আখতার-উজ-জামান: একটি দেশের গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে বাঙালি জাতি কখনো পিছু পা দেননি এবং দেবেনও না। এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে পাক হায়েনাদের কাছ থেকে একাত্তরের সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অর্জনই ছিল আজকের সাড়ে ষোল কোটি জাতির মূল্যবোধ। বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ৫০ বছরের ইতিহাস-স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। বাঙালির অনেক বছরের স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ, জাতির জন্য একটি স্বাধীন ভূখন্ডের সৃষ্টিতে সহায়তার নামই বংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি), তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে নতুন আঙ্গিকে সাজানোর জন্য যখনই জাতিরজনক স্বাধীন স্বার্বভৌম দেশটিকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, ঠিক তখনই সোনার বাংলায় স্বাধীনতা বিরোধীদের ষড়যন্ত্রে ৭৫-এর ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অত্যন্ত কষ্ট নিয়ে হৃদয়ের গভীর থেকে জানাই জাতীয় চারনেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। এই তরুণ প্রজন্মের চেতনায় জাগ্রত হোক কলঙ্ক মোচনের বোধ। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামান- দেশের সকল আন্দোলনেই তারা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর। মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অসীম সাহসিকতায় নেতৃত্ব দেন তারা। গঠন করেন মুজিবনগর সরকার। এই জাতীয় নেতাদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয় দেশের মানুষ। ঘরে ঘরে তৈরি হয় দূর্গ, পাল্টা আঘাত হানে শত্রুর উপর। নয় মাস যুদ্ধের পর স্বাধীনতা পায় বাংলাদেশ। পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার পর শুরু হয় নতুন এক দেশ গড়ার যুদ্ধ। এরপর গ্রেপ্তার করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অন্ধকারের চারদেয়ালে বন্দি অবস্থায় হত্যা করা হয় এই বরেণ্য রাজনীতীবিদদেরকে। জাতীয় চার নেতাকে হত্যা অনেকটা জাতীয় সকল নেতাদের হত্যার শামিল। জাতীয় সকল নেতাকে হত্যা দেশের রাজনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়ার অনুরূপ। এই জাতীয় চার নেতাকেও বেশিদিন থাকতে দিলো না এই দেশেরই কুচক্রীমহল। দেশবিরোধী চক্ররাই জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুসহ পুরো পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল ঐ বছরের ১৫ আগস্ট। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ইতিহাসে নিষ্ঠুর, জঘন্য ও নিকৃষ্টতম একটি বছর ছিল ১৯৭৫ সাল। এই বছরেই আগস্ট মাসটি জাতির জীবনে আরেকটি ভয়াল রূপ ধারণ করে। ঠিক তেমনি ৩ নভেম্বর জাতীয় ইতিহাসে আরেক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয়। অথচ তখন দেশ ছিল স্বাধীন। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও দেশে যেমন পাকি বীর্যের সন্তানেরা আছে ঠিক তারচেয়ে বহুগুণে বেশি ছিল তখন। সেই ওরসজাত সন্তানেরা এখনও শুদ্ধ বাঙালী হয়ে উঠতে পারে নি, এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে বাকি বীর্যের বৈশিষ্ট্য। ঐসব কাপুরুষেরা জানে না, তাদের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রভুত্ব। ছলেবলে কৌশলে তাদের দ্বারাই স্বার্থ উদ্ধার করে নিচ্ছে জাতীয় চার নেতাকে হত্যাকারী, বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারীরা, পাকিস্তানের পৃষ্ঠপোষকেরা। এই জাতীয় চার-নেতাকে নিরাপত্তা দিতে পারেনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ, আর স্বাধীনতার ৫০ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের নিরাপত্তা দিয়ে লালন করা হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে। যদিও এখন সাড়ে ষোল কোটি বাঙ্গালী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখছে স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশে। তবে দীর্ঘ ৪৩ বছর কেটে গেলেও এখনো জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার বিচার-প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। সর্বশেষ ২০১২ সালে রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সারসংক্ষেপ সুপ্রীম কোর্টে জমা দিয়েছে। এতে একাধিক আসামিকে খালাস দিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল এবং নিম্ন আদালতের দেওয়া সাজা বহাল রাখার আরজি করা হয়েছে। পরবর্তীতে আপিলের শুনানির দিন ধার্য করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন করার কথা। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড মামলাটি ২১ বছর থেমে ছিল। ঘটনার পরের দিন তৎকালীন উপ-কারা মহাপরিদর্শক কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় উল্লেখ করা হয়, সেদিন রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের নেতৃত্বে চার-পাঁচজন সেনা সদস্য কারাগারে ঢুকে চার নেতাকে হত্যা করেন। এরপর দীর্ঘ বিচার বিরতি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয় এবং নতুন করে মামলাটি গতি পায়। ১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এসএসপি আবদুল কাহহার আকন্দ ২১ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল এই মামলার প্রথম সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এরপর ২০০৪ সালের ২৪ আক্টোবর নিম্ন আদালতের তৎকালীন মহানগর দায়রা জজ মোঃ মতিউর রহমান এই মামলার পলাতক আসামি রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী ও আবুল হাশেম মৃধাকে মৃত্যুদন্ডাদেশের নির্দেশ দেয়। মামলার অন্য আসামীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট রায় দেন। রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্য আট আসামি দফাদার মারফত আলী শাহ, মোঃ আবুল কাশেম মৃধা, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা এবং এ কে এম মহিউদ্দিন আহাম্মদ খালাস পান। তবে অন্য আট আাসামী হাইকোর্টে আপিল না করায় তাদের দণ্ড বহাল থাকে। ইতিহাসের জঘন্যতম এই হত্যাকাণ্ডের বিচারে নিম্ন আদালতে তিন জনের মৃত্যুদণ্ড আর ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। তবে ফাঁসির দুই আসামীসহ ছয় জনকে খালাস দেয় হাইকোর্ট। বিচারিক আদালতের রায় বহাল রাখার আবেদন জানিয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে এরইমধ্যে আপিল করেছে সরকার। এদিকে হত্যাকান্ডের ৪৬ বছর পার হবার পরও বিচার কাজ শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন বাংলাদেশের জাতীয় চার নেতার স্বজনেরা। ইতিহাসের এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, স্তম্ভিত হয়েছিল সমগ্র বিশ্ব। কারাগারের নিরাপদ আশ্রয় থাকা অবস্থায় বর্বরোচিত এ ধরনের হত্যাকান্ড পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। রক্তঝরা সেই দিনটির কথা আজো ভুলতে পারেনি স্বজনেরা। সেদিন শুধু জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করেই থেমে থাকেনি ঘাতকেরা। ধরে নিয়ে যায় ঐ চার নেতার অনেক আত্মীয়স্বজনকে। প্রগতি-সমৃদ্ধির অগ্রগতি থেকে বাঙালিকে পিছিয়ে দিয়েছিল। তাই জেলহত্যা বিচার কাজ শেষ না হওয়াতে ক্ষোভ জানানোর পাশাপাশি দ্রুত বিচার শেষ করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন জাতীয় চার নেতার স্বজনেরা।
৪৬ বছরেও জাতীয় চার নেতার হত্যা মামলায় দোষীদের বিচার শেষ হয়নি
আজনিউজ২৪ :
0 Views