সবে পা রেখেছেন তারুণ্যে। ঝাঁকড়া চুল, বেঁধে রাখেন অধিকাংশ সময়। ছিমছাম গড়ন দৃষ্টি কাড়বে সহসাই। বাঁকা দাঁতের হাসিতে বিনয়ী ভাবটাই প্রকাশ পায় অহর্নিশ। চলনে যেমন, বলনেও তাই। আর সুরে তো পাঁজর খোলা হৃদয় মেলে ধরা।
সেদিন স্টুডিওতে ‘খাজা মেরে খাজা দিল মে সামা জা’ গানটি দিয়ে যখন আসর শুরু করলেন, ঠিক যেন খাজা গরিবে নেওয়াজের আর্শীবাদ ভর করলো। সুফি ঢং অথচ ক্ল্যাসিক্যালে ঠাসা এক অনবদ্য সুরের মাত্রা যোগ হলো।
বিশ্বখ্যাত কম্পোজার এ আর রহমানের সুর করা গানটিতে সাগরও তার জ্যোতি ছড়ালেন। সেই যে ভাব জগতে প্রবেশ, শেষ বেলাতেও সুরের পেয়ালা মধুমাখা করে রাখলেন।
প্রায় ঘণ্টা দুই গান-আড্ডা। আসরের মধ্যবেলায় প্রেম ও দ্রোহের কবি নজরুলের ‘আমি যে জলসা ঘরে’ গানটি যখন করলেন, তখন মনে হলো এই গান ঠিক সাগরের জন্যই রচিত। নইলে এত আপন সুরে কে মাতাল করে! সুরে সুরে প্রেম জানালা উদাম করে গাইলেন দেওয়ান ঘাড়ানা, মলায়া সংগীত, বিচ্ছেদ, ভাব বিচ্ছেদ।
সাগর দেওয়ান। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীত পরিবার দেওয়ান বংশের চতুর্থ প্রজন্মের শিল্পী। গানের প্রথম সুর মায়ের কাছে। এরপর বড় ভাই আরিফ দেওয়ানের সান্নিধ্য। মূলত বিখ্যাত বাউল সাধক আরিফ দেওয়ানের মাধ্যমেই সংগীত ভুবনে প্রবেশ। সুর আর গায়কি ঢংয়ে আরিফ দেওয়ানের প্রভাব শৈশব থেকেই। শৈশবে পালাগানে দোহারি হয়েই এই অর্জন তার।
এখন বাউল ভুবনে প্রায় পূর্ণ শিল্পী সাগর। গান করছেন বাংলাদেশের বিখ্যাত পালা শিল্পীদের সঙ্গেও। বাউলে যারা কান পাতেন, তারা সাগরকে শুনতে পারছেন। শুনছেন বৈঠকি গান, পালাগান নতুবা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে।
বয়সের যে ফ্রেম, তা ছাপিয়ে গেছেন সুরের ফ্রেমে। বিশেষত, সুফি গানে যে আলো ছড়াচ্ছেন, তা তারকাতুল্য। ঊর্দু, হিন্দি গজল, কাওয়ালি গাইছেন সমানতালে।
সাগর বলছিলেন, ‘দেওয়ান পরিবারের সন্তান আমি। আমাদের পরিবারে সুফিবাদের চর্চা হয়ে আসছে প্রায় ২শ বছর ধরে। সুফিবাদ আর বাউলের যে মেলবন্ধ, তা খুব কাছে থেকে দেখেছি। চেষ্টা করছি এই ধারাতেই নিজেকে রাঙাতে।’
সাগর রাজধানীর আগারগাঁওয়ের মিউজিক কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে বেসরকারি শান্তা মারিয়াম ইউনিভার্সিটিতে সংগীতের (নজরুল বিভাগ) ওপর অনার্সে ভর্তি হয়েছেন। ক্লাসিক্যাল ধারায় নিজেকে তুলে ধরার যে প্রয়াস, সেখানে একাডেমিক শিক্ষাও রসদ দিচ্ছে।
বলছিলেন, ‘সংগীত পরিবারেই বেড়ে ওঠা আমার। দাদা গুরু মালেক দেওয়ান-খালেক দেওয়ান ছিলেন বাউলের মানিকজোড়। অসংখ্য ভক্ত-আশেকান আর শিষ্য রেখে গেছেন। তাদের নামেই বহু সাধক টাইটেল নিয়েছেন। বাবাও বিখ্যাত পালাশিল্পী ছিলেন। আমারও ধ্যান-জ্ঞান তো এটিই। লক্ষ্য ঠিক রেখেই মিউজিকের ওপর পড়ছি। একাডেমিক শিক্ষা আমার সুর-সাধনাকে সমৃদ্ধ করছে নিঃসন্দেহে।
বাউল জগতের অত্যন্ত পরিচিত মুখ আলেয়া বেগম। অসংখ্য গানের রচিয়তাও তিনি। ‘সাগরের গানে মুগ্ধ’ জানিয়ে আলেয়া বেগম বলেন, দেওয়ান পরিবারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আত্মার। কারণ ওই পরিবারের বহু সাধক-শিল্পী, যাদের সঙ্গে আমার গান করা হয়েছে। সাগরের বড় ভাই আরিফ দেওয়ানের সঙ্গে বহু পালা করেছি। সেখানে সাগর দেওয়ান দোহারি ছিলেন। ওর একদম ছোট্টবেলার কথা। তখন থেকেই সুরে প্রাণ কেড়ে নিতো। আমরা বলেছি, সাগর একদিন নাম করবে। ঠিক তাই করছে এখন। সাগরের আলোয় আলোকিত হচ্ছে বাউল ভুবন।’
এইদিন আসরের শেষবেলায় বিখ্যাত সাধক উকিল মুন্সির বিচ্ছেদ,
‘তোর লাগিয়া সব ছাড়িলাম
আর কি ছাড়বো বলো না
আমার মনে মানে না’
গানটি করছিলেন। চোখ ছলছল তখন। যেন সব হারিয়ে এক সর্বহারার বুকফাটা অভিপ্রায় প্রকাশ পাচ্ছে। প্রেমের পূর্ণতা যে বিচ্ছেদে, তা যেমন উকিল মুন্সি রচনা করে গেছেন, আর সাগর প্রকাশ করলেন তার সুর মূর্ছনায়।
সাগরের গান আর সুর নিয়ে মূল্যায়ন করেন আরেক বিখ্যাত বাউল সাধক সুনীল কর্মকার। বলেন, ‘ওর সুরের তেজ আমাকেও শক্তি জোগায়। অসাধারণ পরিবেশনা। ওর ছোটবেলা থেকেই আমরা গান শুনে আসছি। বিশেষ করে তার বড় ভাই আরিফ দেওয়ানের সঙ্গে যখন পালা হয়, তখন সাগরের গান শোনা যেত। সে আরিফ দেওয়ানের দোহারিও ছিল। এখন আরও ভালো করছে। ওর সুরের যে ধারা তা অনেক বাউলের মধ্যে নেই। আমি ওর মঙ্গল কামনা করি।’
একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন পালাশিল্পী রুমা সরকারও। রুমা সরকার বাউল জগতে বিশেষ পরিচিত নাম, যার সুর মাদকতায় ভরা বলে মনে করা হয়। রুমা বলেন, ‘সাগর দেওয়ানের সুরের আলো বাউল জগৎকে ধন্য করবে। সুর-সাধনায় যে সফল হওয়া যায়, তার প্রমাণ দিচ্ছে সাগর দেওয়ান। সামনে ওর জন্য উত্তম পথ অপেক্ষা করছে।’