ইসলামের ইতিহাসে মুসলিমদের বিশ্বমানের নেতৃত্বের উদাহরণ রয়েছে অসংখ্য। মুসলিমরা একসময় সমৃদ্ধ সাম্রাজ্যের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং চিকিৎসা, গণিত, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও আইনশাস্ত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁদের আবিষ্কার ও উদ্ভাবন আধুনিক সমাজের ভিত গড়ে দিয়েছে।
কিন্তু আজকের মুসলিম বিশ্বে আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই নেতৃত্বের অভাব প্রকট। উম্মাহর মধ্যে একটি গুরুতর হীনমন্যতা বাড়ছে। ব্যক্তি হিসেবে আমরা অমুসলিমদের তুলনায় নিজেদের হীন মনে করি, প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা মূলধারার করপোরেশনের তুলনায় নিজেদের দুর্বল ভাবি এবং উম্মাহ হিসেবে আমরা অন্য জাতিগুলোর তুলনায় নিজেরা পিছিয়ে আছি বলে ধারণা করি।
কেন এমন হচ্ছে এবং কী এর সমাধান?
হীনমন্যতা হলো এমন একটি মানসিক অবস্থা, যেখানে ব্যক্তি নিজেকে অপর্যাপ্ত বা অযোগ্য মনে করেন—যুক্তিসংগত বিচারের ভিত্তিতে নয়, বরং আবেগের দ্বারা পরিচালিত হওয়ার কারণে।
হীনমন্যতার প্রভাব
হীনমন্যতা হলো এমন একটি মানসিক অবস্থা, যেখানে ব্যক্তি নিজেকে অপর্যাপ্ত বা অযোগ্য মনে করেন—যুক্তিসংগত বিচারের ভিত্তিতে নয়, বরং আবেগের দ্বারা পরিচালিত হওয়ার কারণে। এর ফলে আমরা অন্যদের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করতে গিয়ে অন্যদের মতো হতে বা তাদের মতো জীবনযাপন করতে আগ্রহী হয়ে উঠি। যেন তৃষ্ণার্ত পথিক, যে মরুভূমিতে মরীচিকার পেছনে ছুটছে, কিন্তু তার গলায় ঝোলানো পানির বোতলের দিকে তাকায় না।ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে, যেখানে মানুষ তাদের ইমানের প্রতি গর্বের পরিবর্তে বাহ্যিক বিষয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ায় হীনমন্যতায় ভুগেছে। যেমন নবী মুসা (আ.) যখন বনি ইসরায়েলকে ফেরাউনের নিপীড়ন থেকে মুক্ত করেন, অথচ তারা লোহিত সাগর পার হওয়ার পর মূর্তি পূজারিদের দেখে বলেছিল, ‘হে মুসা, তাদের যেমন দেবতা আছে, তেমনি আমাদের জন্যও একটি দেবতা তৈরি করো।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ১৩৮)
তারা আল্লাহর ওপর ভরসা ভুলে গিয়ে অন্যদের ধর্ম ও সম্পদের প্রতি হীনমন্যতায় ভুগেছিল। ইবনে কাসিরের তাফসিরে বলা হয়েছে, তারা ভেবেছিল, মূর্তিগুলোই তাদের সাহায্য ও সম্পদ প্রদান করছে।
আধুনিক সময়ে এই হীনমন্যতা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং উম্মাহর মধ্যে বিভিন্নভাবে প্রকাশ পাচ্ছে।
হে মুসা, তাদের যেমন দেবতা আছে, তেমনি আমাদের জন্যও একটি দেবতা তৈরি করো।
সুরা আরাফ, আয়াত: ১৩৮
ব্যক্তিপর্যায়ে হীনমন্যতা
মুসলিম পেশাজীবীদের মধ্যে হীনমন্যতা অনেক সময় প্রকাশ পায় পশ্চিমা পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে। কেউ তার নাম, ত্বকের রং এবং মূল্যবোধের ভিন্নতার কারণে নিজেকে বঞ্চিত বোধ করে। ফলে তারা ভিন্নমত প্রকাশ করতে ভয় পায় এবং নিজের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য অতিরিক্ত চেষ্টা করে।
হাদিসে এসেছে, ‘মুমিনের অবস্থা আশ্চর্যজনক, তার প্রতিটি বিষয়ে কল্যাণ রয়েছে। যদি তার কাছে সুখ বা সমৃদ্ধি আসে, সে কৃতজ্ঞ থাকে, আর তা তার জন্য কল্যাণকর। আর যদি তার ওপর কষ্ট আসে, সে ধৈর্য ধরে, আর তা–ও তার জন্য কল্যাণকর।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৯৯৯)।
