ইসলামি আইনে ‘হালাল’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যা শুধু খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, বরং জীবনের প্রায় সব দিকেই প্রযোজ্য। ইসলামে হালাল বলতে এমন কাজ বা বস্তু বোঝায় যা শরিয়াহ বা ইসলামি আইন দ্বারা অনুমোদিত।
এর বিপরীতে ‘হারাম’ বলতে এমন কাজ বা বস্তুকে বোঝায় যা কোরআন ও হাদিসে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমরা হালাল ও হারাম ধারণার উৎপত্তি, খাদ্যাভ্যাসে এর প্রয়োগ, জবাইয়ের পদ্ধতি এবং আধুনিক সমাজে হালাল খাদ্যের তাৎপর্য আলোচনা করব।
হালাল ও হারাম ধারণার উৎপত্তি
‘হালাল’ ও ‘হারাম’ শব্দ দুটি প্রাক-ইসলামি আরব সমাজে বিদ্যমান ছিল। ‘হালাল’ শব্দটি ‘পরিচ্ছন্ন’ বা ‘অনুমোদিত’ এবং ‘হারাম’ শব্দটি ‘নিষিদ্ধ’ বা ‘অপবিত্র’ বোঝাত। এই শব্দগুলো পরে ইসলামি আইনে (শরিয়াহ) সুনির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহৃত হয়।
কোরআনে খাদ্যের ক্ষেত্রে হালাল ও হারামের বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, মৃত প্রাণী, প্রবাহিত রক্ত, শুকরের মাংস, এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর নামে উৎসর্গ করা খাদ্য হারাম। (সুরা আনআম, আয়াত: ১৪৫-১৪৬)
তোমরা পবিত্র বস্তু হতে আহার কর এবং সৎকর্ম কর। তোমরা যা কর সে বিষয়ে আমি অবহিত।
সুরা মুমিনুন, আয়াত: ৫১
এ ছাড়া মহানবী (সা.)-এর বাণী ও কার্যকলাপের সংকলনও হালাল ও হারামের অন্যতম উৎস। এবং ইসলামের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে নতুন সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাসের সম্মুখীন হওয়ায় আলেমগণ ‘কিয়াস’ ও ‘ইজমা’ ব্যবহার করে হালাল ও হারামের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
এই পদ্ধতিগুলো উসুল আল-ফিকহ বা ইসলামি ফিকহের ভিত্তি হিসেবে পরিচিত।হালাল খাদ্যের বিধান
ইসলামি আইনে খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রে কিছু সর্বজনীন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। শুকরের মাংস, মৃত প্রাণী, রক্ত এবং এমন প্রাণী যা রক্তপাতের মাধ্যমে জবাই করা হয়নি, তা সর্বজনীনভাবে হারাম। এছাড়া মদও পান করা হারাম। তবে চিকিৎসা বা অন্যান্য জরুরি প্রয়োজনে মাত্রাভেদে অ্যালকোহল ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে।
এই সর্বজনীন নিষেধাজ্ঞার বাইরে, বিভিন্ন মাযহাবের মধ্যে হালাল খাদ্য নিয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। বেশিরভাগ ফকিহ শিকারী পাখি, যারা তাদের নখর দিয়ে শিকার ধরে, তাদের খাওয়া হারাম বলে গণ্য করেন। ঘোড়ার মাংস হালাল হলেও এটি মাকরূহ (অপছন্দনীয়) বলে বিবেচিত, কারণ কোরআনে ঘোড়ার উদ্দেশ্য পরিবহন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। (সুরা নাহ্ল, আয়াত: ৮)
অনেক ফকিহ কিয়াসের মাধ্যমে তামাক হারাম বলে গণ্য করেন।
জবাইকারীকে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে (বিসমিল্লাহ) একটি দ্রুত ছুরিকাঘাতে প্রাণীর গলার ক্যারোটিড ধমনী, শ্বাসনালী ও জুগুলার এই তিন শিরা কেটে দিতে হয়।
জবাই পদ্ধতি
ইসলামি আইনে প্রাণী জবাইয়ের পদ্ধতি হলো, জবাইকারীকে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে (বিসমিল্লাহ) একটি দ্রুত ছুরিকাঘাতে প্রাণীর গলার ক্যারোটিড ধমনী, শ্বাসনালী ও জুগুলার এই তিন শিরা কেটে দিতে হয়, যাতে প্রাণী দ্রুত অচেতন হয় এবং যন্ত্রণা কম অনুভব করে। প্রাণীটিকে ভয় না দেওয়া এবং অন্য প্রাণীদের সামনে জবাই না করার বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়, কারণ এটি তাদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে।হালালের শ্রেণিবিন্যাস
ইসলামি আইনে হালাল কাজ ও বস্তুকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়:
ফরজ বা ওয়াজিব (বাধ্যতামূলক)
মানদূব (প্রশংসনীয় কিন্তু বাধ্যতামূলক নয়)
মুবাহ (গ্রহণযোগ্য)।
মাকরূহ বলতে এমন কাজ বা বস্তুকে বোঝায় যা হারাম নয়, তবে এড়িয়ে চলা উচিত।
হালালের তাৎপর্য
হালাল খাদ্যাভ্যাস মুসলিমদের ধর্মীয় পরিচয় ও আধ্যাত্মিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি কেবল খাদ্যের বিষয় নয়, বরং ইসলামি জীবনধারার একটি প্রতিফলন। হালাল পদ্ধতি প্রাণীদের প্রতি মানবিক আচরণের ওপর জোর দেয়, যা আধুনিক পশু কল্যাণ আন্দোলনের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
তার খাদ্য হারাম, তার পোশাক হারাম, তার পানীয় হারাম এবং হারাম উপার্জনের জীবিকাতেই তার রক্তমাংস গড়ে উঠেছে। তার দোয়া কীভাবে কবুল হবে?”
মুসলিম, হাদিস: ১০১৫
তবে তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, খাদ্য হালাল না হলে আমাদের কোনো সৎকর্ম আল্লাহর কাছে কবুল হবে না। আল্লাহ বলেন, “হে রাসুলগণ, তোমরা পবিত্র বস্তু হতে আহার কর এবং সৎকর্ম কর। তোমরা যা কর সে বিষয়ে আমি অবহিত।” (সুরা মুমিনুন, আয়াত: ৫১)
আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হে মানুষেরা, নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র ছাড়া কোনো কিছুই কবুল করেন না। আল্লাহ মুমিনগণকে সে নির্দেশ দিয়েছেন যে নির্দেশ তিনি রাসুলগণকে দিয়েছেন …(পবিত্র খাদ্য খাওয়ার)… এরপর তিনি একজন মানুষের কথা উল্লেখ করেন, যে ব্যক্তি (আল্লাহর পথে) দীর্ঘ সফরে থাকে, ধূলি–ধূসরিত দেহ ও এলোমেলো চুল, তার হাত দু’টি আকাশের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে দোয়া করতে থাকে, হে আমার প্রতিপালক, হে আমার রব! কিন্তু তার খাদ্য হারাম, তার পোশাক হারাম, তার পানীয় হারাম এবং হারাম উপার্জনের জীবিকাতেই তার রক্তমাংস গড়ে উঠেছে। তার দোয়া কীভাবে কবুল হবে?” (মুসলিম, হাদিস: ১০১৫)