গত ২০ মে থেকে বাংলাদেশে স্টারলিংক ইন্টারনেট সংযোগের জন্য অর্ডার গ্রহণ শুরু করে স্পেসএক্সের স্টারলিংক। দ্রুতগতির স্যাটেলাইটনির্ভর ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পাওয়ায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ আগ্রহের সঙ্গে সংযোগ অর্ডার করছেন। বেশ কয়েকজন স্টারলিংক ব্যবহারকারী ও অর্ডার দিয়েছেন এমন ব্যক্তিরা তাঁদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। কেউ কেউ দ্রুত সংযোগ পেয়ে উচ্ছ্বসিত, আবার অনেকেই বিমানবন্দরের শুল্কসংক্রান্ত জটিলতার কারণে দেরিতে সংযোগ পাচ্ছেন।
দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা মিলছে ঢাকার বাইরে
অনেক ব্যবহারকারী বিদ্যমান ইন্টারনেট সেবার গতি, স্থিতিশীলতা ও গ্রাহকসেবায় অসন্তুষ্ট হয়ে স্টারলিংক অর্ডার করেছেন। ফ্রিল্যান্সার, কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও রিমোট ওয়ার্কাররা স্টারলিংককে একটি নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসেবে দেখছেন।
মালয়েশিয়ার একটি পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানের টেক লিড সোহাগ হাসান। তিনি বলেন, ‘আমি ঢাকার কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থাকি। এখানে দ্রুতগতির ইন্টারনেট নেই। যেহেতু মালয়েশিয়ার মোবিপে নামের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টেক লিড হিসেবে কাজ করছি, তাই আমার গতিশীল ইন্টারনেট প্রয়োজন হয়। এ জন্য আমি স্টারলিংক ইন্টারনেট সেবা অর্ডার করেছি। অর্ডার করার ১০ দিনের মধ্যেই আমার কাছে চলে আসে ইন্টারনেট সংযোগের যন্ত্রপাতি। ঢাকার বিমানবন্দর থেকে ডিএইচএলের মাধ্যমে স্টারলিংক ইন্টারনেটের যন্ত্রপাতি সব পাই আমি। আমি নিচতলা থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করি, যেখানে স্টারলিংকের রিসিভার অ্যানটেনা দোতলার ছাদের ওপরে লাগিয়েছি। ৩০ মে থেকে আমি ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করছি। আমার এলাকায় গড় গতি পাই ২৫০-৩০০ মেগাবিট। প্রথমবার চালুর পর ৬-৭ ঘণ্টা লাগে স্টারলিংকের ক্যালিব্রেশনের জন্য। রিসিভার বসানোর সময় বেশ বড় খোলা জায়গা রাখতে হয়, নতুবা ইন্টারনেট সংযোগ দুর্বল থাকে।’
যেভাবে আসছে স্টারলিংক ইন্টারনেট যন্ত্রপাতি
সোহাগ হাসান বলেন, ‘আমি স্টারলিংক প্রি-বুক করেছিলাম ১৮ আগস্ট ২০২৩, দুপুর ১২টা ৪৪ মিনিটে। অর্ডার কনফার্ম করার নোটিফিকেশন পাই ২০২৫ সালের ২০ মে ২০২৫, সকাল ৬টা ২৩ মিনিটে। টাকা দিয়ে অর্ডার কনফার্ম করি ২০ মে সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে। অর্ডার প্রসেসড হয় ২০ মে রাত ৭টা ৯ মিনিটে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে শিপমেন্ট ছাড়া হয় ২১ মে ভোর ৪টা ৪৫ মিনিটে। ঢাকা পৌঁছায় ২৪ মে সকাল ৯টা ১৭ মিনিটে। কাস্টমস পার হয় ২৯ মে বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটে। ডিএইচএল ঢাকা অফিস থেকে কিট সংগ্রহ করি ৩০ মে দুপুর ২টা ১৭ মিনিটে। আমার স্টারলিংক আসার রুট ছিল: অস্টিন, টেক্সাস থেকে সিনসিনাটি হাব, ওহাইও, যুক্তরাষ্ট্র। তারপর জার্মানির লিপজিগ থেকে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক হয়ে ঢাকায়। পুরো সরবরাহপ্রক্রিয়া সামগ্রিকভাবে ভালো। স্টারলিংক ও ডিএইচএল থেকে ই–মেইলে আপডেট পাচ্ছিলাম। ডিএইচএল কাস্টমার কেয়ারে অনেকবার ফোন করে অনেক তথ্য নিয়েছিলাম।’
