ইসলাম ও ধর্ম ডেস্ক : পবিত্র কোরআনের বর্ণনা মতে বনি ইসরাঈলকে একটি জনপদে প্রবেশের আদেশ করা হয়েছিল। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যখন আমি বলেছিলাম, এই জনপদে প্রবেশ কোরো; তার যেখানে চাও সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে খাওয়া-দাওয়া কোরো; আর ‘ক্ষমা কোরো’ বলতে বলতে মাথানত করে ফটকে প্রবেশ কোরো; আমি তোমাদের পাপগুলো ক্ষমা করে দেব এবং নেককারদের আরো বেশি দেব।’ (সুরা বাকারা : ৫৮)
তাফসিরবিদরা শহরটির নাম ‘বায়তুল মাকদিস’ বলে উল্লেখ করেছেন [ইবন আবি হাতিম, ১/১১৬; ইবনুল জাওজি, জাদুল মাসির, ১/৮৪; তাবারি, ১/১০২-১০৩; সুদ্দি, ১১৪; আব্দুল রাজ্জাক, ১/৪৬]।
মুসলিমদের কাছে জেরুজালেম ‘আল-কুদস’ ও বায়তুল ‘মাকদাস’ নামে পরিচিত। আল-কুদস মানে পবিত্র আর বায়তুল মাকদিস মানে সুলাইমান (আ.) কর্তৃক তৈরি পবিত্র ইবাদতগৃহ। (আল-মুজামুল ওয়াসিত)
জেরুজালেম শব্দের উৎপত্তি : জেরুজালেম শব্দটি ‘ইউরোসালেম’ থেকে এসেছে, যা একটি কেনানি শব্দ। আরব ইয়াবুসি গোত্রের প্রথম শাসকের উপাধি ছিল ‘সালিম’। সালিম অর্থ শান্তিপ্রিয়। তিনি শান্তিপ্রিয় ছিলেন বলে তাকে সবাই এই উপাধিতে ভূষিত করে। তার প্রকৃত নাম ছিল মালিক ইবনে সাদিক। ইয়াবুসি কোনো এক শাসক জেরুজালেমে ইবরাহিম (আ.)-কে স্বাগত জানান এবং আঙুর ও রুটি দিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন। (আল-আকসা ওয়াল কুদস, আল-ফাতাহ মুক্তি সংস্থার পুস্তিকা)
জেরুজালেমের আয়তন : জেরুজালেম প্রাকৃতিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত। পুরনো জেরুজালেম ও নতুন জেরুজালেম। ১৯৪৮ সালে দুই জেরুজালেমের মোট আয়তন ছিল ৪১ বর্গকিলোমিটার। আধুনিক জেরুজালেম ভূ-মধ্যসাগর ও মৃত সাগরের মধ্যবর্তী যোধাইয়ান পর্বতের মালভূমিতে সম্প্রসারিত হয়ে প্রায় ১২৫ বর্গ কিলোমিটারে ব্যাপ্তি লাভ করেছে। জনসংখ্যা প্রায় আট লাখ ৮২ হাজার ৬৫২ জন। তম্মধ্যে ইহুদি ৬৪ শতাংশ, আরব ৩৪ শতাংশ বাকি এক শতাংশ হচ্ছে অন্যান্য ধর্ম ও গোত্রের। আর পুরনো জেরুজালেম আধুনিক জেরুজালেমের অভ্যন্তরে অবস্থিত ০.৯ বর্গ কিমি (০.৩৫ বর্গ মাইল) আয়তনবিশিষ্ট চারদিকে দেয়ালঘেরা অঞ্চল। দেয়ালের দৈর্ঘ্য চার কিলোমিটার এবং উচ্চতা বারো মিটার। ১৫৩৬ সালে উসমানীয় সুলতান সুলাইমান পাঁচ বছরে এই দেয়াল নির্মাণ করেন।
তিন ধর্মের তীর্থ : পুরনো শহরটি ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু স্থান আছে। যেমন—মুসলিমদের কাছে ডোম অব দ্য রক ও আল-আকসা মসজিদ, ইহুদিদের কাছে টেম্পল মাউন্ট ও পশ্চিম দেয়াল এবং খ্রিস্টানদের কাছে চার্চ অব দ্য হলি সেপালচার। ১৯৮১ সালে এই অঞ্চলটি ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়।
