ইসলাম ও ধর্ম ডেস্ক : মুসলিম জাতির নামকরণ নতুন কোনো বিষয় নয়। আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর আগে বহু নবী এই নাম ব্যবহার করেছেন। তাঁরা মুসলিম শব্দটি ব্যবহার করেছেন এক আল্লাহতে বিশ্বাসী, এক আল্লাহর ইবাদতকারী এবং আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসুলের আনুগত্যকারীদের জন্য। পবিত্র কোরআনে ইবরাহিম (আ.)-এর ব্যাপারে এসেছে—তিনি তাঁর অনুগত আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসীদের এই নাম প্রদান করেছিলেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি দ্বিনের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কোনো কঠোরতা আরোপ করেননি। এটা তোমাদের পিতা ইবরাহিমের ধর্ম, তিনি আগে তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলিম।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৭৮)
তিনি শুধু নাম দেননি, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ শরিয়তও তাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। আরবি শরিয়ত শব্দ দ্বারা মানুষের জীবন প্রণালী বা জীবনের পথনির্দেশনা বোঝানো হয়। মহানবী (সা.)-এর পূর্ববর্তী নবী-রাসুলদের শরিয়তগুলোর মধ্যে সমকালীন মানুষের অবস্থা ও সময়ের ভিন্নতার কারণে সামান্য ভিন্নতা ছিল। একজন নবীর পর অন্য নবী এলে এই সামান্য পরিবর্তনগুলো হতো। অবশেষে শেষ যুগের সর্বশেষ রাসুল মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমন ঘটে এবং ইসলাম ধর্মকে পূর্ণতা দান করা হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বিন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বিন মনোনীত করলাম।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৩)
মূলত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে পূর্ববর্তী রাসুলদের শরিয়ত বা জীবন বিধানকে পূর্ণতা দান করা হয়েছে। সুতরাং কিয়ামত পর্যন্ত তা কোনো পরিবর্তন ছাড়া অব্যাহত থাকবে। একই উম্মতে মুহাম্মদিকে জীবন বিধান, জীবনোপকরণের বিচারে স্বয়ং সম্পূর্ণ করা হয়েছে এবং তাদের পৃথিবীর অন্যান্য জাতির তত্ত্বাবধায়ক ও সাক্ষী বানানো হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘এভাবে আমি তোমাদের এক মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি, যাতে তোমরা মানবজাতির জন্য সাক্ষীস্বরূপ এবং রাসুল তোমাদের জন্য সাক্ষীস্বরূপ হবেন।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৪৩)
আগেই উল্লেখ করেছি—শরিয়ত হলো জীবন প্রণালী বা জীবন পরিচালনার নির্দেশনা। যা কিছু জীবনকে কঠিন করে তোলে, যা সংকীর্ণতা সৃষ্টি করে, তা জীবন প্রণালী বা নির্দেশনা নয়। শরিয়ত মানুষকে যে জীবনের নির্দেশ ও নির্দেশনা দেয়, তা অবশ্যই বাস্তবায়নযোগ্য, তা মানবজীবনকে সহজ করে, তা মানুষের মনুষ্যত্ব রক্ষা করে এবং তার মধ্যে অনুসরণযোগ্য মৌলিকত্ব রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ কোনো ব্যক্তিকে তার সাধ্যাতীত কোনো বিধান দান করেননি।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮৬)
অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজতা চান, তোমাদের প্রতি কঠোরতা চান না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৫)
