বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক, এইউজেডনিউজ২৪: বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ মহামারি করোনাভাইরাসে ঘরবন্দি দশায় অতি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে ভার্চুয়াল মাধ্যম। সেই সাথে আবার ভার্চুয়াল মাধ্যম ব্যবহারে বাড়ছে প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি। কিন্তু সচেতনভাবে ব্যবহার না করলে, আশীর্বাদের বদলে এই ভার্চুয়াল মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে অভিশাপ। বিশেষ করে শিশু- নারী ও উঠতি বয়সীদের জন্য। সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও তথ্য প্রযুক্তিবিদরা সচেতনভাবে অনলাইন কার্যক্রম চালানোর পরামর্শ দিয়েছেন। সূত্র : চ্যানেল টোয়েন্টি ফোর ও ফার্স টুডে
সম্ভাবনা ও শঙ্কা শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের আসরে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আজ হচ্ছে এ ধারাবাহিকের শেষ পর্ব। আশাকরি আসরের শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গেই আছেন। গত কয়েকটি আসরে আমরা ভার্চুয়াল জগতে নিরাপত্তা ঝুঁকি ও তা মোকাবেলার উপায় নিয়ে কথা বলেছি। আমরা বলেছি, এ জগতে নিরাপত্তা ঝুঁকি যেমন রয়েছে তেমনি সমাধানের উপায়ও আছে। তবে সব কিছুর আগে নিজেদের সচেতনতা জরুরি।
আসলে ভার্চুয়াল জগতের একটি আকর্ষনীয় দিক হলো,এখানে বাস্তবিক অর্থে কোনো বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা করতে হয় না। প্রয়োজনে নিজের পরিচয় গোপন রেখেই সব কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়। কোনো প্রতিষ্ঠান বা সরকার নির্দিষ্ট কোনো সীমাবদ্ধতা আরোপ করলেও বিকল্প প্রযুক্তির মাধ্যমে তা এড়িয়ে যাওয়াও সম্ভব হয় এ জগতে। তবে বাস্তবতা হলো, ভার্চুয়াল জগতে একজন ব্যবহারকারী যে স্বাধীনতা ভোগ করেন তা আসলে প্রকৃত কোনো স্বাধীনতা নয়। এর মধ্যদিয়ে একজন ইউজার কেবল মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে স্বস্তি লাভ করতে সক্ষম হন। ইন্টারনেট কেন্দ্রিক এ জগতে সময়ের সীমাবদ্ধতা নেই। রাত-দিনের বিভাজন নেই। সত্যিকার অর্থেই ভার্চুয়াল জগত স্থান ও সময়ের প্রচলিত ধারণাকে পাল্টে দিচ্ছে। এই জগতের কল্যাণে বিশ্বের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হচ্ছে নিমিষেই। এক সময় যা ছিল অকল্পনীয়।
ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরতার কারণে মানুষের আচার-আচরণেও পরিবর্তন আসছে। এ পরিবর্তন কখনো ইতিবাচক কখনো আবার নেতিবাচক। সাধারণ জ্ঞান অর্জন যেমন সহজ হয়েছে তেমনি সহজে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পথও খুলে গেছে। যোগাযোগ হয়ে পড়ছে যন্ত্রকেন্দ্রিক। বলা হয়ে থাকে,অনেকেই একসঙ্গে বসবাস করলেও তথ্য আদান-প্রদান করেন যন্ত্রের মাধ্যমে। এর ফলে মাধ্যমবিহীন যোগাযোগ ও সম্পর্ক ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পেছনে মানুষ এখন অনেক বেশি সময় ব্যয় করছে। আমরা বলছি না, এসবের প্রয়োজন নেই। কিন্তু এর ব্যবহার হচ্ছে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি। পরিবারের সদস্যরা ইন্টারনেটের পেছনে অনেক বেশি সময় ব্যয় করায় বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে। দূরত্ব বাড়ছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও।
তরুণদের মাঝেই ভার্চুয়াল জগতের প্রতি ঝোঁক-প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। এ কারণে তরুণ সমাজের মধ্যে একধরনের আত্মকেন্দ্রিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি আসক্ত তরুণরা এখন আর আগের মতো একজায়গায় বসে গল্প-গুজব করতে খুব একটা আগ্রহী নয়। এর ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ও মনের টান কমে যাচ্ছে। অনেকেই ইন্টারনেটে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। ইন্টারনেট তথা ভার্চুয়াল জগতের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষনের পেছনে প্রধানত পাঁচটি কারণ কাজ করে। এক- যৌন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি ঝোকপ্রবণতা; দুই- ইন্টারনেটের