প্রাচীন ধর্ম গ্রন্থে জেরুজালেম : বাইবেল অনুযায়ী খ্রিস্টপূর্ব ১১০০ শতকে রাজা দাউদের জেরুজালেম জয়ের আগে শহরটি জেবুসীয়দের বাসস্থান ছিল। জেবুসীয় কিংবা ইয়াবুসীয় রাজা মালিক ইবন সাদিক শহরটি নির্মাণ করেছিলেন। এ সম্প্রদায়ের লোকেরা শহরে বাড়ি-ঘর নির্মাণ করেন এবং ‘সাহইউন’ পাহাড়ের ওপর প্রতিরক্ষা দুর্গ তৈরি করেন। তারা আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিল। নবী মুসা (আ.)-এর ইন্তিকালের পর বনি ইসরাঈল ইউশা ইবন নুনের নেতৃত্বে জেরুজালেমে প্রবেশ করে। তারপর ৪৪০ খ্রিস্টপূর্বের দিকে পারস্য আমলে নেহেমিয়া ব্যাবিলন থেকে ফিরে আসেন ও শহরটি পুনর্নির্মাণ করেন। ৩২২ খ্রিস্টপূর্ব সালে আলেকজান্ডার মাকদুনির হাতে পরাজয়বরণ করার পর জেরুজালেমে বনি ইসরাঈলের কর্তৃত্বের অবসান হয়। রাজা দাউদ কর্তৃক শাসিত শহরটি পুরনো শহরের দেয়ালের দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত। তারপর রাজা সুলাইমান শহরের দেয়াল সম্প্রসারিত করেন।
কোরআনে জেরুজালে : পবিত্র কোরআনে কোথাও শহরটির নাম সরাসরি উল্লেখ হয়নি; কিন্তু শহরটির বিষয়ে বহু তথ্য আছে। যেমন—
১. শহরটির একটি পাহাড়ের নাম কোরআনে বিধৃত হয়েছে ‘জায়তুন’ নামে। (সুরা ত্বিন, আয়াত : ১-১)
২. এটা ছিল কোরআনে বিধৃত ‘জালুত’ বাদশাহর রাজ্য। (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৫১)
৩. তারপর তা আরেক বাদশাহ ‘তালুতের শাসনাধীন হয়। (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৪৭-২৪৮)
৪. অবশেষে সে রাজ্যের নেতৃত্বে আসেন নবী দাউদ (আ.)। (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৫১)
৫. তাঁর পর রাজ্যের উত্তারাধিকার লাভ করেন নবী সুলাইমান (আ.)। (সুরা বাকারা, আয়াত : ১০২)
৬. পুরনো জেরুজালেম শহরের দক্ষিণ-পূর্বদিকে রয়েছে ‘বায়তুল মাকদিস’ মসজিদ। পবিত্র কোরআনে মসজিদটি উল্লেখ করা হয়েছে ‘আল-আকসা’ নামে। (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ১)
৭. মসজিদটির ‘মিহরাব’ নামক কক্ষটিও বিধৃত হয়েছে কোরআনে। সেখানে মারইয়াম (আ.) ইবাদত করতেন এবং তাঁর জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে খাবার আসত। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৩৭)
৮. এটা ছিল ইসরার শেষ প্রান্ত ও মিরাজের প্রারম্ভ বিন্দু, যার চারপাশ বরকতময় এবং একই সঙ্গে আল্লাহর নিদর্শনে পরিপূর্ণ। (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ১)
৯. এখানে সে-ই কিবলা রয়েছে যার দিকে নবীজি (সা.) প্রায় ষোলো-সতেরো মাস পর্যন্ত মুখ করে সালাত পড়েছিলেন। নবীজি (সা.)-এর ইচ্ছা হতো কাবার দিকে মুখ করে সালাত পড়ার—যা ইবরাহিম (আ.)-এর কিবলা ছিল। (সুরা বাকারা : ১৪২-১৪৩)