শরিয়তে একদিকে যেমন নিজ স্রষ্টা, প্রভু ও প্রতিপালককে মান্য করার তাগিদ রয়েছে, অন্যদিকে তেমন আনুগত্য প্রকাশের জন্য সহজ-সাধ্য আমলের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে মানুষের মনুষ্যত্বের সঙ্গে মানানসই উত্তম স্বভাব ও অভ্যাস গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন কোরআনের বহুস্থানে বলা হয়েছে, তোমরা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করো এবং তাঁর ইবাদত করো। কোনো কিছুকে তাঁর সমকক্ষ জ্ঞান কোরো না। একাধিকবার বলা হয়েছে, তোমরা মা-বাবার অধিকার আদায় করো। কেননা তাঁরা তোমাদের প্রতিপালনে কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন। ইবাদতের নির্দেশ প্রদানের সময় নামাজের সঙ্গে সঙ্গে অসহায় মানুষের জন্য সম্পদ ব্যয় করতেও বলা হয়েছে। কোরআনে মানুষকে বারবার উত্তম স্বভাব ও চরিত্র গ্রহণে উৎসাহিত করা হয়েছে—যে কারো প্রতি অবিচার কোরো না, কারো অধিকার নষ্ট কোরো না, অশ্লীলতা ও নোংরামি কোরো না, কৃপণতা কোরো না, অর্থহীন কাজে সম্পদ ব্যয় কোরো না, পরস্পর মিলেমিশে চলো, অসহায় মানুষের পাশে থাকো এবং পারস্পরিক লেনদেন যার সঙ্গেই হোক ন্যায়ানুগভাবে করবে।
আল্লাহ পৃথিবীতে অসংখ্য বস্তু সৃষ্টি করেছেন, যাতে মানুষ তার প্রয়োজন ও জৈবিক চাহিদা পূরণ করে শরিয়তের ওপর আমল করতে পারে। আল্লাহ তাআলা তার পদ্ধতিও বলে দিয়েছেন যেন মানুষ বহুবিধ জিনিস থেকে সঠিকভাবে উপকৃত হতে পারে। সব দান ও অনুগ্রহের পরিবর্তে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সে যেন তার জীবনধারা এক আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে পরিচালনা করে। আর আল্লাহ সৃষ্টিজগতে জ্ঞান ও বিবেচনার দ্বারা উপকৃত হওয়ার যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং পৃথিবীতে জ্ঞানের বাহক বানিয়েছেন, তার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সে নিজেকে এবং সমাজকে আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালিত করবে। জীবন পরিচালনার এসব নির্দেশনা মানুষ নবী-রাসুলদের মাধ্যমে পেয়েছে।
মুসলমানের দায়িত্ব হলো, সে আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়ত নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করবে এবং অন্যদের সে অনুযায়ী জীবন গড়তে উৎসাহিত করবে, তাদের ইসলামের দাওয়াত দেবে। অন্য জাতিগোষ্ঠীর দায়িত্ব হলো, শরিয়তের স্বরূপ অনুসন্ধান করা এবং চিরন্তন সত্য মেনে নেওয়া। একদিকে আল্লাহর বিধি-বিধান জীবনে বাস্তবায়ন ও অন্যদের সেদিকে আহ্বান জানানো মুসলমানের দায়িত্ব, অন্যদিকে সমগ্র মানবজাতির দায়িত্ব হলো সঠিক ধর্মবিশ্বাস ও আমল গ্রহণ করা। আর এর মাধ্যমেই মানুষ পৃথিবীর অন্য সব সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করবে। পৃথিবীর শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যও মহান স্রষ্টার আনুগত্য অপরিহার্য। আল্লাহর আনুগত্য মানবজীবনের সর্বমহৎ উদ্দেশ্য। একজন মুসলিম, একটি মুসলিম সংগঠন, একটি ইসলামী প্রতিষ্ঠান জীবনের এই উচ্চ লক্ষ্য সামনে রেখে এগিয়ে যাবে। তারা নিজেদের এবং অন্যদের মহান স্রষ্টার উদ্দেশ্যের আলোকে যাচাই করবে; অতঃপর মানুষকে সৎপরামর্শ দেবে, নিজের সাধ্যানুসারে সত্য প্রচার করবে, যেন পথহারা মানুষগুলো সুপথের সন্ধান পায়। বর্তমানে পৃথিবীর সর্বত্র মনুষ্যত্ব অবিচার ও বিরোধিতার শিকার হচ্ছে। মানুষ কখনো কখনো পশুর অধম আচরণ করে। আমাদের কাজ হলো লেখা ও বলার মাধ্যমে তা প্রতিহত করার চেষ্টা করা।
তামিরে হায়াত থেকে
মো. আবদুল মজিদ মোল্লার ভাষান্তর