ইসলামের সুন্দর শিক্ষাগুলোর মধ্যে একটি হলো সুসংবাদ দেওয়ার গুরুত্ব। ‘আবশির’ বা ‘সুসংবাদ গ্রহণ করো’ শব্দটি বলে যে রাসুল (সা.)-কে আল্লাহ পাঠিয়েছেন সুসংবাদদাতা হিসেবে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে নবী, আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষী, সুসংবাদদাতা, সতর্ককারী এবং আল্লাহ মহানের অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারী ও আলোকবর্তিকা হিসেবে। আর মুমিনদের সুসংবাদ দিন যে তাঁদের জন্য আল্লাহ মহানের কাছ থেকে মহান অনুগ্রহ রয়েছে।’ (সুরা আহযাব, আয়াত: ৪৫-৪৭)
রাসুল (সা.)-এর বাণীতে দেওয়া সুসংবাদগুলো কেবল কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি ছিল একটি জীবনাচরণ, যা মানুষের মনে আশা ও কাজের প্রেরণা জাগিয়েছে।
হে নবী, আপনাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষী, সুসংবাদদাতা, সতর্ককারী এবং আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারী ও আলোকবর্তিকা হিসেবে।
সুরা আহযাব, আয়াত: ৪৫-৪৭
নবুয়তের সুসংবাদ
রাসুল (সা.) দাওয়াতের শুরু থেকেই সুসংবাদ দিয়ে মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান করেছেন। তিনি তাঁর নিকটাত্মীয়দের বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের জন্য আল্লাহ মহানের কাছ থেকে কোনো সৌভাগ্য বা আখিরাতের অংশ আনতে পারি না। তবে তোমরা যদি বলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, তবে আমি তোমাদের পক্ষে তোমাদের প্রতিপালকের কাছে সাক্ষ্য দেব। এর মাধ্যমে আরব তোমাদের কাছে আনুগত্য করবে এবং অ-আরবরাও তোমাদের কাছে নত হবে।’ (ইবনে সা’দ, আত-তাবাকাত আল-কুবরা, ১/১৯৯)
তিনি বিভিন্ন গোত্রের কাছে গিয়ে তাদের বলেছেন, ‘হে মানুষ, বলো “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”, তাহলে তোমরা দুনিয়া ও আখিরাতে সফল হবে। এর মাধ্যমে আরব তোমাদের শাসন মেনে নেবে, অ-আরবরা তোমাদের কাছে নত হবে এবং তোমরা ইমান আনলে জান্নাতে বাদশা হবে।’ (ইবনে সা’দ, আত-তাবাকাত আল-কুবরা, ১/২০১)
এই সুসংবাদ মানুষের মনে দুনিয়া ও আখিরাতের সাফল্যের আশা জাগিয়েছে। এ ছাড়া মহানবী (সা.) নানা সময়ে যেসব সুসংবাদ দিয়েছেন, তার কয়েকটি হলো:
১. তাওহিদের অনুসারীদের জন্য সুসংবাদ
তিনি তাওহিদের ওপর দৃঢ় থাকা মুমিনদের জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। তিনি মুআয (রা.)-কে বলেছেন, ‘জেনে রাখো, যে ব্যক্তি সত্যিকারের হৃদয় থেকে সাক্ষ্য দেয় যে আল্লাহ মহান ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ তাঁর রাসুল, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (মুসনাদ আবি ইয়ালা, হাদিস: ২,৪৩৭)
২. সৎকর্মশীলদের জন্য সুসংবাদ
তিনি সৎকর্মশীলদের জন্য মহান প্রতিদানের সুসংবাদ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘দ্বীন হলো সহজ। কেউ দ্বীনের ব্যাপারে অতিরিক্ত কঠোরতা করলে তা তাকে পরাভূত করবে। তাই তোমরা সঠিক পথে থাকো, কাছাকাছি থাকো, সুসংবাদ গ্রহণ করো এবং সকাল, সন্ধ্যা ও রাতের কিছু অংশে সাহায্য প্রার্থনা করো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৯)
আল্লাহর একটি মহান নিয়ামত হলো প্রজ্ঞা, যা মানুষকে ভালো-মন্দ ও উত্তম-অনুত্তমের মধ্যে পার্থক্য করতে সাহায্য করে।
সৎকর্মশীলদের যারা আন্তরিকতার সঙ্গে চেষ্টা করে, কখনো সফল হয়, কখনো ব্যর্থ হয়, কিন্তু যাদের নিয়ত সত্য থাকে, এই সুসংবাদ তাদের জন্য। আল্লাহ মহানের কাছে তারা মহান প্রতিদান পায়, যা বর্ণনার অতীত।
৩. সংকটে সুসংবাদ
সংকটের সময় সুসংবাদের গুরুত্ব অপরিসীম। যখন পরিবেশ অন্ধকার হয়ে আসে এবং কষ্ট বাড়তে থাকে, তখন রাসুল (সা.)-এর সুসংবাদ আত্মার জন্য শক্তি ও ইতিবাচক শক্তি জোগায়। সাহাবারা যখন তাঁর কাছে অত্যাচার ও কষ্টের কথা জানিয়েছিলেন, তিনি তাঁদের বলেছেন, ‘আল্লাহ মহানের শপথ, এই দ্বীন অবশ্যই পূর্ণতা পাবে। এমন দিন আসবে, যখন একজন পথিক সানা থেকে হাজরামাউত পর্যন্ত (প্রায় ৮০০ কিলোমিটার) ভ্রমণ করবে, শুধু আল্লাহ মহানের ভয় ছাড়া আর কিছু ভয় করবে না, অথবা তার ভেড়ার জন্য নেকড়ের ভয় ছাড়া। কিন্তু তোমরা তাড়াহুড়ো করছ।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩,৬১২)
এই সুসংবাদ সাহাবিদের হৃদয়ে আশা ও নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি জাগিয়েছে।
৪. প্রজ্ঞাবানদের জন্য সুসংবাদ
আল্লাহর একটি মহান নিয়ামত হলো প্রজ্ঞা, যা মানুষকে ভালো-মন্দ ও উত্তম-অনুত্তমের মধ্যে পার্থক্য করতে সাহায্য করে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমার বান্দাদের সুসংবাদ দাও, যারা কথা শোনে এবং তার মধ্যে সবচেয়ে উত্তমটি অনুসরণ করে। তারাই আল্লাহ মহানের পথপ্রাপ্ত এবং তারাই প্রজ্ঞাবান।’ (সুরা যুমার, আয়াত: ১৭-১৮)
ইবনে আশুর বলেন, ‘আল্লাহ মহান তাদের প্রশংসা করেছেন, কারণ তারা সত্য-মিথ্যা ও প্রজ্ঞা-ভ্রান্তির মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। তারা প্রকৃত প্রমাণের প্রতি গভীর দৃষ্টি দেয়।’ (তাহির ইবনে আশুর, আত-তাহরির ওয়াত তানভির, খণ্ড ২৩, পৃষ্ঠা ১২৪)
তারা অনেক কথার মধ্য থেকে সবচেয়ে ভালোটি বেছে নেয় এবং তা অনুসরণ করে। অনেকে নিজের ইচ্ছার সঙ্গে মিলে এমন কথা বেছে নেয়, কিন্তু প্রজ্ঞাবানরা আল্লাহ মহানের কাছে হিদায়াত প্রার্থনা করে এবং সত্যের প্রতি নিজেদের সমর্পণ করে। ৫. অসুস্থ ও পরীক্ষিতদের জন্য সুসংবাদ
অসুস্থতা মানুষের জন্য কঠিন, কারণ এটি তাকে দুর্বল ও অন্যের ওপর নির্ভরশীল করে। রাসুল (সা.) অসুস্থদের সুসংবাদ দিয়েছেন। উম্মুল আলা (রা.) বলেন, ‘আমি অসুস্থ ছিলাম। রাসুল (সা.) আমাকে দেখতে এসে বললেন, “হে উম্মুল আলা, সুসংবাদ গ্রহণ করো। মুসলিমের অসুস্থতা আল্লাহ মহান তার পাপ মুছে দেয়, যেমন আগুন সোনা ও রুপার অপবিত্রতা দূর করে”।’ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ৩,০৯২)
৬. মুসলিম উম্মাহর জন্য সুসংবাদ