দুঃখের নগরী : জেরুজালেম একই সঙ্গে ঐতিহ্য ও দুঃখের নগরী। এ নগরীর পবিত্রতা নিয়ে মতভেদ না থাকলেও নিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে আছে নানা বিতর্ক। সুরা বাকারার ২৫৯ নম্বর আয়াতে এমন একটি ইতিহাস তুলে ধরেছে, যেখানে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী উজায়ির (আ.) বিধস্ত জেরুজালেম নগরটিতে উপনীত হয়েছিলেন। (ইবনে আতিয়া আন্দালুসী : ১/৩০৬; তাবারি, ৫/৪৪২-৪৪৩)
ঐতিহাসিকরা নিশ্চিত করেছেন যে নগরীতে বনি ইসরাঈলের সীমালঙ্ঘনের কারণে প্রথমবার ব্যাবিলনীয় বাদশাহ বখতে নসর কর্তৃক ধ্বংসলীলা সংঘঠিত হয়। নবী ঈসা (আ.) তাদের দ্বিতীয়বার বিপর্যয়ের মুখে পড়ার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু তাদের নানাবিধ সীমালঙ্ঘনের পরিপ্রেক্ষিতে তাইমুস নামক রোমান শাসক জেরুজালেম আক্রমণ করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করে। কোরআন দ্বিতীয় বিপর্যয়ের দৃশ্যপটটিও তুলে ধরেছে। (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৭)
দ্বিতীয় ধ্বংসের পর ওই নগরীতে ইহুদিদের নেতৃত্ব চিরতরে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যে জনপদকে আমি ধ্বংস করেছি তার অধিবাসীদের ফিরে আসা নিষিদ্ধ। অবশেষে যখন ইয়াজুজ ও মাজুজকে মুক্তি দেওয়া হবে এবং তারা প্রতিটি উচ্চভূমি হতে দ্রুত ছুটে আসবে।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৯৫-৯৬)
অবশেষে ইহুদিরা ১৯৪৮ সালে সে-ই জনপদে ফিরে এসেছে। আর সে জনপদে আল্লাহ নির্ধারিত নীতি ক্রমাগত বাস্তবায়িত হচ্ছে। তা হলো, ‘তোমরা যদি তোমাদের পূর্বআচরণের পুনরাবৃত্তি করো; তবে আমিও পুনরাবৃত্তি করব। (সুরা বনি ইসরাঈল : ৮)
আল আকসায় সাহাবিদের কবর : বর্তমানে মসজিদে আকসার পূর্বদিকে একটি দরজার নাম ‘বাবুর রাহমাহ’।
সে দরজা সংলগ্ন মুসলিম কবরস্থানে শুয়ে আছেন সাহাবি উবাদাহ ইবনে সামিত (রা.) ও শাদ্দাদ ইবন আউস (রা.)। সপ্তম শতকে (৬৩৭ সালে) খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাবের শাসনামলে মুসলিমরা জেরুজালেম জয় করেছিলেন।
এ শহর অপেক্ষা করছে আরেক সিপাহশালারের। তিনি চতুর্থ আসমান থেকে অবতীর্ণ হয়ে দাজ্জালের সন্ধানে সে শহরের ‘লুদ’ নামক স্থানে পৌঁছাবেন। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সন্তানরা তাঁর নেতৃত্বে সেখানে লড়াইয়ে হাজির হবে। একদিন এ শহরের শান্তি ফিরে আসবে, শান্তি ফিরবে পুরো দুনিয়ায়। (সংক্ষেপিত)
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।