‘আমার যেসব বন্ধুরা স্কুলে যায়, ওরা তো বলে যে ওদেরও স্কুল ভালো লাগে না। হোমওয়ার্ক করতে হয় যে! আমাকে স্কুল যেতে হয় না বলে ওরা আমাকে একটু হিংসেও করে বোধহয়’ বলছিল নয় বছরের ছোট্ট আনায়া আহমেদ।
মধ্য কলকাতায় তাদের বাড়ির কাছাকাছি থাকে বছর ১১ বয়সের দুই যমজ ভাই-বোন ঈশা আর শেহেরেজাদ ইফথেকার। ওরাও আনায়ার মতো স্কুলে যায় না।
‘আমাদের কয়েকজন বন্ধু তো বলে যে আমরা কত লাকি যে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যেতে হয় না ওদের মতো। তবে আমরা নাকি স্কুলের ফান অ্যাক্টিভিটিগুলো মিস করি, এটাও বলে ওরা’ বলছিল ঈশা আর শেহেরেজাদ।
ওদের নিয়ে বানানো একটা ইনস্টাগ্রাম ভিডিও এই সপ্তাহে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়ে গেছে।একই পাড়ায় থাকে নয় বছরের নাথান আর তার দুই বছরের ছোট ভাই জোশুহা।
কলকাতার এই কয়েকটি শিশু স্কুলের প্রথাগত পড়াশোনা করে না আর ওদের কয়েকজনের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব।
ওদের বাবা মায়েরা বাড়িতেই সন্তানদের শিক্ষিত করে তুলছেন।
শুধু কলকাতা নয়, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতীয় বড় শহরগুলোতেও অনেক অভিভাবকই সন্তানদের স্কুলের প্রথাগত শিক্ষার বদলে বাড়িতেই শিক্ষিত করে তোলার পন্থা বেছে নিয়েছেন।
স্কুলে না পাঠিয়ে বাড়িতে যেভাবে এরা সন্তানদের বড় করছেন, সেই ধারণাটিকে বলা হয় ‘আনস্কুলিং’।
হোম স্কুলিং কিছুটা পরিচিত পদ্ধতি হলেও ‘আনস্কুলিং’ বেশ অপরিচিত শব্দ।
আনায়ার মা শিরিন আহমেদের কথায়, স্কুলের প্রথাগত পড়াশোনা না করেও যে কতটা শিক্ষিত হওয়া যায়, আমাদের, বাঙালীদের সামনে তো তার সবথেকে বড় উদাহরণ হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
তাকেও যেমন গৃহশিক্ষক পড়াতে আসতেন, কলকাতার এই শিশুগুলোকেও গৃহশিক্ষকরা পড়াতে আসেন – কেউ শেখে আরবি, ফার্সি, বাংলার মতো একাধিক ভাষা, কেউ শেখে ইংরেজি আর অঙ্ক।
আর বাকি সময়ে তারা নিজের খেয়াল খুশি মতো শিখতে থাকে – বাবা-মায়ের নিবিড় তত্ত্বাবধানে।
শেখার আনন্দে শেখা
প্রথাগত স্কুলের শিক্ষায় একেবারে ছোট বয়স থেকে যেভাবে শুধুই সিলেবাস শেষ করা আর এই কয়েকজন অভিভাবকের কথায়, ‘নানা অকেজো জিনিস, যেগুলো শেখার কোনও ইচ্ছা বা দরকারই নেই বাচ্চাদের’ সেসব শেখানো হয়। এর ফলে শিশুদের ওপরে ব্যাপক চাপ পড়ে বলে তারা মনে করছেন।
নাথান আর জশুহার মা সুমন সুব্বা চেনের কথায়, ‘ওদের কোনও কিছুরই কোনও রুটিন নেই। ঘুম থেকে ওঠা, স্নান-খাওয়ার মতো কয়েকটা বিষয় বাদ দিলে ওরা যখন যেটা ইচ্ছা, সেটাই করে। আমি ওদের কখনও এ-বি-সি-ডি শেখাই নি। কিন্তু ওদের আমি বই পড়ে শোনাতাম ছোট থেকে – ওদের অক্ষরজ্ঞান সেভাবেই হয়েছে।
