সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনসহ সংস্কারের অনেক প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি। সংবিধানে সব ধরনের সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোট আয়োজনের বিধান যুক্তের বিপক্ষে দলটি। তবে বেশকিছু প্রস্তাবে একমত হয়েছেন বিএনপির নেতারা। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বিএনপির বৈঠকে এসব আলোচনা হয়। বৈঠকের সব বিষয়ে আলোচনা শেষ না হওয়ায় রোববার আবারও বৈঠক হবে।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ ও নজরুল ইসলাম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিহউল্লাহ এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল অংশ নেন। এতে ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে সংস্কারের বিষয়ে দলের অবস্থানের হার্ডকপি জমা দেওয়া হয়। বৈঠকে সংবিধান সংস্কার কমিশন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশ নিয়ে দফাওয়ারি আলোচনা হয়েছে বলে জানান সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না আমরা কতটি প্রস্তাবে একমত হয়েছি। আমরা প্রায় সব বিষয়ে কাছাকাছি আসতে পেরেছি। কিছু বিষয়ে ভিন্নমত থাকতেই পারে এবং আছে। তিনি বলেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, মৌলিক অধিকার ও আইন বিভাগের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। নির্বাহী বিভাগ ও সংবিধানে বিচার বিভাগ সংক্রান্ত আলোচনা আগামী বৈঠকে করা হবে। সব আলোচনা শেষ না করে সারমর্ম বলা যাবে না। তিনি আরও বলেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রজাতন্ত্র এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি প্রসঙ্গে একমত হতে পেরেছি। কিছু বিষয়ে আমাদের সুচিন্তিত মতামত দেব। বিষয়গুলো আমাদের দলীয় ফোরামে আলোচনা করতে হবে। তারাও কিছু বিষয়ে আমাদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে পুনরায় সিদ্ধান্ত নিয়ে জানাবেন।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অর্থবিল ছাড়া সব বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে সংসদ-সদস্যদের ভোটের ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনায় বিএনপি দ্বিমত করেছে। এ প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতি এবং প্র্যাকটিসে যদি আমরা ৭০ অনুচ্ছেদ অর্থবিল ছাড়া বাকি সর্বক্ষেত্রে ওপেন করি, তাহলে সরকারের স্থায়িত্ব থাকবে না এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাপক বাধা আসতে পারে। সেক্ষেত্রে আমরা বলেছি, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধন বিল, আস্থা ভোট এবং জাতীয় নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বাদে সংসদ-সদস্যরা যে কোনো বিষয়ে আলাপ-আলোচনা এবং সংসদে ভোট দিতে তাদের কোনো বাধা থাকবে না। ভবিষ্যতে যদি আমরা গণতান্ত্রিক প্র্যাকটিসের মধ্য দিয়ে সাংবিধানিক শাসনের ধারাবাহিকতায় যদি সেই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারি, তাহলে ৭০ অনুচ্ছেদের বিষয়টি আমরা ওপেন করে দিতে পারব। অথবা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পারবে, সেটা আমরা মনে করি।
সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে সংসদের উভয় কক্ষে পাশ হওয়ার পর এবং তা রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের আগে গণভোটে দেওয়ার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এ প্রস্তাবে দ্বিমত জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা বলেছি যে সব সংবিধানের সংশোধনী গণভোটের জন্য প্রযোজ্য নয়। শুধু যেসব বিষয় বর্তমানে সংবিধানে রয়েছে, যেমন সংবিধানের মূলনীতি এবং ৪৮, ৫৬ ও ১৪২ অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে হলে গণভোটে যেতে হবে।
জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি) বিষয়ে বৃহস্পতিবার বৈঠকে আলোচনা হয়নি বলে জানান সালাহউদ্দিন আহমেদ। প্রাথমিক আলোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা এ ধারণার সঙ্গে একমত নই। আমাদের দেশে এর কোনো প্র্যাকটিস ছিল না। আমাদের রাজনৈতিক ও সংসদীয় ইতিহাসে এটা নতুন হবে। তারপরও আমরা বলেছি, এ বিষয়টা পরবর্তী নির্বাচিত সংসদে বিস্তর আলোচনার মধ্য দিয়ে গ্রহণ করা হবে কি হবে না, সেটা তখন আলোচনা করা যাবে। এখন আমরা এ বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হইনি।
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির বিষয়ে বিএনপি পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চায় বলে জানান সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ওইখানে ধর্মনিরপেক্ষতা নেই। আল্লাহর ওপর আস্থা এবং বিশ্বাস আছে। ওইখানে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদসহ সবকিছু আছে। আমরা বহুত্ববাদের পক্ষে নই, ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির পক্ষেও নই। আমরা বহুত্ববাদের বিরোধিতা করেছি। তবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার, যে কথাগুলো স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা আছে, সেসব বিষয়ে ওনারা প্রস্তাবনায় এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেছে, সেগুলোর বিষয়ে আমরা নীতিগতভাবে একমত হয়েছি। তবে আমরা দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে জানাব।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের যেসব বিষয়ে একমত হয়েছেন, তা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে-এমন প্রশ্নে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজ হচ্ছে সবার সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো একত্রিত করে প্রতিবেদন তৈরি করে পক্ষগুলোকে স্বাক্ষর করতে বলবেন নাকি এটাকে ওনারা জুলাই সনদ বলবেন নাকি অন্য কিছু বলবেন, তা তারাই ঠিক করবেন।
এর আগে বৈঠকের শুরুতে সূচনা বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, বিএনপি সংস্কারের বিপক্ষে নয়, বরং বিএনপি সংস্কারেরই দল, তবে সবকিছুর মূলে জনগণ। জনগণের সম্মতিতে যেন সব হয়। আমরা বুধবার প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, বিএনপি সংস্কারের বিপক্ষে নয়, বিএনপি সংস্কারেরই দল।
সূচনা বক্তব্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেন, আমরা দেখেছি, গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খেয়েছে। শুধু তাই নয়, একটি ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এ দেশে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিএনপির একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে এ দলটি দাবি উত্থাপন করেছে, কর্মসূচি দিয়েছে। ফ্যাসিবাদী শাসনের লড়াইয়ের পাশাপাশি সংস্কারের তাগিদ দিয়েছে বিএনপি। সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে সুপারিশগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সামনে অগ্রসর হতে চাই।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা এমন একটি জায়গায় পৌঁছাতে পারব, যেখান থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ও সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথরেখা নির্দেশ করবে। ইতোমধ্যে কিছু বিষয়ে বিএনপির একমত ও ভিন্নমত আছে। আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা আশা করি এক জায়গায় আসতে পারব। টেবিলের দুই ধারে বসলেও আমরা দুপক্ষ নই।