ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দীর্ঘ এক বছরের যাচাই-বাছাই ও সর্বশেষ ১০ বিভাগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেও সব আসনে প্রার্থী ঠিক করতে পারেনি বিএনপি। তবে ৩০০ আসনের মধ্যে অর্ধেক অর্থাৎ ১৫০ জনকে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে।
এবার বিএনপি বৃহত্তর জোট গঠনের চেষ্টা করছে। ২৬০ আসন নিজেদের জন্য রেখে শরিকদের জন্য রাখছে ৪০ আসন। নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আসলে তাদের দিতে চায় ৮টি আসন।
এক বছর আগে থেকেই বিএনপি বিভিন্নভাবে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রার্থী বাছাই শুরু করে। এক পর্যায়ে সারাদেশে ৩০০ আসনের জন্য প্রায় ৯০০ সম্ভাব্যপ্রার্থীর একটি তালিকা করে। দলের কজন সিনিয়র নেতা এই তালিকা বিএনপি হাইকমান্ডের কাছে দেয়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিভিন্ন মাধ্যমে এই তালিকায় থাকা সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার পর নির্বাচন কমিশন রোডম্যাপ ঘোষণা করে। এরপর বিএনপি হাইকমান্ড প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করতে বিভিন্ন জেলা ও মহানগরের নেতাদের নিয়ে ধারাবাহিক বৈঠক করে দল গোছানোর পাশাপাশি ৩০০ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজখবর নিতে থাকে। সম্ভাব্যপ্রার্থীরাও নিজেদের মনোনয়ন নিশ্চিত করতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। এক পর্যায়ে অধিকাংশ সংসদীয় আসনে বিএনপির একাধিক প্রার্থী নির্বাচনী প্রচার চালাতে থাকলে স্থানীয় নেতাকর্মীরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। কোনো কোনো এলাকায় এক পক্ষ আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে কাদাছোড়াছুড়ি শুরু করলে বিএনপি হাইকমান্ড বিব্রত হয়।
এমন পরিস্থিতিতে ২৬ ও ২৭ অক্টোবর দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ঢাকায় বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে ডেকে এনে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করা হয়। এ বৈঠকে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছাড়াও অন্যান্য সিনিয়র নেতা উপস্থিত ছিলেন। আর লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি উপস্থিত থেকে দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
২৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম, কুমিল্লা (প্রস্তাবিত), ময়মনসিংহ, ফরিদপুর (প্রস্তাবিত) ও রংপুর বিভাগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের নিয়ে বৈঠক হয়। পরদিন ২৭ অক্টোবর ঢাকা, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের নিয়ে বৈঠক হয়। উভয় বৈঠকেই তারেক রহমান ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জ মন্তব্য করে বলেন, এ নির্বাচনে বিজয় লাভ করতে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা বলেন।
সারাদেশে ৩০০ আসনে যাকে যেখানে মনোনয়ন দেওয়া হবে, সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে তার পক্ষে কাজ করার কথা বলেন। তা না করে কেউ বিশৃঙ্খলা করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। তবে দল ক্ষমতায় গেলে ত্যাগী নেতাকর্মীদের নিজ নিজ যোগ্যতা অনুসারে সবাইকে মূল্যায়ন করা হবে।
সূত্র জানায়, সারাদেশের প্রায় ৮০০ মনোনয়ন প্রত্যাশীকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠন, শরিকদের কিছু আসন ছেড়ে দেওয়া এবং নির্বাচনের সার্বিক কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। দুদিনের বৈঠকেই বিএনপির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তুলে ধরে আবেগঘন বক্তব্য রাখেন তারেক রহমান। তারেক রহমানের বক্তব্য শুনে অনেক মনোনয়ন প্রত্যাশীও আপ্লুত হয়ে পড়েন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় প্রার্থী ঠিক করতে ১০ বিভাগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের নিয়ে বৈঠক করা হয়। এ বৈঠকে যে আসনে যাকে প্রার্থী করা হয়, তার জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে দলের বিজয় নিশ্চিত করার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি কেউ বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও সবাইকে জানিয়ে দেন।
সূত্র জানায়, এবার প্রায় ৪০টি সমমনা দল নিয়ে জোটগতভাবে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজ দলের প্রার্থী চূড়ান্ত করার পাশাপাশি শরিক দলগুলোর মধ্যে সংসদীয় আসন বণ্টন নিয়ে এখন চলছে দরকষাকষি। এবার ৩০০ আসনের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪০টি আসন ছাড়বে বিএনপি। এর মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বিএনপির সঙ্গে জোটে আসলে ৮টি আসন ছাড়তে চায় । এ বিষয়ে প্রাথমিক আলাপ-আলোচনা চলছে বলে জানা যায়। আর বৃহত্তর জোট হলে কমপক্ষে ২৬০ আসন নিজ দলের প্রার্থীদের জন্য রাখবে বিএনপি। তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে আরও সময় লাগবে বলে সংম্লিষ্ট সূত্র জানায়।
সূত্র জানায়, বিএনপির সঙ্গে জোট করে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে ছোট-বড় প্রায় ৪০টি সমমনা রাজনৈতিক দল আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তারা এখনই বিএনপির সঙ্গে আসন বণ্টনের বিষয়টি ফয়সালা করে ফেলতে চায়। তবে এই ৪০টি দলের মধ্যে কিছু দল কোনো আসন পাবে না। আবার কোনো কোনো দল একাধিক আসন পাবে। যেই দলগুলো আসন পাবে না, তারা সমমনা অন্য দলের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবে এবং ভোটের পর তাদের বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করা হবে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অন্য দলগুলো বিএনপির সঙ্গে জোট করলেও ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে পারবে কি না তা অনিশ্চিত।
কারণ, সংশোধিত আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) অনুসারে নির্বাচনে জোট করলেও প্রতিটি দলকে নিজ নিজ প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে। যদিও বিএনপি ও তাদের সমমনা কটি দল সংশোধিত আরপিওতে থাকা এই নিয়ম বাদ দিয়ে আগের মতো জোট করলেও যে কোনো দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের সুযোগ রাখতে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছেন।
ইতোমধ্যেই সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির দুই দফা বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসন বণ্টনের বিষয়টি প্রধান্য পেয়েছে। বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘদিন যুগপৎ আন্দোলনে থাকা প্রায় ৪০টি সমমনা দলের মধ্যে অধিকাংশ দলই সংসদ নির্বাচনে আসন দাবি করেছে। কোনো কোনো দল কয়েকটি করে আসন পাওয়ার দাবিও করেছে। সব মিলিয়ে সমমনা দলগুলো প্রায় ১০০ আসন দাবি করেছে। এর বাইরে এনসিপিসহ আরও কটি দল বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন করতে আগ্রহী।
তবে বিএনপির পক্ষ থেকে কাউকে কাউকে মৌখিকভাবে আসন ছাড়ার আশ্বাস দিলেও চূড়ান্তভাবে কথা দেয়নি। বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদেরও শরিক দলকে কিছু আসন ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি বিভাগীয় বৈঠকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে আসনে শরিক দলকে আসন ছেড়ে দেওয়া হবে, সেখানে বিএনপি নেতাকর্মীদের তার পক্ষে কাজ করার আহ্বানও জানানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিভাগের একটি আসনে বিএনপির একজন সিনিয়র নেতাকে সবুজ সংকেত দেওয়ায় ওই আসনে মনোনয়ন বঞ্চিত এক তরুণ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশে যাকে যেখানে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে, তার পক্ষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে বিএনপির ১০ বিভাগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে।

