মুক্তমঞ্চ ডেস্ক, আজনিউজ২৪: বাংলাদেশের একজন লিজেন্ড ফটোগ্রাফার। বঙ্গবন্ধুর অনেক পার্সোনাল ফটোগ্রাফীর কাজ করেছেন তিনি। ফটো সাংবাদিক হিসাবে দেশ বিদেশের বহু নামী দামী পত্রিকায় কাজ করেছেন। পাভেল ভাইর এত এত পরিচয় ও কৃতিত্ব রয়েছে যা এই ছোট পরিসরে আমার পক্ষে বলা সত্যিই কঠিন।
মানিক ভাইর (মাহমুদু্ল হাসান মানিক, পলিট ব্যুরো সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি) কল্যানে পাভেল ভাইর সাথে আমার গড়ে উঠেছে ব্যাক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্ক। তিনি এখন আমাদের প্রিয় পাভেল ভাই। এবার তিনি একুশে পদকে ভুষিত হয়েছেন। যোগ্য লোকের যোগ্য স্বীকৃতি। অভিনন্দন, পাভেল ভাই আপনাকে অভিনন্দন।
১৯৯১ সাল আমি তখন চট্টগ্রাম আর্ট কলেজের ছাত্র। কলেজের বাইরে ছাত্র রাজনীতি করি। আর্ট কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবেও দ্বায়িত্ব পালন করি। মূর্তজা বশির স্যার আমাদের কলেজের কয়েকজনকে ডেকে নিলেন চট্টগ্রামের আলিয়ন্স ফ্রঁসেজে একজন ফটোগ্রাফারের আলোকচিত্র প্রদর্শনী হবে, সেই প্রদর্শনীর কাজ করার জন্য। সৌভাগ্যক্রমে আমিও মূর্তজা বশির স্যারের সে টিমে যুক্ত হয়ে গেলাম। আমি ঐসময় আলিয়ঁন্স ফ্রঁসেজে ফ্রান্স ভাষা শিখছিলাম। তাই কাজটি আমার জন্য শাপে বর হয়ে গেল। রত দেখাও হলো, কলা বেঁচাও হলো। সারাদিন অডিটরিয়ামে কাজ করি সন্ধ্যায় ক্লাসে জয়েন করি।
মূর্তজা বশির স্যারের নির্দেশনায় খুব চমৎকার করে ছোট্ট অডিটরিয়ামটিকে প্রদর্শনীর উপযোগী করে সাঁজিয়ে তুললাম আমরা। নির্ধারীত দিনে ঝাঁকঝমক করে প্রদর্শনীর উদ্ভোধন হলো। উদ্বোধক বশির স্যার নিজেই। অনেক মানুষ অনেক অতিথি, আমাদের সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দরাও এসেছেন। উদ্বোধনী ঢামাডোলে কোনখান দিয়ে কি হলো টের পেলামনা। ভীরভাট্টা যখন একটু কমলো তখন হলের ভিতরে যাওয়ার সুযোগ হলো।
ভিতরে গিয়ে দেখি লম্বা চওড়া বিশালদেহী একজন লোক, গায়ে ফটোগ্রাফারের কটি পড়া, গলায় একখানা ক্যামেরা ঝোলানো, মূর্তজা বশির স্যারসহ উপস্থিত অতিথিদের নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন চিত্রের বর্ননা দিচ্ছেন। আমি ছোট মানুষ পিছনে পিছনে থাকি। কিছুক্ষন বাদেই স্যার আমদের সবাইকে ডাকলেন পরিচয় করিয়ে দিলেন সেই বিশাল দেহী ভদ্রলোকটির সাথে, বললেন ইনিই হলেন পাভেল রহমান, বিখ্যাত ফটোগ্রাফার পাভেল রহমান।
এই কয়দিন এখানে কাজ করলেও ওনার সাথে আমার একবারও সাক্ষাৎ ঘটেনি তখনও। পাভেল রহমান তাঁর বিশাল হাতখানা এগিয়ে দিয়ে করমর্দন করলেন আমাদের সাথে। প্রদর্শনীর কাজের সাথে যুক্ত থাকায় আমাদেরকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানালেন এবং ঘুরে ঘুরে আমাদেরকে তার বিভিন্ন চিত্রের বর্ননা শোনালেন গল্পের মতো করে। এক একটি চিত্র ধারন করার পূর্বাপর ইতিহাসগুলি এত সুন্দরভাবে বর্ননা করতে লাগলেন যা শুনে আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বর্ননা শুনে যেন মনে হচ্ছে ছবিটা এইমাত্র আমি নিজেই তুলে নিয়ে আসছি।
পুরো প্রদর্শনীর সব চিত্রগুলির মধ্যে ৩টা চিত্রের কথা এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে যা আমার মন ছুঁয়েছিল সবচেয়ে বেশী। তার মধ্যে একটি হলো সেই সময়ের উড়ির চরের প্রলয়ঙ্করী ঘুর্নি ঝড়ের একটি ছবি। ঝড়ের পর উড়ির চরের কোন একটি আশ্রয় কেন্দ্রে তোলা হয়েছিল সেই ছবিটি। একজন পুরুষ একজন মহিলা পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আছেন কোলাকুলির ভঙ্গিতে। মহিলাটির কোলে তার কোলের শিশু। এক হাত দিয়ে শিশুটিকে আক্রে ধরে আছেন আর আরেক হাতে পুরুষটির গলা জড়িয়ে ধরে শরীরের সাথে লেপ্টে আছেন। ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ঐ যুগলের প্রচন্ড আবেগ ও উচ্ছাস এবং ফিরে পাবার যে ব্যাকুলতা তা দুর থেকেও স্পষ্ট বোঝা যায়। ঐসময় আমাদের সমাজে প্রকাশ্যে উন্মুক্ত স্থানে নারী-পুরুষ পরস্পরকে আলিঙ্গনরত অবস্থায় দেখা ছিল রীতিমত ভয়ঙ্কর ব্যাপার। বিশেষ করে ওই রকম চরাঞ্চলে বসবাসরত নির্মবিত্ত পরিবারের পক্ষে তো প্রশ্নই আসেনা। ঝড়ের তান্ডবে হাজার হাজার মৃত মানুষের ভীরে হারিয়ে যাওয়া স্বামী স্ত্রী পরস্পর পরস্পরকে খুঁজে পেয়ে আবেগে ভালবাসায় শত শত মানুষের সামনে পরস্পরকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছিলেন যা দেখলে বুক ফেঁটে কান্না বের হয়ে আসে। পাভেল ভাই এক ক্লিকে সেই মূহুর্তটিকেই তার ক্যামেরা বন্দি করে নিয়েছিলেন। ছবিটি এত জীবন্ত যে তার সামনে দাড়িয়ে থাকা যায়না, রীতিমত কান্না চলে আসে।
২য় ছবিটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’পক্ষের প্রচন্ড গোলাগুলির একখানা চিত্র। কাঁদানে গ্যাসের ধোয়ায় আচ্ছন্ন পরিবেশের মধ্যে উন্মত্ত এক যুবক পিস্তল হাতে গুলি করতে করতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যুবকের মুখটুকু কালো কালি দিয়ে ঢাকা। আমি পাভেল ভাইকে প্রশ্ন করেছিলাম এই লোক তো সন্ত্রাসী তার মুখ ঢেকে দিয়েছেন কেন? মুখ ঢাকা না থাকলে তাকে তো পুলিশে ধরে ফেলতে পারতো! তিনি তখন বললেন আমি একজন সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দেবার জন্য এই ছবি তুলিনি, অসংখ্য সন্ত্রাসীর প্রতিচ্ছবি হিসাবে এ চিত্র ধারন করেছি।
সেই প্রদর্শনীর আরেকটি চিত্র নুর হোসেনের সেই ঐতিহাসিক বিখ্যাত ছবি। যেটির সাথে আমার জীবনের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাই যা আমাকে খুবই আপ্লুত করেছিল। কারন নুর হোসেন যেদিন গুলিবিদ্ধ হয়েছিল সেদিন আমিও পল্টনের মোড়ে মিছিলে ছিলাম। বুকে পিঠে স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক লেখা তরতাজা এক যুবককে চোখের সামনে দিয়ে ছুটে যেতে আমি নিজ চোখে দেখেছি। আমরা তখন মুক্তাঙ্গনের উল্টা দিকের ফুটপাত ঘেঁষে গুটি কয়েক গনতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়নের তরুন কর্মী মিছিলের পূর্ব প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ঠিক ওই সময় নুর হোসেন আমাদের পাশ ঘেঁষে জিরো পয়েন্টের দিকে ছুটে গেলেন। তাঁকে দেখে আমাদের ভিতরও চাপা উত্তেজনা শুরু হয়ে গেল।
কিছুক্ষন পরই শুরু হয়ে গেল মুহুর্মুহু গুলি ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ। আমরা এখান থেকে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না সামনে কি হচ্ছে। গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের কারনে আমাদের মিছিলটিও শেষপর্যন্ত আর হলোনা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। কাঁদানে গ্যাসের ঝাঁজে সেখানে টিকতে না পেরে আমরা পার্টি অফিসে এসে আশ্রয় নেই।
সেদিন আমি নুর হোসেনকে ঠিক যেভাবে ছুটে যেতে দেখেছি ঠিক সেভাবেই পাভেল ভাই ক্যামেরায় নুর হোসেনকে ধারন করে নিয়েছেন। আমার কাছে মনে হলো আমি সেই ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থেকেই নুর হোসেনকে দেখছি। ছবিটা আমাকে ভীষনভাবে নাড়া দিয়েছিল।
এরপর বহুকাল কেটে গেছে পাভেল ভাইর সাথে আর দেখা হয়নি। পত্রিকা খুললেই পাভেল ভাইর নানা রকম চিত্র পত্রিকার পাতায় দেখতে পেতাম।
