জ্ঞান মহান আল্লাহর এক অনুপম দান, যা মানুষের চিন্তা, চরিত্র ও জীবনদৃষ্টিকে আলোকিত করে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে এমন কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন, যা ব্যক্তি ও সমাজের জীবনে মৌলিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম।
নিম্নে তাঁর সাতটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা সুপাঠ্যভাবে উপস্থাপন করা হলো, যা জ্ঞানের পথকে আলোকিত করে।
মহানবী (সা.) শুধু তথ্যভিত্তিক জ্ঞান নয়; বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মানবকল্যাণে কাজে লাগে, এমন জ্ঞানের জন্য দোয়া করতেন।
১. জ্ঞানার্জন: একটি ফরজ ইবাদত
ইসলামে প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জনকে ফরজ বা অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর–নারীর ওপর ফরজ।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৪)
এই হাদিস শিক্ষাকে শুধু সামাজিক দায়িত্ব নয়; বরং ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করে।
২. কল্যাণকর জ্ঞানের জন্য দোয়া
মহানবী (সা.) শুধু তথ্যভিত্তিক জ্ঞান নয়; বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মানবকল্যাণে কাজে লাগে, এমন জ্ঞানের জন্য দোয়া করতেন। তিনি বলতেন, ‘হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে উপকারী জ্ঞান ও সৎ আমল কামনা করি।’ (সুনানে নাসাঈ, হাদিস: ৭,৮১৮)
এই দোয়া জ্ঞানের গুণগত মানের ওপর গুরুত্ব দেয়। উপকারী জ্ঞান মানুষকে আত্ম–উন্নয়ন, সঠিক চিন্তাধারা ও সৎ পথে পরিচালিত করে, যা ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণে অবদান রাখে।৩. জ্ঞানীর মর্যাদা
জ্ঞানী ব্যক্তির মর্যাদা সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সব কিছু, এমনকি সমুদ্রের মাছ পর্যন্ত জ্ঞানীর জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৩,৬৪১)
নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সব কিছু, এমনকি সমুদ্রের মাছ পর্যন্ত জ্ঞানীর জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে।
সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৩,৬৪১
এই হাদিস জ্ঞানার্জনের প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। জ্ঞানী ব্যক্তি দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত হন, কারণ তাঁর জ্ঞান সমাজের কল্যাণে কাজ করে।
৪. নারীর শিক্ষার গুরুত্ব
ইসলাম নারী শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে, যা মহানবী (সা.)-এর জীবন থেকে স্পষ্ট। হযরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, একজন নারী নবীজি (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, পুরুষেরা আপনার হাদিস শুনছেন, আমাদের জন্যও একটি দিন নির্ধারণ করুন, যেন আমরা আপনার কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।’
নবীজি (সা.) তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট দিনে তাঁদের শিক্ষা দেন। এমনকি তিনি বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যার তিনটি সন্তান মারা যাবে, তারা তার জন্য জাহান্নামের আগুনের আবরণস্বরূপ হবে।’
একজন নারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দুটি সন্তান মারা গেলেও কি তা–ই হবে?’ তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, দুটি মারা গেলেও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১০১, ৭৩১০)
এ ঘটনা ইসলামে নারী শিক্ষার গুরুত্ব এবং নারী-পুরুষের সমান শিক্ষার অধিকারকে প্রমাণ করে। শিক্ষিত নারী শুধু নিজের জীবনই নয়, পরিবার ও সমাজের উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৫. জ্ঞানের প্রচার ও প্রসার
জ্ঞান কেবল নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য নয়; বরং তা সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও অন্যদের কাছে পৌঁছে দাও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫,০৬৪)
এই নির্দেশনা শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের গুরুত্ব তুলে ধরে। জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব, যা মানবকল্যাণে অবদান রাখে।তোমরা আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও অন্যদের কাছে পৌঁছে দাও।
সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫,০৬৪
৬. প্রশ্ন করার মাধ্যমে জ্ঞানার্জন
জ্ঞানার্জনের জন্য প্রশ্ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘জ্ঞান হলো ভান্ডার, আর এর চাবিকাঠি হলো প্রশ্ন করা।’ (হিলয়াতুল আওলিয়া, ৩/১৯২)
সঠিক প্রশ্ন জ্ঞানের গভীরতা বাড়ায় এবং মানুষকে সঠিক পথ ও উপলব্ধির দিকে নিয়ে যায়। এটি শিক্ষার্থীদের কৌতূহলী ও সৃজনশীল হতে উৎসাহিত করে।
৭. শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা
শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি মহানবী (সা.) বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘প্রত্যেক শিশু স্বভাবগতভাবে ইসলামের ওপর জন্ম নেয়। অতঃপর তার পিতা-মাতাই তাকে ইহুদি, খ্রিষ্টান বা অগ্নিপূজক বানায়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৬৫৮)
এই হাদিস থেকে স্পষ্ট যে শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা ও লালন-পালনের দায়িত্ব পিতা-মাতার ওপর অর্পিত। সঠিক শিক্ষা ও সংস্কার শিশুর ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অবহেলা সন্তানের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
মহানবী (সা.)-এর এই সাতটি নির্দেশনা শিক্ষার গুরুত্ব ও এর প্রয়োগ সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা প্রদান করে। জ্ঞানার্জন, তা প্রচার, নারী শিক্ষা, শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা এবং প্রশ্ন করার মাধ্যমে জ্ঞানের গভীরতা বৃদ্ধি—এসবই ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখে। এই নির্দেশনাগুলোর অনুসরণ ব্যক্তিকে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতার শিখরে পৌঁছে দিতে পারে।