হাতিরপুলের নীচে ছিল একটি রেললাইন। তৎকালীন বৃটিশ সরকারের শেষ সময়ে ঐ স্থানে রেললাইন তৈরি করা হয়। এই পুল দিয়ে একসময় হাতি পারাপার হতো। হাতিদেরকে রেললাইনের উপরের পুল দিয়ে পিলখানা থেকে হাতিরঝিলে নিয়ে যাওয়া হতো গোসল করাতে। নুড়ি পাথর আর স্লিপারের কারণে রেললাইনের উপর দিয়ে হাতিরা হাঁটতে পারতো না। তাই তারা যেতো তৈরিকৃত উপরের পুল দিয়ে। আর সেই থেকেই এটির নাম হলো হাতিরপুল।
বর্তমানের গাউছিয়া মার্কেটের পাশ দিয়ে বাটা সিগনাল ক্রস হয়ে হাতিরপুল দিয়ে পরিবাগ হয়ে রমনা থানার পাশ দিয়ে মগবাজার ওয়্যারলেস মোড় পেরিয়ে মধুবাগের দিকে যে রাস্তাটি গেছে – এই পুরো রাস্তাটির নাম ছিল এলিফ্যান্ট রোড, এই পুরাতন রাস্তার পাশে এখনো একটি পুরাতন মসজিদ রয়েছে যার বর্তমান নাম রমনা থানা মসজিদ, ব্রিটিশ লাইব্রেরীর পুরাতন ছবিতে এই মসজিদটির দেখা মিলে, ইতিহাস থেকে আরও জানা যায় আজকের জনবহুল এলিফ্যান্ট রোড এলাকাটি ১৮০০ সালে ছিলো বিশাল আকৃতির গাছ-গাছালিতে ঘেরা ছোটখাট বনাঞ্চল। পরবর্তীতে গাছ-পালা কেটে হাতি চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরি করা হয়। এই এলিফ্যান্ট রোড দিয়েই শত শত হাতির পাল চড়িয়ে বেড়াতেন মাহুতরা। পরবর্তীতে সায়েন্স ল্যাব থেকে শাহবাগ পর্যন্ত ‘নিউ এলিফেন্ট রোড’ নামের আড়ালে আদি এলিফেন্ট রোডের পরিচয়টি হারিয়ে গেছে।
বর্তমানে এলাকাটি হাতিরপুল নামেই পরিচিতি লাভ করে। তখন মানুষেরা এই পুল, হাতি আর ট্রেন দেখতে এখানে আসতো। পুলের নিচে এর নীচে কাছাকাছি অবস্থানে ছোট ছোট কয়েকটি খাবারের হোটেল ছিল। আর ছিলো ছোট্ট একটি বাজার। বাজার বলতে তখন রেল লাইনের উপর কয়েকটা অস্থায়ী দোকান। পঞ্চাশ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে সেখানে বসতি গড়ে উঠতে শুরু করে। হাতিরপুল বাজার তখনও হয়নি। নূতন বাসিন্দারা নিজেদের প্রয়োজনে পুঁজি বিনিয়োগ করে কিছু লোককে এখানে বেচাকেনা করতে বলেন, সেখান থেকেই এ বাজারের গোড়াপত্তন। ১৯৬৯ থেকে ৭৪ পর্যন্ত পুলে ওঠার জন্য টাকা দিয়ে রিকশা ঠেলে দেয়ার জন্য লোক পাওয়া যেতো। এই পুল পারাপারের জন্য যে সব ছোট ছোট ছেলেরা ছিলো, তাদেরকে প্রতিবার পারাপারের জন্য দিতে হতো ২ থেকে ৩ আনা। এরা ৪/৫ জনে দলবেঁধে রিকশা ঠেলতো। এভাবে রিকশায় চেপে পুল পার হওয়া যেতো। এই পথেই ছিলো শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীদের পৈতৃক বাড়িটা। হালকা হলুদ রঙের বাংলো প্যাটার্নের বাড়িটির নাম ছিল ‘দারুল আফিয়া’। হাতিরপুল পার হয়ে যাতায়াত করতে হতো দারুল আফিয়ায়, শহীদ মুনীর চৌধুরীর বাড়িতে। ১৯৭১ সালে সেখান থেকেই তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল রাজাকাররা।
তৎকালীন রমনা এলাকার চারপাশে বেশ কিছু খাল ছিল। যেগুলো এখন মানচিত্র আর কাগজে-কলমে আছে, বাস্তবে নেই। হাতিগুলোকে নেওয়ার জন্য খালের উপর নির্মিত হয়েছিলো সেতু। এক সময় বর্তমানের প্রায় সীমান্ত স্কয়ার থেকে হাতিরঝিল হয়ে একদিকে গুলশান পর্যন্ত অন্যদিকে ডেমরা পর্যন্ত নৌ চলাচল পথ ছিল। এক সময় হাতিরপুল ভেঙ্গে নীচের লাইন বরাবর যে রাস্তাটি নির্মাণ করা হয় সেই রাস্তার নাম রাখা হয়েছিলো পেনিট্রেটর রোড। কেন এমন একটা অদ্ভুত নাম রাখা হয়েছিল, আর কীভাবেই বা এলাকাটা হাতিরপুল বাজার হয়ে গেল জানা যায়নি। এখন যেখানে মোতালেব প্লাজা টাওয়ার গড়ে উঠেছে, সেখানে ছিল একটি সুইপার কলোনি। নাম ছিল ‘মোতালেব কলোনি’। মোতালেব কলোনির মধ্যে পাঁচটি দোতলা বাড়ি ছিল। কাঁঠালবাগানের ঢালে পরিত্যক্ত রেললাইন ছিল।