ওরা কখনও বই পড়ছে, কখনও ছবি আঁকছে। আমার স্বামীর বেকিং করার নেশা আছে, ওর কাছ থেকে দুই ছেলেও সেটা পেয়েছে। বড় ছেলে তো পাঁচ বছর বয়সে স্ক্র্যাম্বেল্ড এগ বানাতে শিখে গেছে। আমরা পাশে থাকি যদিও। আবার কখনও ইচ্ছা হলে খেলছে।
তিনি একটা ক্যাফে চালান কলকাতায়। সেখানেও নিয়ে যান সন্তানদের।
‘ওরা আমাকে ক্যাফেতেও সাহায্য করে। আবার সেখানকার কর্মীদের সঙ্গেও কাজে হাত লাগায় মাঝে মাঝে’ জানাচ্ছিলেন তিনি।
তার বড় ছেলে যেমন বই পড়তে ভীষণ পছন্দ করে, তেমনই ছোট ছেলের পছন্দ রোলার স্কেটিং করা। তবে ইংরেজি আর অঙ্ক শেখাতে গৃহশিক্ষক রেখেছেন সুব্বা চেন।
কিন্তু সেটারও কোনও নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম নেই।এই শিশুদের কারও পছন্দ ক্রিকেট, কারও বাস্কেটবল কারও আবার জিমন্যাস্টিক্স।
প্রতিদিনের জীবন থেকে শেখা
এই তিন অভিভাবকই বলছিলেন যে তাদের সন্তানরা স্কুলে না গেলেও সবসময়েই শিখছে – প্রতিদিনের জীবনযাপনের মাধ্যমেই তারা নানা বিষয়ে জানছে, বুঝছে।
ইফথেকার আহসান ও শাহিরা ইফথেকারের বছর ১১-র শিশুকন্যা ঈশা ও শেহেরেজাদদের পড়াতে বেশ কয়েকজন গৃহশিক্ষক আসেন – তারা শুধুই নানা ভাষা শিক্ষা দেন।
আহসান বলছিলেন, ‘ওদের জন্মের পর থেকেই আমরা ঠিক করে নিয়েছিলাম যে ওরা যাতে কখনই এখনকার অন্য বাচ্চাদের মতো ইংরেজিটাকেই একমাত্র ভাষা হিসাবে না নেয়। তাই ওদের জন্য বাংলা, উর্দু, ফার্সি, আরবি আর ইংরেজির শিক্ষকরা আসেন। আবার আমি রাজস্থানের লোক, তাই বাড়িতে মারোয়ারি বলি। আমার দুই ছেলে মেয়েই খুব ভালো মারোয়ারি বলতে পারে।’
শেহেরেজাদ বলছিল, গৃহশিক্ষকরা আসেন ঠিকই, কিন্তু স্কুলের মতো কোনও নির্দিষ্ট সিলেবাসে পড়ান না তিনি। অনেকটা গেট-টুগেদারের মতো হয় ওই সময়টায়।
ওর পছন্দের বিষয় অঙ্ক আর সমবয়সী ভাইয়ের ভালো লাগে ইতিহাস।
আনায়ার দিন কীভাবে কাটে, সেটা বলতে গিয়ে সে জানাচ্ছিল, ঘুম থেকে উঠে বই পড়ি, ডুডল বানাই, বাড়িতে অনেকগুলো বিড়াল আছে, ওদের সঙ্গে খেলি। দুপুরে একটু পড়াশোনা করি। আবার বিকালে সাইকেল চালাই, হুলা হুপ করতে খুব ভালো লাগে। কমিক স্ট্রিপ বানাতে ভালোবাসি। কয়েকটা কমিকসের বইও বানিয়েছি আমি। আর মাঝে মাঝেই মা আমাকে নানা ওয়ার্কশপে নিয়ে যায়।’
আনায়া যখন কথা বলছিল, তখন ওর একটু তাড়া ছিল, কারণ ক’দিন আগে উদ্ধার করা একটা বিড়াল ছানা, যার নাম ও রেখেছে ‘লিচি’ তাকে নিয়ে পশু চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
