ইকোনোমিক ডেস্ক: গুজব ও আতঙ্কে আবার বড় দরপতন হয়েছে শেয়ারবাজারে। সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসের পতন বড় আকার ধারণ করল দ্বিতীয় দিনে। গতকাল সোমবার প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচক কমেছে ১২০ পয়েন্ট। অন্য শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) কমেছে ৪২৬ পয়েন্ট, যা গত ছয় মাস ২১ দিনের মধ্যে উভয় পুঁজিবাজারে সূচকের সর্বোচ্চ পতন। গতকালের দরপতনে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সব খাতের শেয়ারের দাম কমেছে। আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে লেনদেন ও বাজার মূলধন।
দাম আরো কমবে—এ আতঙ্কে বিনিয়োগকারীরা গণহারে শেয়ার বিক্রি করেছেন বলে মনে করেন বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, বড় বিনিয়োগকারীদের দেখাদেখি সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করায় বড় দরপতন হয়েছে। বড় দরপতনের প্রতিবাদে গতকাল মতিঝিলে ডিএসই ভবনের সামনে মানববন্ধন করেছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, কয়েক দিন ধরে পুঁজিবাজারে দরপতন চলছেই। রবিবার সূচক ৭০ পয়েন্ট হ্রাস পেয়েছিল। ১০ কর্মদিবসের মধ্যে ৯ দিনের পতনে প্রায় ৫০০ পয়েন্ট সূচক হারিয়েছে ডিএসই। ভালো-খারাপ সব কম্পানির শেয়ার এখন দুলছে। এই দোলায় দর হারানোর হার ভাবিয়ে তুলছে বিনিয়োগকারীদের।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা আগে শেয়ার কিনে এখন লাভ তুলে নিতে একসঙ্গে বিক্রি করছেন হয়তো।
এমন প্রবণতা হলে দরপতন হবেই। পুঁজিবাজারে বারবার বড় দরপতন হচ্ছে। বিএসইসির খতিয়ে দেখা উচিত কোনো রকম কারসাজি হচ্ছে কি না। কোন কোন শেয়ারের দাম বেশি পড়ছে সেটা দেখতে হবে। এর পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র কিংবা কারসাজি আছে কি না, তা নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দেখতে হবে। ভালো শেয়ারের দাম যদি বেশি পড়ে যায় সেটি কাঙ্ক্ষিত নয়।’
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের হাতে ভালো শেয়ার যদি থেকে থাকে তাহলে সেগুলো দরপতনের সময় বিক্রি না করে ধরে রাখা উচিত। তাহলে ভবিষ্যতে তাঁরা লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হবেন না। এরপর যখন ভালো দাম পাবেন, তখন বিক্রি করতে পারেন। বিনিয়োগ করার সময় বাছবিচার করে বিনিয়োগ করতে হবে। হুজুগে মেতে মন্দ শেয়ারে বিনিয়োগ করা যাবে না।’
আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টসের এমডি মো. মনিরুজ্জামান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এক বছর ধরে শেয়ারবাজারের মূল্যসূচক প্রায় তিন হাজার পয়েন্ট বেড়েছে। এর মধ্যে ভালো শেয়ারের দাম যেমন বেড়েছে, তেমনি খারাপ শেয়ারের দাম বেশি বেড়েছে। কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই এসব শেয়ারের দাম বেড়ে গিয়েছিল। তাই এসব কম্পানির দাম কমার প্রবণতা বেশি দেখা গেছে। দুর্বল মৌল ভিত্তির এমন জাংক শেয়ার দরপতন ত্বরান্বিত করেছে। এসব শেয়ারের দরপতন ভালো কম্পানির শেয়ারের পতন ত্বরান্বিত করেছে।’
মনিরুজ্জামান বলেন, এক শ্রেণির বিনিয়োগকারী হয়তো মনে করছেন যেন ভূমিকম্প লেগেছে, ভেতর থেকে বের হতে হবে। মূলত এমন ‘প্যানিক সেলের’ কারণে সূচকের পতন হচ্ছে। তাই ঝুঁকিপূর্ণ ‘জেড’ ক্যাটাগরির শেয়ারে বিনিয়োগ না করে যেসব কম্পানির আয় ভালো, যারা ধারাবাহিকভাবে মুনাফার প্রবৃদ্ধি ঘটিয়ে ভালো লভ্যাংশ দিচ্ছে—এমন কম্পানিতে বিনিয়োগ করার পরামর্শ দেন তিনি।
এদিকে ডিএসইর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সূচকের বড় পতনে ৪৪ শতাংশ দায় বড় মূলধনী চার কম্পানির। এই চার কম্পানির মধ্যে রয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, বেক্সিমকো লিমিটেড, ওয়ালটন হাইটেক ও সামিট পাওয়ার লিমিটেড।
সূত্র জানায়, গতকাল ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি সূচকের পতন ঘটিয়েছে। ডিএসইর সূচক পতনের ক্ষেত্রে কম্পানিটির দায় ছিল ১৯.৫০ পয়েন্ট। অর্থাৎ কম্পানিটির শেয়ারদর কমেছে ৩.৩৯ শতাংশ, যে কারণে ডিএসইর সূচক কমেছে ১৯.৫০ পয়েন্ট। সর্বশেষ কম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৬৮৮ টাকা ৭০ পয়সায়। আগের দিন ছিল ৭১২ টাকা ৯০ পয়সা। ডিএসইর সূচক পতনের পেছনে ছিল ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডও। কম্পানিটির শেয়ারদর কমেছে ১.৪০ শতাংশ। এতে ডিএসইর সূচক কমেছে ৭.৬৯ পয়েন্ট। এ ছাড়া সামিট পাওয়ার লিমিটেডের শেয়ারদর কমেছে ৯.৩১ শতাংশ। এতে ডিএসইর সূচক কমেছে ৬.৮৫ পয়েন্ট।