ওপাশে ছিল পরীবাগ মসজিদ, ছিল পাওয়ার হাউসটাও। সেসময় হাতিরপুল সংলগ্ন পরিবাগ এলাকায় অনেক গাছগাছালি ও খাল ছিলো। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরা না-কি এই পুলের উপর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে গুলিবর্ষণ করেছিল। হাতিরপুলটি ছিল খাড়া এবং উঁচু যার ফলে দুর্ঘটনা লেগেই থাকতো।
১৯৭০ এর দশকে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় একটি সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল এই হাতিরপুল ভাঙা নিয়ে। রিপোর্টে উল্লেখ করা আছে, ৫০ বছরের পুরোনো এই পুলটি ভাঙা হবে নগরে নতুন রাস্তা তৈরি করার জন্য। পৌরসভা এই পুল ভাঙ্গার কাজটি করছে। নতুন রাস্তা তৈরির জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে দেড় লক্ষ টাকা। ফুলবাড়িয়া-তেজগাঁও রেললাইনের উপর দিয়ে পরিবাগ ও ধানমন্ডি এলাকার মধ্যে যান চলাচলের সহজ উপায় ছিলো এই হাতিরপুল বা রেলওয়ে ওভার ব্রিজটি। নগর সংস্কারের জোয়ারে ও আকাশচুম্বি অট্টালিকা তৈরির জন্য এই পুলটি ভাঙ্গা হচ্ছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছিলো, ‘যদিও এই পুলটি ঐতিহাসিক এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ছিলো, কিন্তু সেসময়ের নগর পরিকল্পনাবিদরা বলেছিলেন রেলওয়ে স্টেশন কমলাপুরে সরিয়ে নেয়ার পর এই পুলের আর দরকার নাই।’
১৯৬০ দশকে হাতিরপুল ব্রিজের নীচে রেলগাড়ি চলাচল করতো, ১৯৬৯ এ ব্রিজটি ভেংগে ফেলা হয় নগর সম্প্রসারন এর প্রয়োজনে, ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন সরিয়ে কমলাপুর রেলস্টেশন এ স্থানান্তরিত করা হয়।
এক সময় এ স্থান দিয়ে হাতি পারাপার হতো। পুলের নীচে ছিল একটি রেললাইন। হাতিরা রেললাইনের উপরের পুল দিয়ে পিলখানা থেকে হাতিরঝিলে যেতো গোসল করতে। নুড়ি পাথর ও রেললাইনের উপর দিয়ে হাতিরা নাকি হাঁটতে পারতোনা পায়ের নীচের নরম মাংশের কারণে। তাই তারা যেতো উপর দিয়ে। আর সেই থেকেই এর নাম হলো হাতিরপুল।
ইতিহাসে আছে একসময় মোঘল ও ইংরেজ আমলে ঢাকায় অনেক হাতি ছিল।
যে রাস্তা দিয়ে নেয়া হতো সেটাই আজকের এলিফ্যান্ট রোড। রমনার চারপাশে বেশ কিছু খাল ছিল। হাতিগুলোকে নেওয়ার জন্য খালের উপর নির্মিত হয় সেতু। পিলখানা থেকে বর্তমান হাতিরপুল এলাকায় হাতি চলাচলের জন্য বর্তমানের ইস্টার্ন প্লাজা ও পরিবাগ বরাবর যে সেতু বা পাকা পুল নির্মাণ করা হয়েছিল হাতি পারাপারের জন্য, যা পরবর্তীতে হাতিরপুল নামে পরিচিতি লাভ করে।
সূত্র : দৈনিক অবজারভার, চিত্র: ছবিটি ১৯৬০ দশকের শেষের দিকে, পত্রিকার শিরোনাম ছিল- [ “A Dacca-bound train stops under the Hatir Pool Ele-phant Road bridge at 6 a.m. en Sept. 20-OBSERVER”]
হাতিরপুলের নীচে ছিল একটি রেললাইন
আজনিউজ২৪ :
0 Views