১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার জাঠিভাঙ্গায় সংগঠিত হয়েছিল ইতিহাসের বিভৎস হত্যাযজ্ঞ। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা থেকে ১৬ কি.মি দূরত্বে শুকানপুকুরী ইউনিয়নের জাঠিভাঙ্গা গ্রামটি অবস্থিত। জাঠিভাঙ্গা হাট সংলগ্ন পশ্চিম পাশে উপজেলা পরিষদের রাস্তার উপরে একটি ছোট পুল। এরই নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া পাথরাজ নদীর পানি রঞ্জিত হয়েছিল প্রায় আড়াই হাজার শহীদের রক্তে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা দেখে ভীত হয়ে প্রথম অবস্থায় অনেকেই তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যাননি। কিন্তু যখন মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ডিফেন্স উঠিয়ে চলে যায় এবং খান সেনারা ঠাকুরগাঁও শহর দখল করে এলাকার পর এলাকা অগ্নি সংযোগ, গণহত্যা চালাচ্ছিল তখন ঠাকুরগাঁয় ও এর আশে পাশের এলাকার মানুষ গ্রামের রাস্তা ধরে সীমান্তের উপারে চলে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। পথে তারা অনেকেই পাকিস্তানি সৈন্য ও স্থানীয় রাজাকারদের অত্যাচারের ও হত্যার শিকার হয়। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে খানসেনারা ভূষির বন্দর ,রানীরবন্দর ও ভাতগাঁও এলাকা দখল করতে করতে ঠাকুরগাঁও মহকুমা শহরে এসে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ডিফেন্স উঠিয়ে চলে গেলে খানসেনারা একের পর এক এলাকা দখল করে এবং গণহত্যা পরিচালনা করে।
জাঠিভাঙ্গা গণহত্যায় পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীরদের আক্রমণ করা। প্রাণ রক্ষার্থে ভারতে গমনকারী শরণার্থীদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল হিন্দু জনগোষ্ঠি। পাকিস্তানি সেনা বাহিনীদের হাতে কত শতাংশ হিন্দু জনগোষ্ঠি প্রাণ হারিয়েছেন তার প্রকৃত চিত্র জানা না গেলেও সংখ্যাটি যে ব্যাপক তার একটি অন্যতম উদাহারণ হল জাঠিভাঙ্গা গণহত্যা। পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে ব্যাপক ভাবে সহিংসতা পরিচালিত হয়। মুলতঃ হিন্দুদেরকে বিতাড়ন ও ভারতীয়র প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে পাকিস্তানি সৈন্যরা হিন্দুদেরকে হত্যা করা শুরু করে। তারা ভেবেছিলেন যে হিন্দুদেরকে বিতাড়িত করার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মধ্যে প্রভাব ফেলবে। এ সময়ে ব্যাপক হারে হিন্দু পুরুষদেরকে হত্যা করা হয়। পাশাপাশি মহিলাদেরকে ধর্ষণ করা হয়। অসহায় মহিলাদের কাছে যা কিছু ছিল সবকিছু কেড়ে নেয় স্থানীয় রাজাকাররা। জাঠিভাঙ্গা হত্যা কান্ডের কথা বলতে গিয়ে এখনো শিউরে উঠেন সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীরা।