অনেক মুসলিম পেশাজীবী ‘সাংস্কৃতিক হীনমন্যতা’ অনুভব করেন, যেখানে তাঁরা নিজেদের ধর্মীয় মূল্যবোধকে পশ্চিমা সংস্কৃতির তুলনায় হীন মনে করেন। এর ফলে তাঁরা নামাজের জন্য সময় চান না, হিজাব বা দাড়ি রাখতে অস্বস্তি বোধ করেন বা অনুপযুক্ত পরিবেশে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব তাঁকে মানসিক চাপ এবং সামাজিক প্রত্যাখ্যানের ভয়ে তটস্থ রাখে।তাঁরা নামাজের জন্য সময় চান না, হিজাব বা দাড়ি রাখতে অস্বস্তি বোধ করেন বা অনুপযুক্ত পরিবেশে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন।
প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে হীনমন্যতা
দেখা যায়, মুসলিম প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু পশ্চিমা কর্পোরেশনের সাফল্যের দিকে তাকায় এবং তাদের পদ্ধতি অনুকরণ করার চেষ্টা করে, হোক তা ইসলামি মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর ফল হয় ভয়াবহ। এতে তারা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে নিম্নমানের পণ্য বা সেবা উৎপাদন শুরু করে এবং অহেতুক কাজকারবারে অর্থ খরচ করে।
মুসলিম প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব সুন্নাহভিত্তিক পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে:
প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সহযোগিতা: প্রতিযোগীদের সঙ্গে পারস্পরিক সুবিধার মানসিকতা গ্রহণ করা।
উদ্দেশ্যনির্ভর কাজ: ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করা এবং ফলাফলের ওপর নির্ভর না করা।
শ্রমিকদের প্রতি ন্যায়বিচার: শ্রমিকদের ঘাম শুকানোর আগে বেতন প্রদান করা। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২৪৪৩)
আধ্যাত্মিক উন্নয়ন: কর্মীদের পেশাগত উন্নয়নের পাশাপাশি আধ্যাত্মিক বিকাশে সহায়তা করা।
নামাজকেন্দ্রিক সময়সূচি: দিন ও সভাগুলো নামাজের সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে সাজানো।
হিজরি ক্যালেন্ডার: ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ও ছুটি হিজরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নির্ধারণ করা।
নৈতিক কর্মপরিবেশ: নারী কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং নৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা।
সেবামূলক উদ্দেশ্য: ব্যবসার উদ্দেশ্যকে কেবল মুনাফার পরিবর্তে সম্প্রদায় ও উম্মাহর সেবার দিকে কেন্দ্রীভূত করা।
ইসলামি মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে ব্যবসা পরিচালনা করলে বরকতপূর্ণ ফলাফল পাওয়া সম্ভব।যে কেউ সম্মান, ক্ষমতা ও গৌরব কামনা করে, তবে (তার মনে রাখা উচিত) সমস্ত সম্মান, ক্ষমতা ও গৌরব আল্লাহর জন্য।
সুরা ফাতির, আয়াত: ১০
উম্মাহ পর্যায়ে হীনমন্যতা
আধুনিক সময়ে মুসলিম উম্মাহ মিডিয়ার নেতিবাচক প্রচারণার মুখোমুখি হচ্ছে, যেমন ‘মুসলিম সন্ত্রাসী’ বা ‘চরমপন্থী’ হিসেবে লেবেলিং। এ ধরনের চাপ আমাদের মধ্যে সংবেদনশীলতা ও প্রতিরক্ষামূলক মনোভাব সৃষ্টি করে, যা হীনমন্যতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে আমরা:
অমুসলিম জীবনধারার অনুকরণ করতে চাই, যদিও তা ইসলামে নিষিদ্ধ।
ধর্মের কিছু দিককে গুরুত্বহীন মনে করি, কারণ তা আমাদের জীবনের লক্ষ্যে বাধা বলে মনে হয়।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপের কারণে বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের দুর্ভোগের পক্ষে দাঁড়াতে ব্যর্থ হই।
ইসলামি নীতিগুলোকে উদারনৈতিক বা ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করি।