২০১৪ সালের কোন এক রাতে মানিক ভাইর আমেরিকা যাওয়া উপলক্ষে বিমানবন্দরে গেলাম তাঁকে সী-অফ করতে। আমি এটিএন বাংলার এসিসটেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে তখন কাজ করি। বিমান বন্দরের গেট দিয়ে ঢুকে ভিতরে বোর্ডিং এরিয়ায় চলে গেলাম। ওখানে স্টীলের ফেন্সিং ধরে দাড়িয়ে আছি হঠাৎ করে একজন লোক ছুটে এসে সনির দামী একখানা ক্যামেরা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন “ভাই এই ক্যামেরাটা আমার বাসায় একটু কি দয়া করে পৌছে দিতে পারবেন? ইমিগ্রেশন অফিসার এই ক্যামেরাটি সাথে নিতে দিচ্ছেন না আমাকে”।
জানা নাই শোনা নাই একজন অপরিচিত লোক অত দামী একখানা ক্যামেরা হঠাৎ করে আমার হাতে ধরিয়ে দেয়ায় আমি রীতিমত ভড়কে গেলাম। আমি তোতলাতে শুরু করে দিলাম। তিনি আর কিছু বলছেন না আমার মুখের দিকে তাঁকিয়ে আছেন। মানিক ভাই পাশ থেকে উঠে এসে বললেন ইনিই পাভেল ভাই, ফটোগ্রাফার পাভেল ভাই।
পাভেল ভাই তৎক্ষনাৎ ছোঁ মেরে ক্যামেরাটা আমার হাত থেকে নিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। পাভেল ভাই যে প্রচন্ড রকম হাসতে পারেন এবং দুষ্টামী করতে পারেন সেটা সেদিন দেখলাম। তিনি আমাকে ভড়কে দেবার জন্যই যুক্তি করে সেদিন এরকম অভিনয়টি করেছিলেন। পরিবেশ শান্ত হলে আমি আলিয়ঁন্স ফ্রঁসেজের সেই চিত্র প্রদর্শনীর কথা বলতেই আবেগে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে।
জানুয়ারী মাসের ২ তারিখ প্রতিবছর দিনাজপুর শহর থেকে কান্তজীর মন্দির পযর্ন্ত ২২মাইল দীর্ঘ একটি ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় সেই প্রতিযোগিতার উদ্ভোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মেনন ভাই (রাশেদ খান মেনন)। তিনি তখন বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী। ট্রেনের সেলুন কারে চড়ে মেনন ভাইর সফরসঙ্গী হিসাবে গেলাম দিনাজপুর। একবারে ভিআইপি ব্যাপার স্যাপার। সেলুন কারে জীবনে চড়িনি এই প্রথম সেলুন কারে চড়ব তাই মনে মনে ছিলাম বেশ পুলকিত। সকাল বেলা আমরা গিয়ে পৌছলাম দিনাজপুর।
ভোরবেলায় প্রথমে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এরপর কান্তজীর মন্দির পরিদর্শনসহ নানা আয়োজন। দুপুরে রাম সাগরসহ আরো অনেকগুলি স্পট ঘুরলাম আমরা। মন্ত্রীর সফর সঙ্গী হিসাবে ভ্রমন, দৌড় আর দৌড়, না গেলে বোঝা যায়না। সব কিছুই করেতে হয় ঝটিকা বেগে।
রাতে গেলাম সৈয়দপুর, সেখান থেকে প্রোগ্রাম শেষ করে আবার সেই সেলুন কার। ঢাকায় ফেরৎ। ট্রেনের কামরায় উঠেই পেয়ে গেলাম পাভেল ভাইকে। এরপর সারারাত ধরে গল্প, জীবনের সব গল্প, ছবি তোলার গল্প। মনে হলো যেন সব রূপকথার গল্প। এক এক একটা ছবি তোলার পিছনের সে গল্প কখনো তা সু-মধুর আবার কখনো তা বেদনা বিধুর। ছবি তুলতে তুলতে কতবার যে তিনি মৃর্ত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন সেসব গল্প। এভাবে চলল গল্প, সারারাত ধরে সারাপথ ধরে, সেই সেলুন কারের মধ্যে। সেই গল্পে মেনন ভাইও ছিলেন, তিনিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছিলেন সেসব গল্প ।
গল্পের ফাঁকে ফাঁকে আমার ক্যামেরা দিয়ে পাভেল ভাইর সেদিন অনেক ছবি তুলেছিলাম। কিন্ত দুর্ভাগ্য আমার কোনটাই ভাল হয়নি সেসব ছবি। একটা ছবিই মাত্র ভাল হয়েছিল মোটামুটি যেটা আজ কাভার ছবি হিসাবে দেখা যায়।
ফটোগ্রাফারের উপড় ফটোগ্রাফী ক্যামেরাও যেন ভয় পায় !!
লাল সালাম পাভেল ভাই অভিনন্দন আপনাকে, আপনার মঙ্ল কামনায়……
-জসিম উদ্দিন-
সিইও, জেরিকো।
সাবেক এসিসটেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট (ডিজাইন)
এটিএন বাংলা।
“পাভেল রহমান” বঙ্গবন্ধুর অনেক পার্সোনাল ফটোগ্রাফার
আজনিউজ২৪ :
0 Views