ইসলামি জ্ঞানচর্চার ধারায় পবিত্র কোরআনের পর দ্বিতীয় এবং অপরিহার্য উৎস হলো হাদিস। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বাণী, কর্ম এবং তাঁর সম্মতিসূচক অনুমোদন—এই তিনের সমন্বিত রূপই হাদিসশাস্ত্রের মূল উপজীব্য। এটি কেবল কিছু নৈতিক নির্দেশনার সংকলন নয়, বরং ইসলামি ধর্মতত্ত্ব, বিধানশাস্ত্র এবং আধ্যাত্মিকতার এক মৌলিক ভিত্তি।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলিম জ্ঞানসাধকগণ এই শাস্ত্রের সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ এবং এর গভীর থেকে জ্ঞান আহরণে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। এই জ্ঞানচর্চার ধারাটি একরৈখিক নয়, বরং এর একটি সুবিন্যস্ত জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিকাঠামো রয়েছে।
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রহ.) তাঁর সুপরিচিত গ্রন্থ ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’-তে হাদিসচর্চার যে পদ্ধতিগত স্তরবিন্যাস উপস্থাপন করেছেন, তা এই শাস্ত্রের গভীরতা অনুধাবনের জন্য একটি আদর্শ কাঠামো হিসেবে গণ্য হয়।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রহ.) হাদিসশাস্ত্রের চর্চাকে চারটি প্রধান জ্ঞানতাত্ত্বিক স্তরে বিভক্ত করেছেন, যা এই শাস্ত্রের সামগ্রিক অবয়বকে বুঝতে সহায়তা করে।
হাদিসের তাত্ত্বিক ভিত্তি ও অপরিহার্যতা
হাদিসের প্রামাণ্যতার ভিত্তি ইসলামি ধর্মতত্ত্বের মূল কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য অংশ। পবিত্র কোরআন স্বয়ং রাসুল (সা.)-এর আনুগত্যকে স্রষ্টার প্রতি আনুগত্যের সমতুল্য এবং তাঁর প্রদত্ত নির্দেশনাকে চূড়ান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। উদাহরণস্বরূপ, সুরা নিসা-এর ৮০ নং আয়াতে সুস্পষ্ট বলা হয়েছে: ‘যে ব্যক্তি রাসুলের আনুগত্য করে, সে বস্তুত আল্লাহরই আনুগত্য করল।’
একই সুরার ৬৪ নং আয়াতে এই বিষয়টি আরও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বিবৃত হয়েছে, ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকে এই উদ্দেশ্যেই প্রেরণ করেছি যে আল্লাহর নির্দেশে তাঁর আনুগত্য করা হবে।’
এই আয়াতসমূহ থেকে এটি প্রমাণিত হয় যে রাসুল (সা.)-এর ভূমিকা কেবল একজন বার্তা পৌঁছে দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তাঁর প্রতিটি নির্দেশ ও কর্ম স্রষ্টার অনুমোদনেরই অন্তর্ভুক্ত এবং তা সব বিশ্বাসীর জন্য অবশ্য অনুসরণীয় বিধান।
এককথায়, কোরআন যদি ইসলামি জীবনব্যবস্থার মৌলনীতি ও মূল সংবিধান হয়, তবে হাদিস হলো তার বিশদ ব্যাখ্যা ও প্রায়োগিক রূপায়ণ। এই দুটি উৎসের সমন্বয়ের মাধ্যমেই ইসলামি জ্ঞানকাঠামো পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে।