মুক্তমঞ্চ ও সাহিত্য-সংস্কৃতি ডেস্ক, এইউজেডনিউজ২৪: সম্প্রতি আমার একটা পদোন্নতি হয়েছে । একই সাথে কর্মস্থলেরও পরিবর্তন হয়েছে । আমার মত চাকুরীজীবীদের জন্য পদোন্নতি এবং বদলি অতি সাধারণ বিষয় । ব্যতিক্রম কোন কিছু নয় । তারপরও তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে এ ধরণের যে কোন বিষয় ফেসবুকে চলে আসে । অনেক ক্ষেত্রে ভাইরাল হয় । আমার নিজের ক্ষেত্রেও অনেকটা তাই হয়েছে । অনেক গুরুজন, সুপ্রিয় সহকর্মী, আত্মীয় এবং ফেসবুক বন্ধু আমার পদোন্নতি ও বদলির বিষয় উল্লেখ করে আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন এবং দোয়া করেছেন । তবে, আমার পদমর্যাদা এক একজন এক এক ভাবে উল্লেখ করেছেন । কেউ বলেছেন সচিবের পদমর্যাদায় মহাপরিচালক, কেউ বলেছেন সচিব, কেউ বলেছেন গ্রেড ওয়ান ইত্যাদি ইত্যাদি ।
আমি গ্রাম থেকে উঠে এসেছি । গ্রামের মানুষ কারো নাম বা পদ- পদবী নিয়ে কোন ঘোরপ্যাঁচ রাখতে চান না । একেবারে সরল শটকাট করতে চান । আমাদের গ্রামের মবুভাইকে সারাজীবন মবুভাই হিসেবে জেনেছি । তিনি মারাও গেছেন মবু নামে । কৌতূহলবসে পরে জেনেছি তার প্রকৃত নাম ছিল মহব্বত হোসেন । কিন্তু জীবনে কখনও তিনি তাঁর এই সুন্দর নামটি কাউকে বলার বা কারো মুখ থেকে শোনার সুযোগ পাননি । তাতে গ্রামের মানুষের কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি । গ্রামের যে কেউ কোন সরকারি বা বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করলেই, তিনি অধ্যাপক হয়ে যান । গ্রামের মানুষ কলেজের লেকচারার বা সহকারী অধাপক –এসব পদ বুঝতে চান না । ১৯৮৯ সালে আমি যখন ৩য় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাকুরীতে যোগদান করি, তখন থেকেই আমাদের গ্রামের বাড়িকে মানুষ ম্যাজিস্ট্রেট বাড়ি বলেছেন । আবার ১৯৯২ সালের দিকে যখন আমি মন্ত্রণালয়ে সহকারি সচিব হিসেবে যোগদান করি; তখন থেকে আমাদের বাড়ি ‘সচিবের বাড়ি’ নামে পরিচিত । যখন সিনিয়র সহকারি সচিব হয়েছি, তখন আমার গ্রামের মানুষ মাঝখানের ‘সহকারি’ বাদ দিয়ে আমাকে সিনিয়র সচিব বলেছেন । তাই এত বছর পর যখন আমার পদবি সচিব পদমর্যাদা, না সচিব নিয়ে কথা হচ্ছে, তখন আমার গ্রামের মানুষ কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খান । তাঁরা মনে করেন, তাহলে এতকাল উনি কি ছিলেন ?
আমি অর্থনীতির ছাত্র । অর্থনীতির ছাত্র নিয়ে একটা কৌতুক আছে । বলা হয় অর্থনীতি বিষয়ে ৫ জন ব্যক্তি যদি একই কথা বলেন, তাহলে ধরে নিতে হবে তাঁরা অর্থনীতির ছাত্র নয় । আর যদি দাবি করা হয় তাঁরা অর্থনীতির ছাত্র, তাহলে ধরে নিতে হবে তাঁরা ৫ জনই পাগল । তারমানে অর্থনীতি বিষয়ে ভিন্নমত থাকবেই । তবে, শুধু অর্থনীতি নয়, যে কোন বিষয়েই ভিন্নমত থাকা স্বাভাবিক । আর আমার মনে হয়, ভিন্নমত থাকাই একটা আলাদা সৌন্দর্য । সুপ্রাচীন কাল থেকেই কোন রেকর্ডপত্রের প্রমানক হিসাবে মানুষের বৃদ্ধ আঙুলের ছাপ নেয়া হয় । কারণ, পৃথিবীর অন্য কোন মানুষের আঙুলের ছাপের সাথে এই ছাপ মিলবে না । মানুষের একটি আঙুলের সামান্য একটি অঙ্গের সাথে অন্য একজন মানুষের অঙ্গের যদি এত অমিল থাকে, তাহলে গোটা একজন মানুষের সাথে অন্য একজন মানুষের কত অমিল থাকার কথা ? তারমানে একজন মানুষের কথা ও কাজের সাথে অন্য একজন মানুষের কথা ও কাজের অমিল থাকাই স্বাভাবিক । তাই, ভিন্নমত মেনে নেওয়াই যুক্তিসংগত । অথচ, বাস্তবে কারো সাথে কোন বিষয়ে কথার অমিল হলে বা ভিন্নমত হলেই আমরা উত্তেজিত হই । এটা বোধহয় ন্যায়সঙ্গত নয়; কারণ, এতে ভিন্নমতের যে একটি সৌন্দর্য থাকে, তা নষ্ট হয় ।
এত কথা বলার কারণ একই বিষয়ে আমার একজন ফেসবুক বন্ধুর মন্তব্য । তাঁর মন্তব্য নিম্নরূপঃ
‘একজনের সচিব পদায়নে জাতি জানতে পারল তার কত ভাই, ভাইপো, বোন ও ভাগ্নে/ ভাগ্নি আছে’ ।
এই মন্তব্যের মধ্যে এক ধরণের মুনশিয়ানা আছে । এতে ব্যঙ্গ করা হয়েছে, না প্রশংসা করা হয়েছে- তা পরিস্কার নয় । যিনি মন্তব্য করেছেন, তিনি প্রয়োজনে এই মন্তব্যের যে কোন দিকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ রেখেছেন । আমি নিজে সবকিছুর ভাল দিক নিয়ে কথা বলি । খারাপ কিছু আলোচনা করা আমার কাজ নয় । কারণ, আমাদের সমাজে কোন কিছুর খারাপ দিক নিয়ে আলোচনা করার লোকের অভাব নেই । তাঁদের কাজ তাঁরা করবেন । আমি এই মন্তব্যের ভাল দিকটাই বলি ।
আমরা যারা কোন না কোনভাবে সমাজের একটা উঁচু স্তরে উঠে এসেছি, আমাদের শিকড় অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত । দুরের ও কাছের কত না, কতভাবে যে আমাদের আত্মীয়স্বজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন , পদোন্নতির মত একটি সাধারণ ঘটনায়ও তা প্রকাশ পায় । ফেসবুকের মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থাকার কারণে, এই প্রকাশ অনেক সহজ হয়েছে । তাই, আমার পদোন্নতির মত একটি রুটিন বিষয়েও রক্তের সম্পর্কসহ, বন্ধুবান্ধব, সুপ্রিয় সহকর্মী বা অন্য কোন না কোনভাবে যারা আমার আত্মীয়, তাঁরা আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন । অনুপ্রাণিত করেছেন । এজন্য আমি কৃতজ্ঞ । আমার বেতন ও সুযোগ সুবিধায় তাঁরা যে ভাগ বসাবেন- তা নয় । তাঁরা শুধু চান একটা স্বীকৃতি । তাঁরা যে, কোন না কোনভাবে আমার আত্মীয়, আমার দিক থেকে সেই স্বীকৃতি চান । তাঁদের পক্ষে এই ধরণের চাওয়া কি অপরাধ ? আর আমার দিক দিক থেকে তা স্বীকার করা কি অপরাধ ?
আমার বদলি ও পদোন্নতি বিষয়ে আমি নিজে যেটা বুঝি, তা হল সরকার আমাকে একটি নতুন দায়িত্ব দিয়েছেন । আমি বেতন স্কেলের ২ নম্বর গ্রেডে চাকুরী করতাম । এই দায়িত্ব প্রদানের পাশাপাশি আমাকে জাতীয় বেতন স্কেলের ১নং গ্রেডের আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে । এজন্য সরকার প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ । যে বিশ্বাস থেকে সরকার আমাকে এই গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছেন; আমি যেন যথাযথভাবে সেই দায়িত্ব পালন করতে পারি- এটাই আমার একমাত্র চাওয়া ।
আমার বদলি ও পদোন্নতির সংবাদ জেনে যারা আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, তাঁদেরকে আলাদাভাবে জবাব না দিয়ে, এই লেখার মাধ্যমে সকলের প্রতি আমি আমার গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি । আমি যেন যথাযথভাবে আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারি- সেই দোয়া চাই সকলের কাছে ।
সকল প্রকার করোনা যোদ্ধাদের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ।