সকাল থেকে একটার পর একটা ফোন। কত কত পরিচিত মানুষের কণ্ঠ। ‘সকাল থেকে ফোন ধরেই আছি, একজনের পর একজন মনে করছেন, কত স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে। এই যে মানুষের ভালোবাসা ও দোয়া পাচ্ছি, তাতে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়,’ বললেন ডলি জহুর। এত ফোনের উপলক্ষ আসলে তাঁর জন্মদিন। ১৭ জুলাই ৭০ বছর পূর্ণ করলেন অভিনেত্রী ডলি জহুর। এদিন সকালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী এই অভিনেত্রীর সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তাঁর বাসার নিচে অপেক্ষমাণ একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের গাড়ি। তাদের তারকা আড্ডায় আজ (বৃহস্পতিবার) তিনি অতিথি। কথা বলতে বলতে গাড়িতে উঠে পড়েন। গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কথাও চলতে থাকে। কথা বলতে বলতে ডলি জহুরের শৈশব জানতে ইচ্ছা করে। তিনি জানান, পৈতৃক ভিটা ব্রাহ্মণবাড়িয়া হলেও তাঁর জন্ম ঢাকার ভূতের গলিতে। ভূতের গলিতেই কেটেছে শৈশব, কৈশোর। তবে সেই সময়ের জন্মদিনের কথা তেমন মনে পড়ে না। শুধু মনে আছে, বাড়িতে সেদিন অনেক রান্না হতো। পাঁচ বোন আর দুই ভাই মিলে খুব আয়েশ করে খাওয়া হতো। ডলি জহুর বলেন, ‘বাড়িতে বড় উঠান ছিল, মা মুরগি পালতেন। মনে পড়ে, সেদিন মুরগি জবাই দিতেন মা, সঙ্গে আরও অনেক পদ রান্না হতো। দুধওয়ালার থেকে এদিন বেশি করে দুধ রাখতেন মা। পায়েস রান্না হতো। ছোটবেলার জন্মদিন বলতে এতটুকুই স্মৃতি।’ বাবা ছিলেন ডাক বিভাগের সুপারিনটেনডেন্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মঞ্চনাটকে যুক্ত হন তিনি। এভাবেই অভিনয়ে আসা।
স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন একমাত্র ছেলে। প্রথম প্রহরেই তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে। কয়েকবার আসা-যাওয়া করলেও সেখানে মন টেকেনি। আসলে ঢাকাতেই শান্তি পান ডলি জহুর। বলেন, ‘দেশের মানুষের কষ্ট যখন দেখি, তখন মনে হয়, এদের ছেড়ে আমি কোথায় যাব? এত দূর থেকে মন আনচান আনচান করে। আর ওখানে গেলে মনে হয়, আমি যেন নির্দিষ্ট একটা গণ্ডিতে বন্দী। এখানে খোলা আকাশ, পরিচিত মানুষজন, চেনা পরিবেশ।’ তবে দেশের মানুষের মধ্যে এখন আর আগের মতো নিখাদ ভালোবাসা খুঁজে পান না ডলি জহুর। এখনকার ভালোবাসা আর সম্মান মনে হয় মেকি। ডলি জহুর বলেন, ‘মানুষ কেমন জানি নিষ্ঠুর হয়ে গেছে। মায়া-মানবিকতা মানুষের মধ্যে আর নেই। পাশের মানুষটাকে আপনজন মনে করতে পারে না। নিজের সুখের চিন্তায় সবাই। এসব দেখে খুব কষ্ট পাই, এগুলো আর নিতে পারি না।’
মঞ্চের পর একসময় টেলিভিশন নাটকে অভিনয় শুরু করেন এই অভিনেত্রী। তাঁর অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে এইসব দিনরাত্রি, অক্টোপাস, সুখের উপমা, আন্তরিক, একদিন হঠাৎ, শেষ পত্র, চুপি চুপি, ক্ষণিকালয় উল্লেখযোগ্য। নব্বইয়ের দশকে ঢাকাই চলচ্চিত্রে মা চরিত্রে ডলি জহুর ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। দুবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। আর সারা জীবনের কাজের জন্য ২০২১ সালে পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা। সাম্প্রতিক সময়ে পর্দায় তাঁর উপস্থিতি খুব কম। আসলে একই ধরনের চরিত্রে কাজ করে তিনি বিরক্ত। অভিনেত্রী বলেন, ‘চলচ্চিত্রে কাজ ছেড়েছি এ কারণেই, একই ধরনের গল্প, পর্দায় উপস্থিতিও কম। আর নাটকে তো সব জায়গায় এখন ঘুরেফিরে এক-দুইটা মুখ। তাই কাজ কম করি।’ কথা বলতে বলতে গন্তব্যে পৌঁছে যান ডলি জহুর। জীবনের এই পর্যায়ে এসে মানুষের কাছে তাঁর চাওয়া কী, সবশেষে জানতে চাই। বললেন, ‘ভালোবাসাটুকু যেন সত্যি হয়, নিখাদ হয়। সেটুকুই চাওয়া।’
৭০ বছরে ডলি জহুরের চাওয়া
বিনোদন
7,854 Views