উপ-সম্পাদকীয় ডেস্ক, আজনিউজ২৪: ২৫শে নভেম্বর থেকে ১০ই ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস এ প্রসংগ নিয়ে বাণরের মালা গাঁথার ন্যায় কিছু কথা-সকল মানব সন্তান জন্মসূত্রে স্বাধীন ও সমমর্যাদার অধিকারী এবং এই অধিকার অবিভাজ্য। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের ১৯৪৮ সালের এই ঘোষণার পরও নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পথ দূর্গম, দুস্তর ও কন্টকাকীর্ণ। নারীর আত্মমর্যাদাপূর্ণ, সম্মানজনক কাজের পরিবেশ, শ্রমঘন্টা নির্ধারণকরণসহ কোন কিছুই এক শতাব্দী পরেও এই ক্ষেত্রগুলো সহজ সরল ও স্বাচ্ছন্দ্যে প্রতিবন্ধকতাহীনভাবে আলোর মুখ দেখেনি।
১৯১০ থেকে ১৯৯৫। পঁচাশি বছরের নিরবিচ্ছিন্ন নারীর অধিকার, মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন কতটুকু অর্জন করতে পেরেছে তা যেমন গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখা দরকার, তেমনি বিশ্লেষণ করা দরকার ১৯১০ এ ঘোষিত নারী দিবসের সঙ্গে ১৯৯৫-এ ঘোষিত বেইজিং প্লাটফর্ম ফর এ্যাকশান (পিএফএ) এর অন্তর্লীণ সম্পর্কটি কোথায়?
কখন কোন যুগ হতে নারীর প্রতি সহিংসতা শুরু হয়েছে তা বলা মুশকিল, তবে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে যখন পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে ঠিক তখনই পরিবারে কাজের দায়-দায়িত্ব এবং ভ’মিকা বিভাজনের মধ্য দিয়ে নারী- পুরুষের বিভাজন শুরু হয়েছে ও নারীর প্রতি সহিংসতার বীজ তখনই বপণ হয়েছে। যখনই স্থির হলো নারীরা সন্তান জন্ম দেয়ার সূত্রে লালণ পালণ এবং ঘরসংসারের কাজ করবে এ সিদ্ধান্তেই অবদমিত হলো তার স্বাধীন চলাচল, তার গোটা মনোজগত অধিকার করে নিল পরিবার-সংসার সেবাযত্ন নির্ভরশীলতা, একই সংগে শুরু হল পরাধীণতার নাগপাশ-ভীরুতা, সংকোচ, নারী হোল শৃংখলিত পরিণত হোল দাসানুদাসে। পৃথিবীর চাকাটিকে তথা মানব সমাজের অগ্রযাত্রার রথটিকে চলমান রাখার জন্য নারীর যে অবদান তা অমূল্য হয়ে গেলো- তা কিন্তু তার বোধের বাইরে রয়ে গেলো। ততদিনে পুরুষ হয়ে উঠেছে পরম পরাক্রমশালী প্রভু, মুক্ত স্বাধীন গতিতে দৃঢ় পদক্ষেপে, জ্ঞানার্জনের সুযোগে এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অবাধ অংশগ্রহণে সম্পদ শক্তিতে বলিয়াণ।
বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে সকলের কাছে আমার প্রশ্ন বিশ্বে কি মানুষ হিসেবে শুধুমাত্র পুরুষই চিহ্নিত? নারী কি মানুষ নয়? তার অধিকারগুলো কি নিশ্চিত হওয়া বাঞ্চনীয় নয়? নারীকে কেন সর্বদা বঞ্চিত হতে হয়? একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এই অধিকারগুলো নিশ্চিত হয়নি, কিন্তু নির্যাতনের প্রেক্ষাপট বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবছর ঘুরে সময়ের বহুল আলোচিত বিষয় নারী নির্ষাতন শব্দ দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে আলোচিত হতে থাকে। আলোচনার শেষ নেই কিন্তু নারী নির্যাতন প্রতিরোধের বিষয়ে বিশ্ব ব্যাপী সচেতন নারী কন্ঠ উচ্চসিত, তবুও আশার ছলনায় মরিচিকার পিছু হাটছে নারী সমাজ – নারী নির্যাতন অবসানে চলছে ক্ষীণ উদ্যোগ। আর তাই আজও নারী নির্যাতন শব্দ দুটি একটি শরবিদ্ধ পাখির ন্যায় ছটফট করছে। আগে নারী সংসারে নির্যাতিত হোত এখন একজন নারী পুরুষের সাথে সমযোগ্যতায় কর্মক্ষেত্রে আসীন কিন্তু কি আশ্চর্যের বিষয় যোগ্যতা নিয়েও নারী তার কর্মক্ষেত্রে নির্যাতিত হচ্ছে শারিরীক ও মানষিক দ্বৈত প্রকারেই। সপ্তম আশ্চর্যের মত আরও একটি আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, একজন নারী দ্বারাও একজন নারী নির্যাতিত হচ্ছে। শাশুড়ী দ্বারা বধূ নির্যাতনের ঘটনা আজও ঘটে চলেছে- হয়ত নিজের মেয়ের চেয়ে ছোট একটি কন্যাশিশু যার পরিচয় সংসারে কাজের মেয়ে হিসেবে সে নির্যাতিত হচ্ছে, গৃহকর্তী কর্তৃক-এবং এটা কোন বিরল ঘটনা নয়, বরঞ্চ প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে এসব ঘটনা। কোন পিতা মাতা দ্বারা কন্যা বাল্যেই বাল্য বিবাহের বলী হচ্ছে।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। তাই এদেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নে মহিলাদের সম্পৃক্ততা ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা অপরিহার্য অথচ ক্ষেত্র বিশেষে একজন নারীর বিকাশ তথা বাড়ন্তে বাধাগ্রস্থ হতেহচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বেড়ে উঠতে হয় নারীকে। মূলত: বাংলার নারী ও কন্যা শিশু জন্মলগ্ন থেকে বৈষম্যে রশিকার হয় এবং তা শুরু হয় সংসারেই তার পরিবার থেকে। আর আজকের কন্যা শিশুটি কালকের একটি পূর্ণ নারী। কোন কোন ক্ষেত্রে সে যেন আপনা মাংশে হরিণী বৈরী’এবংএরই মাঝে তার পথচলা পাওয়া না পাওয়া নিয়ে বড় হওয়া পরিশেষে জীবনাবসান।
