সম্প্রতি এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। বরাবর এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ভালো করে এসেছে আমাদের দেশে। পত্রপত্রিকায় ভালো ফল করা উচ্ছ্বসিত মেয়েদের ছবি সব সময়ই আমাদের মনে স্বস্তি জাগায়, গর্বিত করে। কিন্তু এবার পত্রিকার একটি সংবাদের শিরোনাম রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো।
মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার দুটি বিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীই পাস করেনি। বিদ্যালয় দুটি হলো পিরোজপুর সদর উপজেলার জুজখোলা সম্মিলিত মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় এবং ভান্ডারিয়া উপজেলার মধ্য চড়াইল মাধ্যমিক বিদ্যালয়। জুজখোলা সম্মিলনী বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক উত্তম হালদার বলেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠান থেকে এবার ১২ জনের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছিল। তার মধ্যে ৫ জন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। তাদের সবাই অকৃতকার্য হয়েছে। তিনি বলেন, তাঁদের সব ছাত্রী বিবাহিত হওয়ায় তারা ঠিকমতো ক্লাসে আসেনি। পত্রিকার সংবাদটি সত্যিই ধাক্কা দেওয়ার মতো।
মেয়েদের শিক্ষার হারের দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংকের ২০২১ সালের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে নারীশিক্ষার (১৫-২৪ বছর) হার প্রায় ৯৭। এই প্রতিবেদন আরও বলে, বাংলাদেশ শিক্ষাক্ষেত্রে লিঙ্গসমতা ৯৩ দশমিক ৩ শতাংশ অর্জন করেছে, যা একটি বড় সাফল্য। এসডিজি লক্ষ্য পূরণে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ সব ছেলেমেয়ের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার আশা রাখে—এ রকম আশাব্যঞ্জক পরিস্থিতিতে এ কেমন সংবাদ? এর উত্তর জানার জন্য আরেকটি তথ্য-উপাত্ত জানা জরুরি। তা হলো, বাংলাদেশে ক্রমেই আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে বাল্যবিবাহের হার।
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ মেয়ের ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায়। তার মানে, কিশোরীদের অর্ধেক সংখ্যার বেশি বাল্যবিবাহের শিকার। এই হার এশিয়ায় সর্বোচ্চ এবং সারা বিশ্বে অষ্টম সর্বোচ্চ।
আরও আশ্চর্য হলো দিন দিন এই সংখ্যা বাড়ছে, কমছে না। ২০২০ সালে মেয়েদের ১৮ বছরের আগে বিয়ের হার ছিল ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ, ২০২৩-এ এসে তা দাঁড়ায় ৪১ দশমিক ৬, আর ২০২৫-এ ৫১ দশমিক ৪ শতাংশে। ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ২০২০ সালে ছিল ৪ দশমিক ৯। ২০২৩-এ এসে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ২ শতাংশে, আর এখন গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ শতাংশে। তার মানে কি আমরা পেছন দিকে চলেছি?
বাল্যবিবাহ আর শিক্ষা—দুটি বিপরীতমুখী বিষয়; এটা আমরা সবাই জানি। বাল্যবিবাহের কারণে দেশে হাজার হাজার মেয়ে প্রতিনিয়ত স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে। একজন মেয়ে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর সে শিক্ষাবলয় থেকে চিরতরে ছুটে যায়। ২৪ শতাংশ মেয়ে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মা হয় এ দেশে। তাদের আর কখনোই স্কুলে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে আসা হয় না। কিন্তু কেন আমরা এগোতে এগোতে আবার পিছিয়ে পড়তে শুরু করেছি?
দেশের অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যা নারী। এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে অশিক্ষিত ও অন্ধকারে রেখে একটা দেশ কিছুতেই এগিয়ে যেতে পারে না
চাইল্ড ম্যারেজ অ্যাক্ট (২০১৭) অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিয়ের বয়স মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৮ আর ছেলেদের জন্য ২১ বছর নির্ধারণ করা এবং এর নিচে বিয়ের আয়োজন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও আমরা জানি, হরহামেশাই বাল্যবিবাহ হচ্ছে এবং কারও কোনো শাস্তি হচ্ছে না। এটি রোধ করতে কোনো সক্রিয় পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে না। যেন এটাই স্বাভাবিক—এমনটাই ধরে নিয়েছে সবাই। এর কারণ কী?
