সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় পাঁচটি সংস্কার কমিশনের প্রায় ৬৯৪টি প্রস্তাবের মধ্যে ৫ শতাধিক বিষয়ে একমত হয়েছে বিএনপি। সংস্কারের কিছু মৌলিক সুপারিশের বিষয়ে একমত হয়নি দলটি। তবে বেশির ভাগ সুপারিশে বিএনপির সমর্থনের বিষয়কে ইতিবাচক হিসাবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে-বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসাবে নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া ঐকমত্য কমিশনের বিপরীতে তাদের নিজস্ব ৩১ দফা আছে। সেক্ষেত্রে বিএনপি যদি ঐকমত্য কমিশনের অধিকাংশ সুপারিশের সঙ্গে একমত হয়, তাহলে সংস্কারের একটা ভালো ভবিষ্যৎ দেখতে পান। অবশ্য বিএনপি কিছু মৌলিক সুপারিশের বিষয়ে একমত হয়নি। সোজা কথা কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে। এসব বিষয়ে মতানৈক্য দূর করতে আরও আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের বেশির ভাগ সুপারিশে একমত হয়েছে বিএনপি। কিন্তু কিছু মৌলিক সংস্কারে একমত হয়নি বা আপত্তি জানিয়েছে। সুতরাং তারা সংস্কার কমিশনে যে রিপোর্ট দিয়েছে সেটার মূল বিষয়ের সঙ্গে একমত হয়নি। সোজা কথা পুরোপুরি ঐক্য হয়নি। তবে কাছাকাছি যাচ্ছে সেটা ইতিবাচক।
তিনি মনে করেন, কিছু মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে অন্য দলগুলোর প্রস্তাব মিলছে না। সে বিষয়ে তারা অনানুষ্ঠাকিভাবে কথাবার্তা বলুক। সব সময় যে আনুষ্ঠানিক হতে হবে তা তো নয়। অনেক সময় সরাসরি বসে মতৈক্য হতে চায় না, তখন অনেকে পেছন থেকে কাজ করে। এর কাছে ওর মেসেজ নিয়ে যায়, ওর কাছে এর মেসেজ নিয়ে যায়। এই যে একটা প্রক্রিয়া তার মধ্যে ঢুকতে হবে। এর মাধ্যমে একটা ঐকমত্যে তো পৌঁছাতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, অপপ্রচার ও প্রোপাগান্ডা ছিল যে, সংস্কারে বিএনপি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একমত নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যে একমত হয়েছে, এটা প্রমাণ করে বিএনপি সংস্কারের পক্ষে। এটা জাতির জন্য একটা ভালো লক্ষণ। কারণ বিএনপি দেশের বড় ও জনপ্রিয় দল। যদি সুষ্ঠু ভোট হয় তাহলে ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেক্ষেত্রে যদি বিএনপি ঐকমত্য কমিশনের সংস্কারের অধিকাংশ ক্ষেত্রে একমত হয়, তাহলে সংস্কারের একটা ভালো ভবিষ্যৎ দেখতে পাই। অন্তর্বর্তী সরকার না থাকলে সংস্কারগুলোর ভবিষ্যৎ কী হবে, বাস্তবায়ন কারা করবে এবং বাস্তবায়ন করার পরে তা মনিটরিং করবে কারা-এসব নানা বিষয় আমাদের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। এখন যদি রাজনৈতিকভাবে বিএনপি ক্ষমতায় আসে, তাহলে যেসব সংস্কারে বিএনপি একমত হয়েছে, সেগুলো তো বিএনপি ফেলে দিতে পারবে না। তা বাস্তবায়ন করবে। সেই জায়গায় সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের একটা ইতিবাচক দিক দেখতে পাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল, নির্দিষ্ট আদর্শ আছে। এই সরকার কিন্তু রাজনৈতিক দলের সরকার নয়। তার যে ধরনের চিন্তা-চেতনা-ভাবনা, তা বিএনপির চিন্তার সঙ্গে যে মিলে যাবে তা তো নয়। বিএনপি দীর্ঘ বছর ধরে রাজনীতি করছে। সেই রাজনীতির ধারা থেকে যেসব বিষয়ে বিএনপি একমত, সেগুলোতেই দলটি তার আদর্শের সঙ্গে মিলে গেলে একমত হবে। আর যেগুলো তার রাজনৈতিক আদর্শে মেলে না বা চিন্তা-চেতনায় মেলে না, সেগুলো তারা এখন গ্রহণ করতে পারবে না। আরেকটা বিষয় হলো, সরকারের সব সংস্কারের সঙ্গে বিএনপি তো একমত না-ই হতে পারে। বিএনপি হয়তো পর্যবেক্ষণ করছে। ভবিষ্যতে যদি সেগুলো তাদের কাছে স্পষ্ট হয়, জাতির জন্য ভালো হয়, সময়ের প্রেক্ষিতে পরিষ্কার হয় তখন হয়তো সেগুলোতেও বিএনপি সমর্থন দিতে পারে।
সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, ঐকমত্য কমিশনের বিপরীতে বিএনপির নিজস্ব ৩১ দফা আছে। এই ৩১ দফা সংস্কার নিয়ে তারা কিন্তু মাঠে অনেকদিন থেকে কাজ করছে। একদম প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৩১ দফাকে নিয়ে গেছে। কাজেই যখন ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বসে তখন মাথায় রাখে তাদেরও একটা সংস্করের দাবি বা কর্মসূচি আছে। তখন তারা তাদের ওই দফাগুলোকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে-এটাই স্বাভাবিক। এটা নিয়ে বিরোধ থাকবেই। কিন্তু এই বিরোধটাকে বড় কিছু মনে করি না। প্রস্তাবগুলো এভাবেই চলতে থাকবে আগামী দিনে। এভাবেই একটা জায়গায় এসে থামবে। যারা (ঐকমত্য কমিশন) সংস্কার প্রস্তাবগুলো দিয়েছে, তারা নিশ্চয়ই আশা করেননি, যা যা দিয়েছে হুবহু বাস্তবায়িত হবে। কিছু মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে সমাধান যদি না-ও হয়, যেগুলো একমত হবে সেগুলোও তো বাস্তবায়নের জন্য পরবর্তী সরকারের ওপর নির্ভর করতে হবে। কাজেই পরবর্তী সময়ে সরকার এসে কী করবে, তাদের দলীয় ফোরামে কতগুলো পাশ করাতে পারবে বা পারবে না এগুলো নিয়ে তো আলোচনা হবে। সুতরাং এগুলোকে ইতিবাচকভাবে দেখি।
তিনি আরও বলেন, বেশির ভাগ সুপারিশে বিএনপির সমর্থন অবশ্যই ইতিবাচক। পৃথিবীর যে কোনো আলোচনার ধর্মই তো এটি। তারা প্রথমে যাই বলুক না কেন, আলটিমেটলি কিন্তু তারা পরস্পরকে ছাড় দেবে। এরা কিছু ছাড় দেবে, ওরা কিছু ছাড় দেবে। এই যে ছাড় দেওয়ার মানসিকতাটা খুবই ইতিবাচক। বিএনপির মতো বড় দলগুলো যখন ছাড় দেবে, তখন ছোট দলগুলোও ছাড় দেবে।