প্রথম অবস্থায় অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে না গেলেও পরবর্তীতে পাকিস্তানি বাহিনী চারদিকে মানুষ মারছে শুনেজগন্নাথপুর, চকহলদি, চন্ডিপুর,সিঙ্গিয়া,আলমপুর,বাসুদেবপুর,গোরীপুর,মিলনপুর,খামারভোপলা, শুকানপুকুরী, ঢাবঢুব,গোপালপুর,ঠাঙ্গামেলী,কালিগঞ্জ,বাহাদুরবাজার, ঝাড়বাড়িসহ বীরগঞ্জ থানার বেশ কিছু এলাকা থেকে কয়েক হাজার বাঙ্গালি নরনারী ও শিশু ২২ এপ্রিল ভারতের উদ্দেশ্য রওনা হয়। উত্তরে জাঠিভাঙ্গায় তাদের পথরোধ করে এদেশীয় কিছু বাঙ্গালি। সন্ধ্যা নেমে আসায় ক্লান্ত নারী ও শিশুদের কথা চিন্তা করে তারা জাঠিভাঙ্গায় রাত যাপন করে। কিন্তু কে জানত এটাই তাদের শেষ রাত। এদেশীয় দোসররা খবর দেয় পাঞ্জাবিদের।
২৩ এপ্রিল সকালে দুই ট্রাক মিলিটারি চলে আসে জাঠিভাঙ্গায়। জাঠিভাঙ্গা গণহত্যার দিন সকাল থেকেই স্থানীয় রাজাকাররা আশে পাশের বাড়ি ঘরে আশ্রয় নেওয়া হিন্দু পুরুষদের কাউকে ভাঙ্গা পুল মেরামতের কথা বলে, কাউকে বা মিছিলে যোগদানের কথা বলে বাড়ি থেকে ডেকে আনে। যারা আসতে চায় নি তাদেরকে জোর করে নিয়ে আসা হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও স্থানীয় মানুষ রুপী পশু রাজাকাররা প্রাণের ভয়ে লুকিয়ে থাকা মানুষ গুলোকেও খুঁজে বেড় করে আনে। তাদের দোসররা সব পুরুষদের নিয়ে যায় জাঠিভাঙ্গা মাঠে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেখানে লাইন করে নির্বিচারে মারে পুরুষদের। কিন্তু সেখানে এত মানুষ ছিল যে সবাই গুলিতে মারা যায়নি। যারা বেঁচে ছিল, তাদের কে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে কাটা হয়েছে। স্থানীয় অনেক ব্যক্তি কসাই হয়ে অর্থের বিনিময়ে সেই মানুষ কাটার কাজ করেছে। এক একটা মানুষ কাটার জন্য ১০ টাকা করে দেওয়া হয়েছিল। শহিদ হওয়া অধিকাংশ লোকই ছিল হিন্দু। হত্যাযজ্ঞে যোগ দেয় স্বাধীনতা-বিরোধীরা। পরে তারা পাশের পাথরাজ নদীর পাড়ে লাশ ফেলে সামান্য মাটিচাপা দেয়।
জাঠিভাঙ্গা গণহত্যার দিন পাকিস্তানি সৈন্য ও স্থানীয় দালালরা আশে পাশের সকল বাড়ি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা ঘরের মধ্যে মানুষ রেখে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফলে অনেকে ঘরের মধ্যে দ¦গ্ধ হয়ে মারা যায়। অল্প বয়সি ছেলে আর শিশুদের আগুনে ছুঁড়ে হত্যা করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। পাকিস্তানি সৈন্য ও স্থানীয় রাজাকাররা ধর্ষণ ও ব্যাপক হারে নারী নির্যাতন করে। সেদিন প্রায় ২৩০০-২৫০০ পুরুষকে হত্যা করা হয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আর গুলি করে।সেদিন গ্রামের সব পুরুষদের মেরে ফেলা হয়েছিল। শুধু তাদের স্ত্রী ও কোলের শিশুদের বাঁচিয়ে রাখা হয়ে ছিল। স্বামী-স্বজন হারা এসব বিধবাদের কাছে সামান্য যা কিছু অর্থ জিনিসপত্র ছিল স্থানীয় রাজাকাররা সব কিছু ছিনিয়ে নেয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা গণহত্যা সংঘটিত করার পর লাশ গুলো পাথরাজ নদীর তীরে ফেলে রেখে যায়। কিছু লাশ নদীতে ভাষিয়ে দেয়। স্থানীয় রাজাকাররা পরে লাশ গুলো মাটি চাপা দেয়। ১৯৯৬ সালে গণহত্যা ও বধ্যভূমির জায়গাটিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হলেও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংসের পথে স্মৃতিস্তম্ভটি।