি প্রেক্ষাগৃহ চালু হলেও শেষ অবধি ‘রাজমণি’ ও ‘রাজিয়া’ মিলে কর্মী সংখ্যা ছিল ৩৫। বলা যায়, হল বন্ধ হওয়ার পর এই মানুষগুলোর সংসার আর স্বপ্নের এক প্রকার ইতি ঘটলো। তবে প্রেক্ষাগৃহ কর্তৃপক্ষ জানাল, চেষ্টা করা হচ্ছে সব কর্মীকে কোনও না কোনোভাবে নতুন ভবনে যুক্ত করার। ৩৬ বছরের বড় একটি পরিবারের এভাবেই ইতি টানতে চায় না এর কর্তৃপক্ষ। জানা গেছে, নতুন বাণিজ্যিক ভবনে কোনও হল বা সিনেপ্লেক্স করার পরিকল্পনা নেই কর্তৃপক্ষের। তবে আহসান উল্লাহ মণি শিগগিরই অন্য কোথাও আরেকটি সিনেমা হল করার পরিকল্পনা করছেন।
দর্শকের চাপে একসময় রাজমণির গেট ভেঙে গিয়েছিল!
বিনোদন
0 Views