রোদেলা একদিন। মদিনার মসজিদ থেকে নবীজি (সা.) বের হলেন। সঙ্গে সাহাবি আবু হুরায়রা (রা)। স্বাভাবিক গাম্ভীর্য ছেয়ে আছে তাঁর বদন মোবারকে। তিনি হেঁটে হেঁটে বনু কায়নুকার বাজারে গেলেন। পথে কোনো কথা বললেন না, সঙ্গী আবু হুরায়রাও একদম চুপচাপ। বাজার থেকে সোজা ছুটে গেলেন প্রিয়তম কন্যা ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদের (রা.) ঘরে। কাছে যেতেই তাঁর চোখমুখ রঙিন হয়ে উঠল। তিনি ডাক দিলেন, ‘খোকা আছে এখানে? খোকা কোথায়?’
ভেতর থেকে ফাতেমা (রা.) একটু অপেক্ষা করতে বললেন। সাততাড়াতাড়ি আদরের সন্তান হাসানকে ধুয়েমুছে, তারপর পুঁতির মালা দিয়ে সাজিয়ে দিলেন। একটু বাদেই প্রিয়তম নাতি হাসান দৌড়ে এসে নানাজানকে জড়িয়ে ধরলেন।
নবীজি (সা.) তখন তাঁকে আদর করতে করতে এই দোয়া করলেন, ‘আল্লাহ, আমি তাকে মহব্বত করি, তুমিও তাকে মহব্বত কোরো। আর তাকে যে মহব্বত করবে, সেই লোককেও তুমি মহব্বত কোরো।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৬,১৫১)
নবীজি (সা.) এমনিতেই ছিলেন দয়ার সাগর। ছোট-বড় সবাইকে এমনভাবে সম্বোধন করতেন যেন সবার চেয়ে তাকে বেশি মহব্বত করেন। তবু হাসান ও হোসাইনের (রা.) প্রশ্ন ছিল আলাদা। এই দুজন ছিলেন তাঁর হৃদয়ের কাছে।
একবার নবীজি (সা.) হাসানকে (রা.) ভালোবেসে চুমু খেলেন। সেখানে সাহাবি আকরা ইবনে হাবেস আত তামিমি (রা.) উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার ১০ জন সন্তান আছে; আমি তাদের কাউকে কখনো চুমু খাইনি।’ নবীজি তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যে দয়া করে না, তার প্রতিও দয়া করা হয় না।’ (রিয়াদুস সালেহিন, হাদিস: ২২৫)
এ কথা বলে নবীজি বোঝালেন শিশুকালে বাচ্চাদের আদর করা মোটেও মন্দ কিছু নয়। শিশুদের মায়া করলে তারাও এর প্রতিদান দেয়।
নবীজি প্রায় হাসান ও হোসাইনকে কাঁধে নিয়ে ঘুরতেন। বলতেন, ‘তারা আমার এই দুনিয়ার দুই ফুল।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩,৭৫৩)
নবীজি (সা.) তাঁদের কাছছাড়া করতে চাইতেন না। এমনকি যখন মসজিদে যেতেন, তাঁদের সঙ্গে নিয়ে যেতেন। আবু বকর (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলকে মিম্বরে দেখেছি, আর তখন তার পাশে হাসান বসেছিলেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৭০৪)
অনেকবার এমন হয়েছে—নবীজি নামাজ পড়ছেন, অন্যদিকে হাসান ও হোসাইন তাঁর কাঁধে চড়ে বসেছেন। তিনি কিছুই বলেননি। (তাখরিজুল মুসনাদ লি-শুয়াইব, হাদিস ২০,৫১৬)
একদিন এশার নামাজের সময় নবীজি (সা.) হাসান বা হোসাইনকে (রা.) কোলে নিয়ে মসজিদে আসেন। তারপর তাঁকে এক পাশে বসিয়ে নামাজের জন্য এগিয়ে গেলেন। তিনি যখন সিজদায় যান, দীর্ঘসময় অপেক্ষা করেন। সাহাবি শাদ্দাদ (রা.) বলেন, ‘সিজদায় দেরি হচ্ছে বলে আমি মাথা উঠিয়ে দেখি, নবীজি সেজদারত আর শিশুটি তার পিঠের ওপর বসে আছে। (এই দৃশ্য দেখে) আমি আবার সিজদায় চলে গেলাম।’
নবীজি নামাজ শেষ করলে সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আল্লাহর রাসুল, আজকে আপনি নামাজের মধ্যে একটি সিজদা এত লম্বা করেছেন, আমাদের মনে হচ্ছিল হয়তো কোনো ভিন্ন ব্যাপার ঘটছে অথবা আপনার ওপর ওহি নাজিল হচ্ছে।’ তিনি বললেন, ‘এর কোনোটাই ঘটেনি; বরং আমার নাতি আমাকে সওয়ারি (ঘোড়া) বানিয়েছে। সে যেন তার কাজ করতে পারে, তাই আমি তাড়াতাড়ি উঠিনি।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস: ১,১৪১)
আরেক দিন উমর (রা.) দেখলেন, হাসান ও হোসাইন দুজনেই নবীজির কাঁধে উঠে বসে আছেন। তিনি রসিকতা করে বললেন, ‘তোমরা কত উত্তম সওয়ারি (বাহন) পেয়েছ।’ এ কথা শুনে নবীজি বলেন, ‘এটাও তো দেখবে, আরোহীরাও কত উত্তম!’ (মুসনাদে বাজ্জার, ১/৪১৮ ও মাজমাউজ জাওয়ায়েদ, ৯/১৮১)
এক হাদিসে আছে, ‘হাসান ও হোসাইন (রা.) জান্নাতি যুবকদের সরদার।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস: ৩,৭৬৮)
এ মর্যাদা নবীজির (সা.) নাতি হিসেবে নয়; বরং তাঁরা আসলেই তার প্রাপ্য ছিলেন। পরিণত বয়সে তাঁরা দুজনেই আলেম ও নেতা হিসেবে নিজেদের যোগ্য প্রমাণিত করেন। হজরত হাসান (রা) মুসলমানদের মধ্যে ‘প্রথম ফেতনা’ খতম করার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন। হজরত হোসাইন (রা) সত্য রক্ষার প্রশ্নে আপসহীন হয়ে কারবালার ময়দানে শাহাদাতবরণ করেন।
তাঁদের প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসা রাখা আমাদের দায়িত্ব। কারণ, নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে এই দুজনকে মহব্বত করল, সে (মূলত) আমাকে মহব্বত করল। আর যে তাদের প্রতি দুশমনি করল, সে আমার প্রতি দুশমনি করল।’ (আস সিলসিলাতুস সহিহাহ, আলবানি, হাদিস: ২,৮৯৫)
কারবালা, আশুরা এবং সাহাবিদের দ্বিমত থেকে শিক্ষা