গতকালের বাজার : ডিএসই প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ১২০ পয়েন্ট বা ১ শতাংশ কমে ৭ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে গেছে। গতকাল ডিএসইতে এক হাজার ৪৭০ কোটি ৪৩ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে, যা আগের দিন থেকে ৬১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা কম। রবিবার লেনদেন হয়েছিল এক হাজার ৪৭১ কোটি চার লাখ টাকার। ডিএসই প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ১২০ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৬ হাজার ৮৮৫ পয়েন্টে। অন্য দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই৩০ সূচক ৫৩ পয়েন্ট এবং ডিএসইএস বা শরিয়াহ সূচক ২২ পয়েন্ট কমেছে। গতকাল ডিএসইতে মোট ৩৭৬টি কম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দর বেড়েছে ৪৭টির, কমেছে ৩০৭টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ২২টি কম্পানির শেয়ারের দর। সিএসইতেও সূচকের পতনে লেনদেন শেষ হয়েছে। সিএসই সার্বিক সূচক ৪২৬ পয়েন্ট কমে ২০ হাজার ১৪৪ পয়েন্টে অবস্থান করছে। লেনদেন হয়েছে ৬০ কোটি ৫৩ লাখ টাকার শেয়ার।
ডিএসইতে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে ডেল্টা লাইফের শেয়ারের। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বেক্সিমকো লিমিটেড। তৃতীয় স্থানে ছিল ফরচুন শুজ। এরপর যথাক্রমে ছিল ওরিয়ন ফার্মাসিউটিক্যালস, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, স্কয়ার ফার্মা, জেনেক্স ইনফোসিস, আইএফআইসি ব্যাংক, লাফার্জহোলসিম এবং এনআরবিবিসি ব্যাংক লিমিটেড।
আবারও পথে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা : গতকালের বড় দরপতনের প্রতিবাদে গতকাল মতিঝিলে ডিএসই ভবনের সামনে মানববন্ধন করেছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। দ্রুত সময়ে দরপতন থেকে পুঁজিবাজারকে ফেরানোর জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান তাঁরা। একই সঙ্গে গত ১০ অক্টোবর থেকে চলা এ দরপতনের পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান উপস্থিত বিনিয়োগকারীরা।
বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধরতে বললেন বিএসইসির কমিশনার : টানা সাত কর্মদিবস দরপতনের পর বিএসইসির কার্যালয়ে পুঁজিবাজারের বিভিন্ন অংশীজনের মধ্যে বৈঠক বসে। ওই বৈঠকে নানা বিষয়ে আলোচনার মধ্যে বাজারে তারল্যপ্রবাহ বাড়ানোর পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়া নানা গুজবের বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। সে সময় পুঁজিবাজারে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন। আরো জানানো হয়, একটি ব্রোকারেজ হাউসের সেল প্রেসারের কারণে বাজারে সেদিন বড় দরপতন হয়েছিল। নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়, এখন নজরদারি অনেক শক্তিশালী। বাজারে কারসাজি করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
বিএসইসি কমিশনার অধ্যাপক ড. শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, দিনের পর দিন যখন মার্কেট বেড়েছে, তখন তো কোনো কথা হয়নি। বাজার যখন কয়েক দিন সংশোধন হচ্ছে, তখন ভয় বেড়ে যায়। আবার যখন প্রতিনিয়ত বাজার বাড়ে তখন ভয় কমে যায়। এটা স্বাভাবিক, এমনটা হতেই পারে। এ জন্য বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। এই দরপতন স্থায়ী নয়, বাজার আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।
পুঁজিবাজারে গুজব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা গুজব নিয়ন্ত্রণে আমরা একটি মনিটরিং সেল গঠন করছি। আর কিছু দায়িত্বে অবহেলা থাকে, সেই দায়িত্বে অবহেলা চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধান করতে সময় লাগে। আমরা দেখছি দায়িত্বে অবহেলাগুলো কী এবং সেটার সমাধান হচ্ছে।’