কোনো কোনো ইসলামি অনুশীলনকে ‘সেকেলে’ বা ‘অপ্রাসঙ্গিক’ মনে করি।
ইসলামি অনুশীলনকে তখনই গুরুত্ব দিই, যখন পশ্চিমা বিজ্ঞান বা একাডেমিক সম্প্রদায় তা বৈধতা দেয়।
এই হীনমন্যতা প্রায়ই অবচেতনে কাজ করে। তাই আমাদের উচিত সচেতনভাবে আমাদের উদ্দেশ্য, পছন্দ ও কাজ পর্যালোচনা করা।
মুসলিম উম্মাহ মিডিয়ার নেতিবাচক প্রচারণার মুখোমুখি হচ্ছে, যেমন ‘মুসলিম সন্ত্রাসী’ বা ‘চরমপন্থী’ হিসেবে লেবেলিং। এ ধরনের চাপ আমাদের মধ্যেহীনমন্যতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে সমাধান
ইসলাম হীনমন্যতার সমাধান হিসেবে আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা ও আধ্যাত্মিক সচেতনতার ওপর জোর দেয়। এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো বিবেচনা করা যায়:
১. আল্লাহর ওপর ভরসা ও তাঁর প্রতি সমর্পণ: পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যে কেউ সম্মান, ক্ষমতা ও গৌরব কামনা করে, তবে (তার মনে রাখা উচিত) সমস্ত সম্মান, ক্ষমতা ও গৌরব আল্লাহর জন্য।’ (সুরা ফাতির, আয়াত: ১০)
সুতরাং আল্লাহর আনুগত্যের মধ্য দিয়েই একজন মুমিন এই দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মান ও গৌরব অর্জন করতে পারেন। এই বোধ জেগে উঠলে অন্য সংস্কৃতির প্রতি হীনমন্যতা থেকে এবং দুনিয়াবি লোভ থেকে মুক্ত হয়ে হৃদয় শান্তিতে ভরে উঠবে।
২. মুসলিম পরিচয়ে গর্ব: আমরা আদম (আ.)-এর সন্তান এবং রাসুল (সা.)-এর উম্মত। নবী, সাহাবি ও পূর্বসূরিদের ত্যাগের কারণে আজ মুসলিম হিসেবে আমরা নিজেদের পরিচয় দিতে পারি। এই পরিচয় যেকোনো পরিবেশে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ধরে রাখতে হবে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা দুর্বল হয়ো না, দুঃখ করো না, তোমরা বিজয়ী হবে যদি তোমরা প্রকৃত মুমিন হও।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৯)৩. মুহাসাবাহ (আত্মমূল্যায়ন): নিয়মিত আত্মমূল্যায়ন আমাদের ‘ফিতরা’র সঙ্গে সংযুক্ত রাখে এবং আল্লাহকেন্দ্রিক আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
৪. আল্লাহর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা: হাদিসে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদের চেহারা বা সম্পদের দিকে তাকান না, বরং তিনি তোমাদের হৃদয় ও আমলের দিকে তাকান।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৬৪)
যখন আমরা আল্লাহর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখি, তখন অন্যদের ভয় বা তুলনার প্রবৃত্তি দূর হবে।
সারকথা
হীনমন্যতা মুসলিম ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং উম্মাহর জন্য একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ, যা আমাদের আধ্যাত্মিক ও দুনিয়াবি সম্ভাবনাকে সীমিত করে দেয়।
পোস্টকলোনিয়াল মানসিকতা, মিডিয়ার নেতিবাচক প্রচারণা এবং শয়তানের প্রভাব এই হীনমন্যতাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে বটে, কিন্তু ইসলাম এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য একটি পরিষ্কার পথরেখাও দেখিয়ে দিয়েছে যে—আল্লাহর ওপর ভরসা, মুসলিম পরিচয়ে গর্ব, আত্মমূল্যায়ন এবং আধ্যাত্মিক সচেতনতাই হতে পারে আমাদের নিয়ামক।
আমরা যদি আমাদের জীবন ও কাজকে ইসলামি মূল্যবোধের সঙ্গে সংযুক্ত করি, তবে আমরা হীনমন্যতা থেকে মুক্ত হয়ে এমন একটি উম্মাহ গড়ে তুলতে পারব, যা আল্লাহর প্রতিশ্রুত বিজয় এনে দেবে আমাদের।
প্রোডাক্টিভ মুসলিম ডটকম অবলম্বনে