যেসব ওয়ার্কশপের কথা বলছিল আনায়া, সেগুলোতে এই পাঁচটি শিশু, যারা প্রথাগত স্কুলের বদলে বাড়িতেই বড় হচ্ছে, তারা সবাই যায়। আবার সেখানে এমন শিশুরাও যায় যারা প্রথাগত স্কুলে পড়াশোনা করে।
কোনোটা ছবি আঁকার ওয়ার্কশপ, কোনোটা পাহাড়ে চড়ার বা প্রকৃতিকে চেনার জন্য ‘নেচার ওয়াক’।
এই অভিভাবকরা সকলেই সন্তানদের নিয়ে প্রচুর ঘুরে বেড়ান দেশে-বিদেশে।
ইফথেকার বলছিলেন, আমরা যখন কোথাও ঘুরতে যাই, সেখানকার ইতিহাস, ভূগোল বাচ্চাদের বোঝাই। আবার দর্জির দোকানেও নিয়ে যাই। সেখানে যখন পোশাকের মাপ নেওয়া হয় – তা থেকে ওরা মিটার-সেন্টিমিটার এসব শিখেছে। প্রতিদিনের জীবন থেকেই টুকরো টুকরো করে ওরা শিখছে।
এই শিশুরা বই পড়তে খুব ভালোবাসে, কিন্তু কয়েকজনের মধ্যে লেখায় অনীহা আছে বলে জানাচ্ছিলেন তাদের বাবা-মায়েরা।
এটা কাটিয়ে ওঠার জন্য পত্র-মিতালীর পদ্ধতি নিয়েছেন তাদের অভিভাবকরা। চিঠি লিখে বা দিনলিপি লিখতে শেখাচ্ছেন তারা বাচ্চাদের, যাতে লেখার অভ্যাস তৈরি হয়।
যেভাবে শুরু
শাহিরা ইফথেকার জানাচ্ছিলেন, চিন্তাভাবনাটা প্রথমে এসেছিল আমার স্বামীর মাথায়। ও ব্যাপারটা কোথাও থেকে জেনে এসে নিজে রিসার্চ করে তারপরে আমাকে বলে! আমি তো প্রথমে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। আমি নিজে একটা উচ্চশিক্ষিত পরিবার থেকে এসেছি, তাই গোড়ায় মানতেই চাই নি যে ছেলে মেয়ে স্কুলে যাবে না তা হয় নাকি!
তখন আমার স্বামী বললেন, তুমি নিজেই রিসার্চ করে দেখ। অনেকেই নাকি এই পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। রিসার্চ করতে গিয়ে আমি রবীন্দ্রনাথ পড়ি, অন্যান্য অনেকের লেখা পড়ি। ধীরে ধীরে আমার কাছে ব্যাপারটা গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।
আবার সুমন সুব্বা চেন অথবা শিরিন আহমেদের এই পদ্ধতিতে বাচ্চাদের শিক্ষা দেওয়া প্রেক্ষাপটটা একটু আলাদা।
মিসেস আহমেদ বলছিলেন, মেয়ের বছর তিনেক বয়সে যখন থেকে স্কুলে ভর্তি করার পরিকল্পনা নিই আমরা, তখন ভর্তির পরীক্ষার জন্য ওকে তৈরি করা শুরু করি। এর আগে আমার মেয়ে নিজে থেকেই নানা বিষয় শিখছিল, কিন্তু এই স্কুলে ভর্তির পরীক্ষার জন্য তৈরি করতে শুরু করার পরে যেন ও শেখার ইচ্ছাটাই হারিয়ে ফেলল। কিছুই শিখছিল না ও তখন।
তখনই তাদের মনে প্রশ্নটা জাগে যে স্কুলে কেন পাঠাতেই হবে বাচ্চাকে! এই অভিভাবকদের কথায়, একেবারে ছোটবেলা থেকেই প্রথাগত স্কুলগুলিতে যেভাবে পড়াশোনার চাপ তৈরি করা হয়, ভারী ভারী ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যেতে হয়, তারপরে আবার প্রতিটা বিষয়ের জন্যই গৃহশিক্ষক রাখতে হয় – তাহলে স্কুলে পাঠিয়ে লাভ কী?