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘এই উম্মাহকে সুসংবাদ দাও মর্যাদা, উচ্চতা, বিজয় এবং পৃথিবীতে ক্ষমতায়নের। তবে যে ব্যক্তি আখিরাতের কাজ দুনিয়ার জন্য করবে, তার জন্য আখিরাতে কোনো অংশ থাকবে না।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২১,৫৮৩)
মুসলিম উম্মাহ দুঃখ-কষ্ট ও দুর্বলতার মধ্য দিয়ে যায়, কিন্তু কোরআন ও সুন্নাহর পথ অনুসরণ করলে তারা পুনরুজ্জীবিত হয়। যখনই তারা দুর্বল হয়, আল্লাহ মহান তাদের জন্য এমন কাউকে পাঠান, যিনি তাদের পথ দেখান এবং শক্তি জোগান।
‘সুসংবাদ দাও’
রাসুল (সা.) সুসংবাদ দেওয়ার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং সাহাবিদের বলেছেন, ‘সুসংবাদ দাও, ভয় দেখিয়ো না। সহজ করো, কঠিন করো না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৭৩২)
সুসংবাদ দাও, ভয় দেখিয়ো না। সহজ করো, কঠিন করো না।
সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৭৩২
ইমাম নববি বলেন, ‘এটি আল্লাহ মহানের অনুগ্রহ, মহান প্রতিদান, উদার দান ও বিশাল রহমতের সুসংবাদ দেওয়ার নির্দেশ। ভীতি প্রদর্শন শুধু সতর্কতার জন্য নয়, বরং সুসংবাদের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া উচিত। এটি নতুন মুসলিম, শিশু, প্রাপ্তবয়স্ক বা তওবাকারীদের প্রতি নম্রতা ও ধাপে ধাপে তাদের আনুগত্যের পথে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ।’ (শারহুন নাবাবি আলা মুসলিম, ১২/১৪৫)
সুসংবাদে সাহাবিদের দৃঢ় বিশ্বাস
সাহাবিদের হৃদয় রাসুল (সা.)-এর সুসংবাদের প্রতি পূর্ণ আস্থায় ভরা ছিল। আদি ইবনে হাতিম (রা.)-কে তিনি ইসলামের দাওয়াত দিয়ে বলেছেন, ‘আদি ইবনে হাতিম, ইসলাম গ্রহণ করো, নিরাপদ থাকবে। আমার ধারণা, তুমি আমার চারপাশের দারিদ্র্য দেখে ইসলাম গ্রহণে দ্বিধা করছ। কিন্তু শিগগিরই এমন সময় আসবে, যখন একজন নারী হিরা থেকে নিরাপদে কাবা তাওয়াফ করবে, কিসরার ধনভান্ডার আমাদের জন্য খুলে যাবে এবং সম্পদ এত বেশি হবে যে একজন মানুষ তার জাকাত গ্রহণ করার জন্য লোক খুঁজবে।’ (ইবনে হিব্বান, আল-ইহসান ফি তাকরিব সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস: ৭,১৮৬)
ইবনে হাতিম বলেন, ‘আমি দেখেছি, একজন নারী “হিরা” নগর (ইরাকের কুফার নিকটবর্তী) থেকে এসে কাবা তাওয়াফ করেছে। আমি কিসরার ধনভান্ডার জয়ের প্রথম অশ্বারোহীদের মধ্যে ছিলাম। আর তৃতীয় সুসংবাদটিও সত্য হবে, কারণ এটি রাসুল (সা.)-এর কথা।’
যারা কোরআন পড়ে, রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহ অধ্যয়ন করে এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়, তারাই সত্যিকারের সুসংবাদ গ্রহণ করতে পারে। তারা জানে, সব ভালো আল্লাহ মহানের হাতে। মানুষ যতই শক্তিশালী হোক, তারা আল্লাহ মহানের ওপর নির্ভরশীল। এই সুসংবাদ মুমিনদের হৃদয়ে আশা জাগায়, তাদের কাজে উৎসাহিত করে এবং তাদের আল্লাহ মহানের প্রতি সুধারণা রাখতে শেখায়।