সোহাগ আরও বলেন, ‘আমি স্টারলিংক দ্বিতীয় তলার ছাদে বসিয়েছি, প্রায় ২২ ফুট ওপরে। ইচ্ছা করেই ছাদের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় বসাই না। বজ্রপাত থেকে বাঁচার জন্য। ড্রিল মেশিন ছিল না, তাই স্থানীয় ইলেকট্রিশিয়ানকে দিয়ে ছাদের পাশে দুইটা ছিদ্র করাই। নিজ হাতে চতুর্ভুজাকৃতির ডিশ বসাই। ইনস্টল করার আগে ইউটিউব আর স্টারলিংকের অফিশিয়াল গাইড দেখে নিয়েছিলাম। বসানোর পর তার টানিয়ে ঘরে রাউটার সংযুক্ত করি। বেসিক এসএসআইডি বা ওয়াই–ফাই নাম আর পাসওয়ার্ড সেট করলেই ইন্টারনেট চালু করে ফেলি। ডিশ যদি সোজা না থাকে, স্টারলিংক অ্যাপে নোটিফিকেশন দেয় কোন দিকে সরাতে হবে। ইনস্টলেশনের জন্য স্টারলিংক অ্যাপ নামাতে হবে। অ্যাপ থেকেই সব কাজ করা যায়। ইন্টারনেট চালু করার সাথে সাথে প্রথম মাসের বিল কেটে নেবে কার্ড থেকে। আমার প্যাকেজ ছিল রেসিডেনশিয়াল, মাসিক ৬ হাজার টাকা। এখন পর্যন্ত কয়েক দিন ব্যবহার করেছি। স্পিড এককথায় দারুণ! ভিডিও কনফারেন্স কয়েকটা করেছি—একটুও ল্যাগ-বাফার নাই। সর্বোচ্চ ডাউনলোড পেয়েছি ৪৫০ মেগাবিট, আপলোড ৪৫ মেগাবিট। লেটেন্সি গড়ে ৮০ এমএস, সিঙ্গাপুর সার্ভারে।’
বান্দরবান-কক্সবাজারে স্টারলিংক
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে ফাইবার অপটিক বা টাওয়ার-নির্ভর ইন্টারনেট অবকাঠামো পৌঁছায়নি, সেখানেও স্টারলিংক ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। প্রযুক্তিবিদ থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ফ্রিল্যান্সাররা স্টারলিংকের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ পাচ্ছেন। একটি বহুজাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মঈনুল কবীর জানান, ‘আমাদের কাজের জন্য দ্রুত এবং স্থিতিশীল ইন্টারনেট অপরিহার্য। প্রায়ই আমাদের ইন্টারনেটের গতি কমে যায় বা সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়, যা আমাদের কাজের ক্ষতি করে। স্টারলিংক এই সমস্যার সমাধান দিচ্ছে। আমাদের একটি প্রকল্পের জন্য আমরা ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর স্টারলিংক প্রি–বুক করি। এরপর মে মাসে হাতে এসে পৌঁছায় স্টারলিংক ইন্টারনেট। আমরা কাজের প্রয়োজনে গুলশানে গুদারাঘাট ও বনানী ১১ রোডে আমাদের অফিসে ইন্টারনেট গতি পরীক্ষা করি। প্রাথমিকভাবে ৩০০-৩৫০ মেগাবিট ইন্টারনেট ডাউনলোড গতি পেয়েছি। আমরা স্টারলিংক রোমিং প্যাকেজ ব্যবহার করব। আমাদের ইন্টারনেট অ্যানটেনার মাধ্যমে বান্দরবান, কক্সবাজারসহ উপকূলীয় এলাকায় একটি মোবাইল শ্রেণিকক্ষ পরিচালনা করব আমরা। এরই মধ্যে প্রাথমিকভাবে আমরা ভালোই ইন্টারনেট সংযোগ পেয়েছি। আমাদের স্টারলিংক ইন্টারনেট সেবা ক্লাসে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করবে। আমরা ঢাকা থেকে প্রান্তিক এলাকায় স্টারলিংকের মাধ্যমে লাইভ ক্লাস করাব।’
সংযোগ প্রাপ্তিতে সমস্যা
কয়েকজন ব্যবহারকারী জানান, অর্ডার করার পর স্টারলিংকের যন্ত্রপাতি হাতে পেতে দেরি হচ্ছে। ফেসবুকে স্টারলিংক বাংলাদেশ ইউজার কমিউনিটি গ্রুপে বিভিন্ন ব্যবহারকারী তাঁদের সমস্যার কথা প্রকাশ করেছেন। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অর্ডারকারী বিমানবন্দরের শুল্কসংক্রান্ত সমস্যার কারণে দেরিতে সংযোগ পাচ্ছেন। স্টারলিংকের যন্ত্রপাতি কাস্টমস থেকে ছাড় করাতে অতিরিক্ত সময় লাগছে বলে অভিযোগ করেছেন।
একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ক্যামেরাপারসন ও ভিডিও সম্পাদক সোলায়মান হোসেন। তিনি ২০ মে স্টারলিংকের ওয়েবসাইট থেকে অর্ডার করেন। ওয়েবসাইটে ২৫ মে বাংলাদেশে স্টারলিংক আসার নোটিফিকেশন দেখায়। পরবর্তী সময়ে কাস্টমস জটিলতার কারণে ১৫ দিন পরও স্টারলিংক হাতে পাননি।
একই সমস্যায় পড়েছেন নারায়ণগঞ্জের পাগলার ফ্রিল্যান্সার হামিম অপূর্ব। তিনি বলেন, ‘আমি ২০ মে অর্ডার করি। ঠিক ২৫ মে স্টারলিংকের যন্ত্রপাতি বাংলাদেশে চলে আসে। এরপর বিমানবন্দরের কাস্টমস জটিলতার কারণে এখনো তা আমার হাতে এসে পৌঁছায়নি। আমি বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানায়, স্টারলিংক ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার অনুমতি পেলেও হার্ডওয়্যার আমদানি জটিলতার কারণে বিমানবন্দরে কাস্টমসের সমস্যায় পড়ছে। তাই কিছুটা দেরি হচ্ছে।’
নাম না প্রকাশ করার শর্তে বগুড়ার এক প্রযুক্তি উদ্যোক্তা জানান, ২০ মে স্টারলিংক অর্ডার করলেও এখনো হাতে পাননি সংযোগ। তিনি জানান, ‘দুই বছর আগে ৯ ডলার দিয়ে স্টারলিংক প্রি–বুক করেছিলাম। ২০ মে পুরো টাকা পরিশোধ করলেও এখনো হাতে পৌঁছায়নি সংযোগ। বিমানবন্দরে স্টারলিংকের যন্ত্রপাতি পড়েছিল বেশ কিছুদিন।’
মে মাস থেকে দেশে স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার বিভিন্ন পণ্য আসতে শুরু করেছে। ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাধ্যমেই বিভিন্ন পণ্য আমদানি করা হচ্ছে। এখান থেকেই পণ্য কুরিয়ারের মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে চলে যাচ্ছে। এ ধরনের পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিটিআরসিসহ অন্য সংস্থার মধ্যে কিছুটা সমন্বয়হীনতার জন্য কিছু কিছু গ্রাহক সমস্যায় পড়ছেন। যেহেতু এ ধরনের পণ্য দেশে প্রথমবারের মতো আসছে, তাই হয়তো এমন সমস্যা দেখা যাচ্ছে। দেশে স্টারলিংকের কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত সরকারের সব সংস্থা দ্রুত এই সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করছে।’
যন্ত্রপাতি–সংক্রান্ত ব্যবহারকারীদের নানা প্রশ্ন প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘কিছুটা জটিলতা হয়েছে। প্রথমদিক হিসেবে গ্রাহকেরা এলসির বিপরীতে সেটআপ কিনছেন না। তারা অনলাইন থেকে অর্ডার করছেন। প্রথম দিকে যে লটের অংশ হিসেবে গ্রাহকেরা কিনেছেন, তা ব্যাচ হিসেবে এনওসি নিয়ে বাংলাদেশে এনে বিতরণ করা হচ্ছে। যখন বিষয়টি নিয়মিত হয়ে যাবে, তখন এলসির মাধ্যমে আরও বড় সংখ্যক কিট দেশের গ্রাহকের হাতে তুলে দেবে স্টারলিংক। তখন এই সব ঝামেলা থাকবে না আশা করছি। প্রথমদিকে এলসি না থাকার কারণে কিছুটা সমস্যা দেখা যায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এনসিও নিয়ে এই সমস্যা সমাধান করা হচ্ছে।’
ঈদের আগে ৮০০ স্টারলিংক কিট চট্টগ্রাম ও অন্যান্য পোর্টে আটকে ছিল বলে জানালেন ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তিনি বলেন, ‘পরবর্তীতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এনওসির আবেদন করে স্টারলিংক। এখন সব কিট ছাড়া হয়েছে। কমার্শিয়াল টেস্ট রানের জন্য স্টারলিংককে ৯০ দিনের জন্য সময় দেয়া হয়েছে। এই সময়ে বারবার বিভিন্ন ব্যাচে কিট আনার জন্য অনুমতি–সংক্রান্ত এমন কিছু সমস্যা হয়তো দেখা যাবে। যখন নিয়মিত হবে তখন এসব সমস্যা আর থাকবে না। এছাড়াও আমদানির ক্ষেত্রে এসব সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় থেকে আইসিটি বিভাগ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আমরা অনুরোধ করে রেখেছি।’