ইকোনোমিক ডেস্ক: আমেরিকাকে বিপদে ফেলেছিল এক দশক আগের অর্থনৈতিক মন্দা। করোনা মহামারির কারণে প্রথম লকডাউনের দুই বছর পরে, আবারও দেশটির ব্যবসার চাকা গতিতে ঘুরছে এবং মন্দার পথে হাঁটছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে মন্দার স্মৃতি ঘাটলে অতীতের দুটি সময়কে মনে করিয়ে দেয়। প্রথমত ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালে দেশটির অর্থনীতি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যায়। এরপর ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে অর্থনৈতিক স্থবিরতা দেখা দেয়। দুটোই গুরুতর ও অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল। সে হিসাব অনুযায়ী আগামী, ২০২৪ সালে মন্দার কবলে পড়তে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এই মন্দার প্রভবি কিছুটা হালকা হতে পারে। বিশ্ব অর্থনীতি, সম্পদের বাজার ও আমেরিকার রাজনীতি সবই ভঙ্গুর পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এই মন্দা খারাপ ও অপ্রত্যাশিত পরিণতি ডেকেও আনতে পারে।
আমেরিকার অর্থনীতির সামনের চাপ থেকে রেহাই নেই। দেশটিতে খাদ্য ও পেট্রলের দামে ঊর্ধ্বগতি জনগণের পকেট খালি করছে। গত এপ্রিলে ভোগ্যপণ্যের দাম এক বছরের আগের তুলনায় ৮ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি ছিল। এমনকি খাদ্য ও জ্বালানির দাম বাদে বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২ শতাংশ। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাব ও চীনের শূন্য-কোভিড নীতি যতদিন লেগে থাকে ততদিন সরবরাহ সংকট আরও বাড়বে। আমেরিকান শ্রম বাজার বেশ উত্তপ্ত। গত মার্চ মাসে প্রতিটি বেকার শ্রমিকের জন্য প্রায় দুটি চাকরির সুযোগ রয়েছে বলে জানা যায়। ১৯৫০ সালের পর থেকে সবচেয়ে বেশি এটি এবং যখন ডেটা প্রথম সংগ্রহ করা হয়েছিল। বৈশ্বিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকসের মজুরি বৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। তারা বলছে, পণ্যের দাম বাড়লেও মজুরি বাড়ানোর বিষয়টি নিতে পারবে না কোম্পানিগুলো।
ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম (ফেড) হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থা। আগুনে জল ঢালার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে সংস্থাটি। বিনিয়োগকারীরা আশা করছেন যে ২০২২ সালের শেষ নাগাদ সুদের হার আড়াই শতাংশের বেশি বাড়বে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার ছোট ছোট সমস্যা অতিক্রম করছে। তারা বলছে যে এটি মন্দা সৃষ্টি না করেই তার ২ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু ইতিহাস বলে যে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করার ফলে এটি অর্থনীতিকে সংকুচিত করবে। ১৯৫৫ সাল থেকে, সাতটি অর্থনৈতিক চক্রের সময় এই বছরের মতো দ্রুত হার বেড়েছে সেটির। এসব চক্রের মধ্যে ছয়টিতে দেড় বছরের মধ্যে মন্দা দেখা দেয়। ব্যতিক্রম ছিল ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি, যখন মুদ্রাস্ফীতি কম ছিল এবং শ্রমবাজার আরও ভারসাম্যপূর্ণ ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক ব্যাংকিং ও হোন্ডিং কোম্পানি জেপি মরগান চেসের প্রধান জেমি ডিমন গত ১ জুন আমেরিকাকে সতর্ক করে বলেছেন, অর্থনীতিতে একটি ‘হারিকেন’ আসতে যাচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে, যদিও মন্দার শঙ্কা রয়েছে, তবে এটি তুলনামূলকভাবে অগভীর হওয়া উচিত বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের সংকটে আর্থিক ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়ে এবং ২০২০ সালে সমগ্র সেক্টরের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। উভয় মন্দা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জিডিপিতে সবচেয়ে তীব্রভাবে পতন এনেছে। এই সময়টা নিশ্চয়ই অন্যরকম হবে। কিছু উপায়ে আমেরিকার স্থিতিস্থাপকতা রয়েছে। ভোক্তারা এখনো মহামারির কারণে প্রণোদনা পাচ্ছে এবং কোম্পানিগুলো মুনাফা লাভ করছে। দেশটির আবাসন ব্যবসা মন্থর হচ্ছে, তবে এতেও অসুবিধায় পড়বে না ব্যাংকগুলো। ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম ১৯৮০-র দশকে যে দুর্দশার মুখোমুখি হয়েছিল এবার তা নয়। তখন, সাড়ে ছয় বছর ধরে মুদ্রাস্ফীতি ৫ শতাংশের উপরে ছিল এবং এর হার প্রায় ২০ শতাংশে উন্নীত করতে হয়েছিল, যার ফলে প্রায় ১১ শতাংশ বেকারত্ব বাড়ে। এখন মূল্যস্ফীতি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে টার্গেটের চেয়ে একটু বেশি। এটি আরও পরিষ্কার ও সহজ হওয়া উচিত।
সমস্যা হলো যে মন্দার প্রভাব কম হলেও ভঙ্গুরতা প্রকাশ করবে। কারণ হচ্ছে ইউক্রেন আগ্রাসনের ফলে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে পণ্যের মূল্য বেড়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে এশিয়া পর্যন্ত দেশগুলোর তীব্র খাদ্য সংকট এবং জ্বালানি তেলের দামে ঊর্ধ্বগতি সংকট তৈরি করেছে। রাশিয়ার গ্যাস ও তেলের কারণে ইউরো জোন একটি বড় ধাক্কা মোকাবিলা করছে। বিশ্বজুড়ে পারিবারিক আয় প্রকৃত অর্থে ধসে পড়ছে।
আমেরিকান মন্দা তাদের রপ্তানির চাহিদা কমিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির দুর্বল অংশগুলোতে আরেকটি আঘাত হানবে। ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের কঠোর নীতির কারণে ১৯৯৪ সালের পর ডলারের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এরই মধ্যে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। আইএমএফ বলছে যে প্রায় ৬০ শতাংশ দরিদ্র দেশ ঋণ সংকটে ভুগছে, বা উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।