ইসলাম ও ধর্ম ডেস্ক: আল-কোরআনে ‘রিবা’ শব্দের সমার্থক হলো ‘সুদ’ বা ‘ইন্টারেস্ট’ (interest। প্রচলিত অর্থে সুদ বলতে বোঝায়, নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধার দিয়ে চুক্তির শর্ত মোতাবেক আসলের ওপর নির্দিষ্ট পরিমাণ অতিরিক্ত গ্রহণ করা। কিন্তু রিবা শুধু ঋণের ক্ষেত্রে আসলের অতিরিক্ত গ্রহণ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর পরিধি ও পরিসর আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত। কেননা ঋণের বাইরেও এমন কিছু কেনাবেচা ও লেনদেন আছে, যার সঙ্গে সুদের সম্পর্ক আছে। রিবা, সুদ বা ইন্টারেস্ট—যে নামেই বলি না কেন, ইসলামে এগুলোকে নিষিদ্ধ বা হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু ইসলাম সুদ নিষিদ্ধ করেনি, দুনিয়ার প্রধানতম ধর্মগুলো, এমনকি বিভিন্ন মতবাদেও সুদ নিষিদ্ধ।
আল-কোরআনে সুদ : আল-কোরআনের চারটি সুরার মোট ১২টি আয়াতে সুদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সুরা রুমের ৩৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আর মানুষের ধন-সম্পদের মধ্যে বৃদ্ধি পাবে বলে তোমরা সুদের ভিত্তিতে যা প্রদান করে থাকো, তা আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায় না। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যে জাকাত (দান-সদকা) তোমরা দিয়ে থাক (তা-ই বৃদ্ধি পায়) এবং তারাই সমৃদ্ধিশালী।’
সুরা আলে-ইমরানের ১৩০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা দ্বিগুণ-বহু গুণে সুদ খেয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো। তোমরা সে আগুনকে ভয় করো, যা কাফিরদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। আর তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর ও রাসুলের, যাতে তোমরা দয়াপ্রাপ্ত হতে পারো।’
সুরা বাকারার ২৭৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যারা সুদ খায় তারা (কিয়ামতের দিন) ওই ব্যক্তির দাঁড়ানোর মতো দাঁড়াবে যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে দেয়। এটি এ কারণে যে তারা বলে কেনাবেচা তো সুদের মতোই; অথচ আল্লাহ কেনাবেচাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।’
সুরা বাকারার ২৭৮ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে তা ছেড়ে দাও—যদি তোমরা মুমিন হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না করো, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে (তোমাদের বিরুদ্ধে) যুদ্ধের ঘোষণা জেনে নাও, আর যদি তোমরা তাওবা করো, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদের জন্য, তোমরা জুলুম করবে না এবং তোমাদের প্রতিও জুলুম করা হবে না এবং যদি সে (ঋণগ্রহীতা) অসচ্ছল হয় তাহলে সচ্ছলতা পর্যন্ত তাকে অবকাশ দাও। আর সদকা করে দেওয়া তোমাদের জন্য উত্তম—যদি তোমরা জানতে। আর তোমরা সেই দিনকে ভয় করো, যেদিন তোমাদের আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে, এরপর প্রত্যেক ব্যক্তিকে সে যা অর্জন করেছে তা (তার প্রতিফল) পুরোপুরি দেওয়া হবে এবং তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।’
সুুন্নাহর দৃষ্টিতে রিবা বা সুদ : জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, সুদগ্রহীতা, সুদদাতা, সুদের লেখক (চুক্তি সম্পাদনকারী) ও সুদের সাক্ষীদ্বয় সবার ওপর অভিসম্পাত করেছেন এবং বলেছেন, তারা সবাই সমান অপরাধী।’
আবদুল্লাহ ইবনে হানজালা (রা.) থেকে বর্ণিত মহানবী (সা.) বলেন, ‘জেনে-বুঝে সুদের এক দিরহাম গ্রহণ করা ৩৬ বার ব্যভিচার করার চেয়েও নিকৃষ্ট অপরাধ।’
রাসুল (সা.) অন্য এক হাদিসে বলেছেন, ‘আল্লাহ তাঁর অধিকার হিসেবে চার শ্রেণির ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন না এবং তার নিয়ামতের স্বাদও আস্বাদন করাবেন না। তারা হলো : ১. শরাব বা মদ্যপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি, ২. সুদখোর ব্যক্তি ৩. ইয়াতিমের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণকারী ৪. পিতামাতার অবাধ্য ব্যক্তি।’
বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদে সুদ : কোরআন-সুন্নাহর বাইরে বিভিন্ন ধর্মেও সুদ নিষিদ্ধ ছিল। তাওরাত, ইনজিল, বেদ প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থ, বিভিন্ন মতবাদ বা দর্শনে সুদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ এক্সডোসে এর ২২ স্তবকে বলা হয়ছে : ‘তোমরা যদি আমার কোনো লোককে অর্থ ধার দাও যারা গরিব, তবে তোমরা তার মহাজন হবে না এবং তার কাছ থেকে সুদ আদায় করবে না।’
খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ ‘ডিউটারোনোমির’ ২৩ স্তবকে বলা হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের ভাইকে সুদে ধার দেবে না, অর্থের ওপর সুদ, খাদ্যসামগ্রীর ওপর সুদ এবং যেকোনো জিনিস যা ধার দেওয়া যায়, তার ওপর সুদ।’
হিন্দু ধর্মের বেদে বলা হয়েছে, ‘সুদখোরের বাড়িতে যেয়ো না।’
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তাঁর ‘লজ’ নামক গ্রন্থে সুদের নিন্দা করেছেন। তিনি সুদকে মানবতাবিরোধী, অন্যায় ও জুলুম এবং কৃত্রিম ব্যবসা বলে তীব্রভাবে এর বিরোধিতা করেছেন। বিখ্যাত দার্শনিক অ্যারিস্টোটলও কঠোর ভাষায় সুদের নিন্দা করেছেন। তিনি অর্থকে বন্ধ্যা মুরগির সঙ্গে তুলনা করেছেন, যা ডিম দিতে পারে না। তিনি আরো বলেছেন, ‘অর্থ কোনো অর্থ সৃষ্টি করতে পারে না।’ অ্যারিস্টোটল আরো বলেন, ‘অন্যান্য পণ্যের মতো অর্থ কেনাবেচা করা একটি কৃত্রিম ও জালিয়াতি ব্যবসা।’
সুদের সমালোচনায় অর্থনীতিবিদরাও বাদ যাননি। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জে এম কিনস অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলার জন্য সুদের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা প্রমাণ করে তিনি বলেছেন, এভাবেই পুঁজিবাদী সমাজের অনেক দোষ-ত্রুটি দূর করা সম্ভব। সুদভিত্তিক বিনিয়োগের পরিবর্তে উৎপাদনমুখী উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তিনি আহ্বান জানিয়েছেন।’
সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির জনক কার্ল মার্কস সুদের ব্যবসায়ীকে ‘বিকট শয়তান’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। সুদখোরকে তিনি তুলনা করেছেন ডাকাত ও সিঁদেল চোরের সঙ্গে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সাবেক ডিএমডি ইসলামী ব্যাংক, কো-অর্ডিনেটর, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড।