সম্পাদকীয় ডেস্ক, : ৭২ বছর আগের মায়ের ভাষাই আজকের অমর একুশে ও মহান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে ৫২’র বীর শহীদসহ ভাষা সৈনিকদের প্রতি রইলো সশ্রদ্ধ সালাম। যাদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে আজকে সগৌরভে বলতে পারি ’আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি। আমি কি ভূলিতে পারি……’ । অ, আ, ক, খ, গ, ঘ, ঙ, চ, ছ, প, ত, এ, ভ, ম শ, – এই অক্ষরগুলোই আমাদের প্রাণ, জয়ের গান, বিশ্বের দরবারে পরিচয় করে দিতে যার ভূমিকা অপরিসীম। মায়ের ভাষা কথাটির পেছনে অনেক রক্তঝরা শহীদের স্মৃতি বিজড়িত। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারদের মতো বাঙালীদের রক্তের বিনিময়ে আজ এ দিনটিকে আরও বেশী স্বরণীয় করে রাখতে ইউনেস্কো ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার মানুষেরা আজকের এই পৃথিবীর মানচিত্রে সম্মান জানিয়েছে আমাদের এই ভাষা শহীদদের প্রতি। দ্বিজাতি তথ্যের ভিত্তিতে মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা পরিলক্ষিত হয়েছিল বৃটিশ শাসন শোষনের পর। আজ আমরা স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলার মাটিতে এই মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করেছি সেই রক্তঝরা শহীদদের আন্দোলনের মাধ্যমে। পাকিস্তানী জান্তারা বরাবরই বাংলার মেধাবীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল মেধা শূন্য করে তাদের উর্দু ভাষাকে পুরোপুরিভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু তা কি করে সম্ভব; বাংলার মায়ের সন্তানেরা এতোটা দেশ প্রেমী যেখানে যেকোন পরাশক্তিকে প্রতিহত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাই মহান একুশে ফেব্র“য়ারী দিনটি কালজয়ী স্বাক্ষী হয়ে আছে আজকের এই বাংলাদেশ। যেই দেশটিতে আজ সবাই মুক্তমনে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পেরেছে। এই বাংলা সংস্কৃতির ছোঁয়ায় আজ আমরা অনেক কিছুতে বিশ্বের দরবারে জানান দিতে পেরেছি মেধা বিকাশের মাধ্যমে। যেখানে আজ পৃথিবীর মানচিত্রে সিয়েরালিওন নামক রাষ্ট্রটি পর্যন্ত আজ আমাদের মায়ের ভাষাকে প্রাধান্য দিয়েছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারী’ ঐতিহাসিক গানটি পরিবেশন করে। ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা কিংবা পর্যালোচনার ইতিহাস সবারই জানা। তারপরও এই মাতৃভাষার ঐতিহাসিক পটভ‚মিকে স্মরণ করে রাখতে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পুণরায় প্রকাশ করতে হলো এই প্রজন্মের কাছে। কারণ নতুন প্রজন্মকে আরও বেশী দেশ প্রেমী চিন্তা চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে পূর্বের ইতিহাসকে স্মরণ করে। উৎখাত করতে হবে ১৯৫২, ১৯৭১’এর সেই পাকিস্তানী অপশক্তিকে, যারা এখনও এই দেশের বিরুদ্ধে কোন না কোন রাজনৈতিক দল কিংবা ব্যক্তি স্বার্থের দোহাই দিয়ে সক্রিয় রয়েছে প্রগতিশীল ও সুষ্ঠু ধারার গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে। তাই সাড়ে ষোল কোটি বাঙালী সজাগ থাকবে সকল অপশক্তিকে পরিহার করে বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখার জন্য এই স্মরণীয় দিনটিকে মনে রেখে। বাংলাদেশকে সঠিক গণতন্ত্রে পৌছে দিতে সরকারের পাশাপাশি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আবারও সৃষ্টি করতে হবে ৫২’র ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক স্মৃতিকে লালন করে।
ভাষার লড়াইয়ের তাৎপর্যপূর্ণ পর্যালোচনা : ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে দ্বি-জাতি তত্তের উপর ভিত্তি করে। পূর্ব বাংলায় মসুলমানরা ছিল সংখ্যা গরিষ্ঠতার দিক দিয়ে। তাই পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ঐ দেশের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশের শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি ধ্বংস করার চেষ্টা চালায় যার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয় ভাষা আন্দোলন। পাকিস্তানের নব্য উপনিবেশবাদী, ক্ষমতালোভী, উদ্ধত শাসকরা শুরু থেকেই পূর্ব বাংলার মানুষের উপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাতে থাকে। তাদের প্রথম টার্গেট ছিল কিভাবে কেড়ে নেবে এই বাংলা মায়ের মুখের ভাষা। পাকিস্তান সৃষ্ঠির পূর্বে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। পূর্ব বঙ্গ থেকে ড. মুহাম্মদ শহীদুলাহ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। প্রখ্যাত লেখক ড. আব্দুল ওয়াদুদ ভুইয়া’র ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়ন’ নামক বইয়ের ১৭০ পৃষ্ঠায় স্পষ্টভাবে বিভিন্ন ভাষাভাষির আনুপাতিক হার পরিলক্ষিত হয়। যেখানে বাংলা ভাষার আনুপাতিক হার ছিল ৫৪.৬ শতাংশ, পাঞ্জাবি- ২৭.১%, পশতু- ৬.১%, উর্দু-৬%, সিন্ধি-৪.৮% এবং ইংরেজি ভাষার আনুপাতিক হার ছিল ১.৪। তাহলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলা ভাষার আনুপাতিক হার ছিল সবচেয়ে বেশী। আর মাত্র শতকরা ৬ শতাংশ ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানী স্বৈর শাসকরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। শুধু তাই নয় একের পর এক নির্যাতন ও বর্বরোচিত হামলা করে আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলাকে একইবারে সর্বশান্ত করতে মরিয়া হয়ে উঠে। কিন্তু মায়ের ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে এই বাংলার আকাশে বাতাশে তখন ধ্বণিত হতে থাকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই নামক শ্লোগান। আর এই মিছিলের কণ্ঠস্বর এতো বেশিই প্রতিধ্বণিত হতে থাকে যার ফলশ্র“তিতে আজ আমরা মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারছি। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ভারত বিভাগের ১৯ তম দিনে “তমুদ্দন মজলিস” গঠন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রূপ দেয়ার উদ্যোগ নেন। ঐ বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু ” শিরোনামে এই সংগঠনের উদ্যোগে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়, যা ভাষা আন্দোলনের ঘোষণা পত্র নামে পরিচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেমী মূলত রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে আন্দোলনে রূপ দেয়ার প্রথম উদ্যোক্তা। তার উদ্যোগেই তমদ্দুন মজলিস নামের সাংস্কৃতিক সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে করাচিতে এক কেন্দ্রীয়পর্যায়ের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পূর্ব বাংলা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তখন তীব্র প্রতিবাদ শুরু করে। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারী মাসে এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ঢাকায় সর্ব প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং কতিপয় দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নীতি গঠিত হয় । ঐ বছরই পাকিস্তান গণ পরিষদের প্রথম অধিবেশনে কংগ্রেস দলীয় সদস্যগণ বিশেষত কুমিলার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি জানান ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষা ব্যবহার করার জন্য। কিন্তু ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে ঢাকার এক জনসভায় ঘোষণা করেন (Urdu and only Urdu shall be the state language of Pakistan) “ উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা।” তিন দিন পরে কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে তিনি যখন একই ঘোষণার পুণরাবৃতি করেন,তখন উপস্থিত ছাত্ররা না না না ……. বলে এর প্রতিবাদ জানায়। পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর অব্যাহত দূরুভিসন্ধি দৃষ্টিভঙ্গী, বিভিন্ন ন্যায্য দাবী দাওয়া পূরণে অস্বীকৃতি এবং ভাষার ক্ষেত্রে মুসলিম লীগ সরকারের নীতির বিরোধিতায় মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। আর সেই সময়ের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, দেশ প্রেমী, সাহসী, মেধাবী আর ভাষা আন্দোলনের আরেক সৈনিক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিযুক্ত হন সহ সাধারণ সম্পাদক হিসাবে। একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানেও পীর মানকি শরীফ এর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। পরবর্তীতে এই দুই দল একত্রিত হয়ে পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করে এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এর আহবায়ক নিযুক্ত হন। ভাসানী ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত ৮ বছর আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং ভাষা আন্দোলনসহ পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের নেতৃত্ব প্রদান করেন। পাকিস্তানে প্রথম বিরোধী দল হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আওয়ামী মুসলিম লীগ ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং রাজপথের আন্দোলন সংগঠনের পাশাপাশি পার্লামেন্টেও রাষ্ট্রভাষার দাবীতে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে। ১৯৫০ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালে খাজা নাজিমুদ্দিন পুণরায় একই ঘোষণা দেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা। ফলে ছাত্র-বুদ্ধিজীবী মহলে দারুন ক্ষোভ ও হতাশা তৈরী হয় এবং আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে । এ আন্দোলনের অংশ হিসাবে ১৯৫২’র ৩০ জানুয়ারী ঢাকাতে সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। আন্দোলনকে তীব্রতর করার লক্ষ্যে ঐ দিনই এক জনসভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কমিটি গঠিত হয়। আর এই কমিটির মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই শ্লোগান ক্রমান্বয়ে জোরদার হতে থাকে। এর ফলশ্র“তিতে ২১ ফেব্র“য়ারীর উক্ত কর্মসূচিকে বানচাল করার জন্য তখনকার গভর্ণর নুরুল আমিন সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেন। কিন্তু পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতা সকল ভয়কে উপেক্ষা করে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকে। তারা এতে কোনরূপ ভ্রুক্ষেপ না করে সংগাম চালিয়ে যায়। সরকার কর্তৃক জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ২১ ফেব্র“য়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলা ভবনের সামনে থেকে শান্তিপূর্ণ মিছিল অগ্রসর হয় এবং কিছুদূর অগ্রসর হয়ে মিছিল যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে আসে ঠিক তখনি পুলিশ মিছিলের উপর গুলি বর্ষণ করে। ফলে মিছিল কিছুটা ছত্র ভঙ্গ হয় এবং রফিক, বরকত, সালাম, জব্বার সহ আরও নাম না জানা অনেক ছাত্র শহীদ হন। সরকারের এই বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ছাত্রদের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদ মুখর হয়ে শহীদের রক্তে রঞ্জিত রাজপথে নেমে আসেন এবং প্রবল প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্র“য়ারী এদেশের আপামর ছাত্র সমাজ বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে যে মাতৃভাষা বাংলা অর্জিত হয়েছে তার গন্ডি তখন শুধু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং একুশে ফেব্র“য়ারী ভাষা আন্দোলনের চেতনা আজ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্রই। ভাষার জন্য বাঙালি জাতির এ আত্মত্যাগ আজ নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে। তাই ১৯৫৩ সাল থেকে প্রতি বছর ২১ ফেব্র“য়ারী তারিখে মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ দিন প্রত্যুষে সর্বস্তরের মানুষ নগ্ন পায়ে প্রভাতফেরীতে অংশ গ্রহণ করে এবং শহীদ মিনারে গিয়ে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন ও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে। সারাদিন মানুষ শোকের চিহ্নস্বরূপ কালো ব্যাজ ধারণ করে।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা-ইউনেস্কো বাংলাদেশ সহ ২৭ টি দেশের সমর্থনে সর্বসম্মতভাবে মহান একুশে ফেব্র“য়ারীকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউনেস্কোর প্রস্তাবে বলা হয় ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্র“য়ারী মাতৃভাষার জন্য বাংলাদেশের অনন্য ত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ এবং সারা বিশ্বে স্মরণীয় করে রাখতে এই দিনটিকে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। প্রতিবছর ২১ ফেব্র“য়ারী ইউনেস্কোর ১৮৮ টি সদস্য দেশ এবং ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে। আর এরই ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালের ২১ ফেব্র“য়ারী সারা বিশ্বব্যাপী প্রথম পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ২০০১ সাল থেকে দিবসটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে উদযাপিত হচ্ছে। এই মাসটিকে আর স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিবছর বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণসহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজন করা হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা এবং সরকারীভাবে বাংলা ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একুশে পদক প্রদান করা হয় এই মহান চেতনাকে কেন্দ্র করে।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মানস কন্যা আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা আজকে বিশ্বের তারকা খেতি লাভ করেছেন অনেক কঠিন সময় পার করে। এ খ্যাতি বঙ্গবন্ধু কন্যা হিসেবে লাভ করেন নি। তার মেধা, তার দূরদর্শিতা, তার সময়মত সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার জন্যই আজ বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে উন্নয়নের মডেল। বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ন, শিক্ষার হার শতকরা ৮০%, মানুষের মাথা পিছু আয় ৩৫০ থেকে আজকে ২০০০ ডলার। স্বাস্থ্য সেবা এতো বেশী উন্নয়ন ঘটেছে যে, মানুষের গড় আয়ূ ৫৪-৭০ বছর। বিদ্যুৎ ৩৫০০ থেকে ২৪০০০ মে:ও: এ উৎপন্ন করে ঘরে ঘরে বিদ্যুতের সুবিধা পাচ্ছে। বিদ্যুৎ পাচ্ছে বলেই যত্রতত্র কল কারখানা স্থাপিত হচ্ছে। আজকাল বিদ্যুতের অভাবে কোন গার্মেন্টস বন্ধ থাকেনা। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের ১৩ কোটি মানুষই মোবাইল ব্যবহার করে থাকে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রত্যন্ত এলাকায় বসেই সারা পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয় রাখতে পারছে। এই হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ। সবই শেখ হাসিনার অবদান। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছেন আমরা সবই পারি। পদ্মা সেতু, ঢাকা শহরে উড়াল সেতু, নির্মীয়মান মেট্রো রেল, চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদীর নিচে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু টানেল বাংলাদেশের উন্নয়নের মডেল। জঙ্গি দমনে যেখানে পশ্চিমা দেশগুলি ব্যর্থ হচ্ছে সেখানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের জঙ্গি নিশ্চিহ্ন হয়েছে। জাতিসংঘের কাছ থেকে শেখ হাসিনা জঙ্গি দমনে স্বীকৃতি স্বরুপ অনেক পুরস্কৃত হয়েছেন। শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে আজকে আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে উপনীত। ইতিমধ্যে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উপনীত হয়েছে এবং জাতির জনকের প্রত্যাশিত সোনার বাংলা গড়ার কারিগর শেখ হাসিনা রূপকল্প ২০২২ ঘোষনা করেছেন। অবশ্যই ২০২২ বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উপনীত হবে। সারা জাতি আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাধীনতার সুবর্নজয়ন্তী, জাতির জনকের জন্মশত বার্ষিকী পালন করছে।
আজ আমরা হাসি-আনন্দ, দু:খ বেদনা সবকিছুই প্রকাশ করি মায়ের ভাষায়। তাই ভাষার এ গুরুত্বের কথা ভেবেই পৃথিবীর সব দেশেই প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় মাতৃভাষার মাধ্যমে। মাতৃভাষা দিয়েই শিশুর মনে স্বদেশ প্রেমের সূত্রপাত ঘটে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। ১৯৫২ সালের এই দিনে রক্তের বিনিময়ে অকাতরে জীবন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা ভাষার মর্যাদা- “আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমিকি ভুলিতে পারি। ”
আখতার-উজ-জামান
সাংবাদিক, লেখক, গবেষক
০১৭১১-০১৯৭১৭