মাধ্যমে নতুন নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রবল আগ্রহ; তিন- জুয়াসহ এ ধরনের নেশা সৃষ্টিকারী বিভিন্ন খেলার প্রতি ঝোকপ্রবণতা; চার- নতুন নতুন তথ্য সংগ্রহের মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহ এবং সর্বশেষ কম্পিউটার গেইমের নেশা। ইন্টারনেটের প্রতি আসক্ত ব্যক্তিরা সাধারণত সামাজিক তৎপরতা কমিয়ে দেয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজের প্রতি তাদের আগ্রহ হ্রাস পায়। পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইন্টারনেট ব্যবহারে বাধা পেলে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।
ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ভাইবার,হোয়াটসআপ ও টেলিগ্রামের মতো মাধ্যমগুলোর জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। প্রতিদিনই সেখানে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন ব্যবহারকারী। আসলে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এখন মানুষের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। বিশ্বের সব দেশেই একই চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে পরিবার, সমাজ ও সংস্কৃতিতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব বেশি লক্ষ্যণীয়। এ কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জাতি তাদের জাতীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচিতি হারানোর আশঙ্কায় রয়েছে। তারা এখন এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজছে।
ইন্টারনেটের ভালো ও মন্দ দু’টি দিকই রয়েছে। তবে ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহারের কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু-কিশোররা। অনেক অভিভাবকই ইন্টারনেট সম্পর্কে অজ্ঞ হওয়ায় এ ধরণের নিয়ন্ত্রণহীনতা দিনে দিনে বাড়ছে। শিক্ষার পরিবর্তে কখনো কখনো কুশিক্ষা গ্রহণ করছে। শিশু-কিশোরদের একটি প্রবণতা হলো নিজেকে প্রকাশ করা এবং অন্যকে অনুসরণ করা। আত্মপ্রকাশ ও অনুসরণের প্রবণতা তাদেরকে কৌতূহলপ্রিয় করে তুলে। কৌতুহলের বশে তারা নতুন কিছু জানতে চায়,শিখতে চায়। এ স্বতঃস্ফূর্ত আকাঙ্খাকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে হবে। আর তাহলেই ছেলেমেয়েরা ভবিষ্যৎ জীবনে, কর্মক্ষেত্রে এবং সমাজে সফল মানুষ হতে পারবে। এর বিপরীতে শিশু-কিশোর বয়সে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ না করলে এবং পুরোপুরি তার ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিলে তারা নানাবিধ অন্যায়-অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে। এ কারণে অভিভাবকদের সচেতনতা জরুরি। শিশু-কিশোরদের ইন্টারনেটে কী করছে,কার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলছে এ বিষয়ে মাতা-পিতা,অভিভাবক ও শিক্ষকদের পক্ষ থেকে খোঁজ-খবর রাখতে হবে।
বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় মা-বাবা, অভিভাবক ও শিক্ষকদের আরও সচেতন হতে হবে। নিজেদের মধ্যে এ ধরণের আসক্তি থাকলে তা ত্যাগ করে সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যত গড়ার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। শিশুদের গল্প শোনাতে হবে, নানা ধরনের খেলা ও বেড়ানোর মতো নিরাপদ বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ হয়- এমন খেলাধুলায় ব্যস্ত রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সব মিলিয়ে বাবা-মা এবং আত্মীয়-স্বজনের পক্ষ থেকে পরিবারের শিশুদেরকের আারও বেশি সময় দিতে হবে।
সর্বোপরি ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিজেদের পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে এই জগত মানুষের জন্য শান্তি, কল্যাণ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে। গোটা মানব সমাজকে সুস্থ ও সমৃদ্ধ রাখতে এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা, শলা-পরামর্শ ও সহযোগিতা জরুরি। যা কিছু কল্যাণকর তা লালন করে অকল্যাণকর সব কিছু দূরে রাখতে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে।#