আমি কোন পুরুষের বিরুদ্ধাচারন করছিনা, কোন নারীরও বিরুদ্ধাচরন করছিনা। আমি বিরুদ্ধাচরন করছি একজন মানুষরুপী অ-’মানুষ’এর সে পুরুষ-নারী যে ই হোক। আমি বলবো জীবনকে সুন্দর করুন-মনুষ্যত্বের চর্চা করুন-একজন মানুষকে পুরুষ কি নারী এভাবে চিহ্নিত না করে-মানুষ হিসেবে দেখতে পারার চর্চা করুন। নারী শিক্ষার হার বাড়ছে, তাই নারী কর্মক্ষেত্রের প্রসারও বাড়ছে কিন্তু পাশাপাশি পুরুষদের প্রসারিত জায়গা দেয়ার মত মানসিকতা বাড়ছে কি? এই জায়গাটুকু ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতা তৈরী করতে হবে। মেধায়-মননে, চিন্তা-চেতনায় শুদ্ধ মনমানসিকতায় সুন্দর একটি পৃথিবী পেতে এ কর্মযজ্ঞে প্রথমে পুরুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যদি মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন না করা হয় তাহলে এই পরিবর্তন আদৌ সম্ভব নয়। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চলমান রথের পা দু’টির একটি পা’ নারী অন্য পা’টিপুরুষ এর তাই এক পা’বাদ দিলে অর্থাত নারীকে বাদ দিলে-অর্থনৈতিক উন্নয়ন খুরিয়ে খুরিয়ে চলবে তা আমাদের কাম্য নয়। তাই আগামী পরিকল্পনায় কি বিসর্জন দিতে হবে, কি অর্জন করতে হবে এই জায়গাগুলোচিহ্নিতহওয়া দরকার। অর্থনৈতিক উন্নয়নে যদি মানুষকে মানুষ (নারীনয়) হিসেবে মূল্যায়ন না করা হয় তাহলে এই পরিবর্তন সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সূচনালগ্ন থেকেই নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে মানবাধিকারমূলক বহুমুখী কার্যক্রম সাফল্যের সাথে করে আস্ছে। নারীনির্যাতন প্রতিরোধে আন্দোলনমূলক, আইনগত ও চিকিৎসাগত মানসিক ও মানবিক সকল ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে। বাংলাদেশ মহিলাপরিষদ কর্তৃক আয়োজিতমানবাধিকারদিবস (২৫শে নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত) ১৬দিন ব্যাপী আলোচনাসভার মধ্যে গত ১৭ ডিসেম্বর-২০২০ তারিখের সভায় নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ বিষয়ক সংলাপ” প্রজন্ম সমতা সংলাপ” এ অনেক বিজ্ঞ সূধীজনের মাঝে আমার দুটো কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন প্রথম মহিলা বিচারপতি সম্মানীয় নাজমুন আরা সুলতানা। তিনি তাঁর দীর্ঘ জীবনের অনেক অর্জনের কথা বললেন এবং তখনই তিনি বললেন যে,’ এ বছর বিচারপতি নিয়োগ পরীক্ষায় ১ম, ২য় এবং ৩য় স্থান অর্জন করেছে মহিলা। আমার এ কথাটা বলার কারণ হচ্ছে তাঁরা পরীক্ষায় মেধা যাচাইয়ে উত্তীর্ণ হয়ে বিচারকের আসনে বসেছেন কর্মক্ষেত্রে, কিন্তু আমার প্রশ্ন সর্বত্র তাঁরা কতটুকু নিরাপদ? যে দেশে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্রীকে রাস্তার টোকাইয়ের হাতে নিগৃহিত হতে হয়-সে দেশে বিচারক হোক আর যত যোগ্যতাই সে অর্জন করুক না কেন সে যে ’নারী’সে কি নিরাপদ? বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেমস ম্যানেজার (মহা ব্যবস্থাপক) নাজনীন সুলতানা- তাঁর ব্যাংকে তিনিই প্রথম একজন মহিলা কর্মকর্তা যিনি নির্বাহী পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত হলেন। নারীর পথ চলার এই কঠিন বাস্তবতাটাই তাঁর বক্তব্যে প্রমাণ করেছেন তিনি।
পরিশেষে মাওরি প্রোভারব (Madri Proverb) এর দু’টি লাইন দিয়ে যবনিকা টানবো- যার অর্থ দাঁড়ায় ”সূর্যের দিকে মুখ করে দাড়াও দেখবে ছায়া তোমার পিছনে পড়ে যাবে”-আমরাও আশা করি তমসা ভেদ করে সুন্দর সকাল আসবে সমভাবে সকলের জন্য-এই পৃথিবীতে। জেন্ডার সমতার জন্যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি নির্যাতন মুক্ত জীবন নারীর প্রয়োজন- এ বোধ অনুভব করবে সকলে – এ প্রত্যাশায় আমি কবিতা দাস।
কবিতা দাস (এসপিও)
আারসিডি-৪, জনতা ব্যাংক লি:
প্রধান কার্যালয়,ঢাকা।
০১৬১২-০৯৯১৯২