গবেষণা বলছে, অন্তত চারটি কারণে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার দ্রুত বেড়ে চলেছে।
এক. দারিদ্র্য। বাল্যবিবাহের শিকার ৬৪ শতাংশের বেশি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে, যারা মনে করে মেয়েটির বিয়ে দিলে অন্তত খাওয়ার একটি মুখ কমবে। তা ছাড়া পড়াশোনা করানোর সামর্থ্যও তাদের নেই।
দুই. যৌতুক। বিয়ের বাজারে কনের বয়স যত কম, তত তার ‘ডিমান্ড’ বেশি। কারণ, বিয়ের বয়স যত বেশি হয়, তত বেশি পরিমাণে যৌতুক দিতে হয় মা-বাবাকে। বেশি বয়সী মেয়ের জন্য ‘সুপাত্র’ও জোটানো মুশকিল। তাই অল্প বয়সে বিয়ে সেরে ফেলার প্রতি মা-বাবার আগ্রহ বেশি।
তিন. লিঙ্গবৈষম্য। সমাজে ছেলেশিশুর তুলনায় মেয়েশিশুরা কম আদৃত। মেয়েরা পরিবারের বোঝা বা বাড়তি দায় হিসেবে বিবেচিত হয়। একটি গবেষণা বলছে, অভিভাবকদের প্রতি ১০ জনের ৭ জনই মনে করেন যে কেবল বিয়েই একটি মেয়ের প্রকৃত পরিচয় ও সম্মান এনে দেয় সমাজে। যত দিন না মেয়েটির বিয়ে হয়, তত দিন সে সমাজে একটি সম্মানজনক অবস্থান খুঁজে পায় না।
চার. নিরাপত্তাহীনতা। এই কারণটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক কালে দেশে যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির হার এত বেড়েছে যে মেয়েশিশুর অভিভাবকেরা রীতিমতো আতঙ্কে থাকেন। মহিলা পরিষদের মতে, গত ১০ বছরে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
সমাজে বেড়েছে নারীর নিরাপত্তাহীনতা, বখাটেদের উৎপাত, অনলাইন বা ডিজিটাল হয়রানি, নানাভাবে সমাজে মেয়েদের হেয় করার প্রচেষ্টা। কেবল নির্যাতনই নয়, সেই নির্যাতনের ভিডিও বা ছবি ছড়িয়ে দিয়ে পরিবারকে সমাজচ্যুত করার ঘটনাও বেড়ে চলেছে। অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া এর একমাত্র সমাধান হিসেবে ধরে নিচ্ছেন অভিভাবকেরা। নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই প্রবণতা আরও বাড়িয়ে তুলছে।
দেশের অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যা নারী। এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে অশিক্ষিত ও অন্ধকারে রেখে একটা দেশ কিছুতেই এগিয়ে যেতে পারে না। সম্প্রতি নারীর প্রতি সহিংসতা ও নেতিবাচক মনোভাব এত বেড়েছে যে মেয়েরা সমাজে এবং পরিবারে আরও বেশি পিছিয়ে পড়তে শুরু করেছেন।
পিরোজপুরের বিদ্যালয় দুটির চিত্র রীতিমতো উদ্বেগজনক এবং দেশে মেয়েশিশুদের অন্ধকার ভবিষ্যৎকেই নির্দেশ করে। দুঃখের বিষয়, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রচেষ্টাও তেমন চোখে পড়ছে না। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী, যা আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। মেয়েদের শিক্ষার হার বাড়াতে হলে এবং বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হার কমাতে হলে সমাজে মেয়েশিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি।
তানজিনা হোসেন চিকিৎসক ও কথাসাহিত্যিক