সুমন সুব্বা চেন বলেন, সংবাদপত্রে নানা খবর বের হয় বাচ্চাদের ওপরে কী ধরনের চাপ দেওয়া হয় স্কুলে, সেসব পড়ে আমার ভয়ই লাগত। আমি বলব না যে সব স্কুলই খারাপ বা শিক্ষকরা খারাপ। তাদেরও একটা টার্গেট থাকে সিলেবাস শেষ করার, একসঙ্গে এতগুলো বাচ্চাকে সামলানোর। তাই সব বাচ্চার ওপরে সমান মনোযোগ হয়ত তারা দিতে পারেন না। কয়েকটা মন্টেসরি স্কুলে আমার বড় ছেলেকে দিয়েওছিলাম। কিন্তু ওর ভালো লাগে নি কোনোটাই, কান্নাকাটি করত। তারপরেই আমি এই আনস্কুলিংয়ের ব্যাপারটা জানতে পারি আর ঠিক করি যে আমার বাচ্চাদের এভাবেই বড় করব।
এরা যখন বাচ্চাদের বাড়িতেই শিক্ষিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন সামনে কোনও নির্দিষ্ট পথ ছিল না। সবটাই নিজেদের গড়ে নিতে হয়েছে।
তবে মিসেস সুব্বা চেন বলছিলেন, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু বা হায়দরাবাদের মতো শহরগুলোতে কিন্তু এরকম হোমস্কুলিং বা আনস্কুলিংয়ের ব্যাপারটা খুব পরিচিত। সেখানে পরিকাঠামোও গড়ে নিয়েছেন বাবা-মায়েরা নিজেরাই। একটা সাপোর্ট সিস্টেম আছে ওদের নিজেদের মধ্যেই। তবে কলকাতায় বিষয়টা অনেক কঠিন। কিন্তু তবুও এখানে অন্তত গোটা দশেক পরিবার আছে বলে আমিই জানি যারা বাচ্চাদের স্কুলে না পাঠিয়েও বড় করছেন।
‘বাচ্চারা স্কুলে যায় না!’
তিনটি পরিবারই জানাচ্ছিল যে তাদের আত্মীয়-বন্ধুরা অথবা অপরিচিতরা যখন প্রথম জানতে পারেন যে এই শিশুগুলো স্কুলে যায় না, তখন তাদের প্রশ্নটা থাকে, ‘অ্যাঁ, বাচ্চারা স্কুলে যায় না!’
শিরিন আহমেদ বলছিলেন, কোনও পরিচিত বা অপরিচিতের সামনে যখন ছেলেরা যায়, তাদের প্রথম প্রশ্নটাই থাকে, কী নাম, কোন স্কুলে পড়ে। জবাবে যখন তারা জানতে পারেন যে ওরা স্কুলে যায় না, তখন সবাই যেন আকাশ থেকে পড়ে। বাচ্চারা স্কুলে যায় না আবার কী!
সুমন সুব্বা চেন বা শাহিরা ইফথেকারদেরও এরকমই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়।
ভবিষ্যৎ কী?
ইফথেকার আহসানের কথায়, সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা ব্যক্তিগতভাবে খুব চিন্তিত নই। আমরা ওদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট কোনও কিছু আশাও করি না যে এরকম চাকরি পেতে হবে ইত্যাদি। তাছাড়া আমরা ব্যবসায়িক পরিবার, আমি নিজে কলকাতা শহরের ইতিহাস চেনানোর জন্য হেরিটেজ ওয়াক চালাই। স্ত্রীর একটা ক্যাফে আছে। ছেলে মেয়েরাও কিছু না কিছু ঠিকই করে নেবে ভবিষ্যতে।
আবার সুমন সুব্বা চেন বলছিলেন যে তার দুই ছেলেই বড় হয়ে যদি কোনও নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে চায়, তাহলে তারা তাই-ই করবে।এ নিয়ে খুব কিছু ভাবি না আমরা। আরও বড় হোক, তখন যদি ওদের মনে হয় যেমন রকেট সায়েন্স নিয়ে পড়বে, সেটা তো আর বাড়িতে পড়ানো যাবে না, তখন না হয় ও প্রথাগত কোনও প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে যাবে। শিশুকালটা তো ওরা উপভোগ করুক।