সমবায় মানে হলো সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে একে অপরের সহযোগিতামূলক কাজ করা। ‘সমিতি’ অর্থ দল বা সংঘ। এতে মূলত সবাই নিজের কাজ করে, আবার অন্যের কাজেও সহযোগিতা করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সংঘের ওপর রয়েছে আল্লাহর রহমত ও সাহায্যের হাত।’ (তিরমিজি: ৪৬৬)
সমবায়ের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধভাবে একে অপরকে সহযোগিতা করে সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণসাধন ইসলামের অন্যতম দর্শন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে তোমরা পরস্পরকে সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনে একে অপরকে সাহায্য করবে না। আল্লাহকে ভয় করবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।’ (সুরা-৫ মায়িদা, আয়াত: ২)
আল্লাহ আরও বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা স্বীয় দ্বীনকে খণ্ডিত করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের সঙ্গে আপনার কোনো সম্পর্ক নেই।’ (সুরা-৬ আনআম, আয়াত: ১৫৯)
সেবা, সহযোগিতা, সমঝোতা, সততা, সমতা, একতা, স্বেচ্ছাশ্রম, মিতব্যয়িতা ও সখ্য—এসবই সমবায়ের প্রধান উদ্দেশ্য। সমবায়ের মাধ্যমে নিজের ভাগ্যোন্নয়নের পাশাপাশি সমাজের সার্বিক সমৃদ্ধির প্রয়াসও থাকে। মূলত কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে সম্মিলিত প্রয়াসই হলো সমবায়।
সমবায়ের মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বলয় তৈরি হয়। কোরআন ও হাদিসে মানবজাতির প্রত্যেক সদস্যকে একে অপরের ভাই হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে
মানবসভ্যতার ইতিহাসের মতোই প্রাচীন সমবায়ের ইতিহাস। সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে সমবায়ের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সমবায়ের মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এক বন্ধনে আবদ্ধ হন, ফলে যেকোনো বড় কাজ সহজে সম্পন্ন করা যায়।
সমবায়ের মূল কথা সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সহযোগিতা। জনগণকে সংঘবদ্ধ করার একটি বড় মাধ্যম হলো সমবায়। ব্যক্তির আত্মপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ইসলামের লক্ষ্য; আর এ লক্ষ্য অর্জনে সমবায় একটি সহায়ক পন্থা, যার মাধ্যমে অর্জিত হয় বৃহত্তর মানবকল্যাণ।
সমবায়ের বহুবিধ উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জন, আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন, বড় বিনিয়োগের জন্য মূলধন সৃষ্টি, নৈতিক শিক্ষা, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সামাজিক উন্নয়ন, মধ্যস্বত্বভোগীদের উৎখাত, সেবার মানসিকতা গঠন, সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় করা, জনগণকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করা, আত্মনির্ভরশীল করে তোলা, সঞ্চয়ী মনোভাব গড়ে তোলা, পরামর্শভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থাপনা, আইনি সত্তা, আদর্শ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।
সমবায় সমিতির মূল লক্ষ্য হলো দরদি সমাজ গঠনে অংশগ্রহণ করা এবং সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও অন্যায় দূরীকরণ।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) তরুণ বয়সে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে একটি সেবাধর্মী সমবায় সংঘ গঠন করে সমাজকল্যাণে কাজ করেছেন। এ সমবায়ের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি ছিল সমাজ থেকে অন্যায় ও বৈষম্য দূর করা, নাগরিক ও আগন্তুকদের জীবন, সম্পদ ও মানসম্মান রক্ষায় সচেষ্ট থাকা, বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্প্রীতি ও সদ্ভাব স্থাপন করা, অত্যাচারিতদের রক্ষা করা এবং অত্যাচারীকে প্রতিহত করা।
জাতীয় ঐক্যের প্রতিও ইসলাম গুরুত্ব আরোপ করেছে। কোরআন মাজিদে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সম্মিলিতভাবে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়তার সঙ্গে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১০৩)
আবার বলা হয়েছে, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করো না, তা করলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে। আর ধৈর্য ধারণ করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা-৮ আনফাল, আয়াত: ৪৬)
সমবায়ের মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বলয় তৈরি হয়। কোরআন ও হাদিসে মানবজাতির প্রত্যেক সদস্যকে একে অপরের ভাই হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (সুরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১০) এক ভাই অন্য ভাইয়ের সাহায্য ও সহযোগিতায় সদা সচেষ্ট থাকবে, সুখ-দুঃখে অংশীদার হবে—এটাই স্বাভাবিক। এই হলো সমবায় সমিতি গঠনের মূল লক্ষ্য।
কোরআন করিমে বলা হয়েছে, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি; তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মানবতার কল্যাণে। তোমরা সৎকাজের আদেশ দেবে, অসৎ কাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখবে।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১১০)
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
