পবিত্র কোরআনের সবচেয়ে ছোট সুরা হলো সুরা কাওসার। মাত্র তিনটি আয়াতের এই সুরা আকারে ছোট হলেও এর তাৎপর্য অপরিসীম। মহানবী (সা.)-এর জীবনের এক কঠিন মুহূর্তে এই সুরা অবতীর্ণ হয়। মক্কার কাফেররা তাঁকে বিদ্রূপ করে ‘আবতার’ (বংশহীন) বলত।
আল্লাহ তাআলা এই সুরা নাজিল করে নবীজিকে সান্ত্বনা দেন এবং ঘোষণা করেন—নবীজির মর্যাদা চিরস্থায়ী, আর তাঁর শত্রুরাই ইতিহাস থেকে মুছে যাবে। (ইবনে কাসির, তাফসিরুল কোরআনিল আজিম, সুরা আল-কাওসার, দারুস সালাম, রিয়াদ, ২০০৩, খণ্ড ৪, পৃ. ৬৭৪)
সুরা কাওসার
উচ্চারণ: বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। ইন্না আ’তাইনা কাল কাওসার (আয়াত ১)। ফাসল্লি লি রব্বিকা ওয়ানহার (আয়াত ২)। ইন্না শানিয়াকা হুয়াল আবতার (আয়াত ৩)।
অর্থ: শুরু করছি আল্লাহর নামে, যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু। নিশ্চয়ই আমি তোমাকে কাওসার দান করেছি। অতএব, তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ো এবং কোরবানি করো। নিশ্চয়ই তোমার শত্রুই বংশহীন হবে। শব্দগত বিশ্লেষণ
কাওসার: আরবি ভাষায় এর অর্থ অগণিত কল্যাণ, অবারিত বরকত। সহিহ হাদিসে এসেছে—কাওসার জান্নাতে একটি বিশেষ নদীর নাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “কাওসার হলো জান্নাতের একটি নদী, আমার প্রভু আমাকে তা দান করেছেন। এর পানি দুধের চেয়ে সাদা, মধুর চেয়ে মিষ্টি, এবং এর কিনারায় সোনার পাত্র রয়েছে।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৬০০২)
ওয়ানহার: ‘এবং কোরবানি করো’। অর্থাৎ আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করা।
আবতার: বংশহীন বা ধ্বংসপ্রাপ্ত। কোরআনের ভাষায় এর মানে হলো—নবীজির শত্রুরাই প্রকৃত ‘আবতার’ হবে।
সুরা কাওসারের মূল বার্তা
১. আল্লাহর অশেষ দান: প্রথম আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন—তিনি নবীজিকে কাওসার দান করেছেন। শুধু জান্নাতের নদী নয়, বরং দুনিয়া ও আখিরাতে অসংখ্য কল্যাণ, যেমন: নবুয়তের মর্যাদা, উম্মতের নেতৃত্ব, কিয়ামতের ময়দানে সুপারিশের অধিকার। (তাফসীর আত-তাবারী, খণ্ড ২৪, পৃ. ৬৬৭; দারুল মাআরিফ, কায়রো: ১৯৯৯)
২. কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পথ: দ্বিতীয় আয়াতে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে—কৃতজ্ঞতা শুধু কথায় নয়, বরং কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে। আল্লাহর উদ্দেশে নামাজ পড়া ও কোরবানি করা এই কৃতজ্ঞতার প্রতীক। (সাঈদ কুতুব, ফি জিলালিল কোরআন, সুরা আল-কাওসার, দারুশ শুরুক, কায়রো: ২০০০, খণ্ড ৬, পৃ. ৩৯৪২)
৩. শত্রুর পরাজয়: তৃতীয় আয়াতে নবীজিকে আশ্বস্ত করা হয়েছে—যারা তাঁকে বিদ্রূপ করছে, তারাই ইতিহাসে মুছে যাবে। সত্যিই তাই ঘটেছে। নবীজির নাম আজ কোটি কোটি মানুষ ভালোবেসে উচ্চারণ করছে, অথচ তাঁর শত্রুরা কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছে। (তাফসীর ইবনে কাসীর, খণ্ড ৪, পৃ. ৬৭৫)
আধুনিক জীবনে সুরা কাওসারের শিক্ষা
আজকের পৃথিবীতে মানুষ হতাশায় ভুগছে, নানা সমস্যায় জর্জরিত। সুরা কাওসার আমাদের শেখায়:
আল্লাহর দান সীমাহীন, তাই নিরাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই।
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে ইবাদত ও কোরবানির মাধ্যমে।
সত্যের পথে চললে বিরোধীরা যত শক্তিশালীই হোক, তারা একদিন নিশ্চিহ্ন হবে।
সুরা কাওসার হলো আশার ও সান্ত্বনার সুরা। তিনটি আয়াতের মধ্যে আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন—নবীজির মর্যাদা চিরস্থায়ী, তাঁর জন্য দুনিয়া-আখিরাতের অসংখ্য কল্যাণ নির্ধারিত, আর শত্রুরাই প্রকৃত ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। আমাদের জন্য শিক্ষা হলো—কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত করা এবং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তাঁর ওপর ভরসা রাখা।