পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভাব ও স্বৈর দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ ছিল মজলুম নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা। ১৯৪৯ সালে এই দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নিবার্চনে বিজয় এবং ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক জেনারেল আইয়ুব খানকে পরাজিত করার লক্ষ্য নিয়ে সম্মিলিত বিরোধী দল বা কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি-কপ প্রতিষ্ঠা ছিল পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বমূলক আন্দলোনের মাইলফলক। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকারের প্রশ্ন ১৯৫০-এর মধ্যভাগ থেকে উচ্চারিত হতে থাকে।
১৯৬০ দশকের মাঝামাঝি থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ধারণাটি প্রকৃষ্ট হতে শুরু করে। ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হয়। ১৯৬৯-এ আইয়ূব খানের পতন হয়, তবে সামরিক শাসন অব্যাহত থাকে। সামরিক সরকারের অধীনে ১৯৭০-এ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
আওয়ামী লীগ এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনৈতিকদের ষড়যন্ত্রের কারণে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর থেকে বিরত থাকেন।
পূর্ব পাকিস্তান (১৯৪৭-১৯৭১) ছিল পাকিস্তানের পূর্ব অঙ্গ যা ১৯৭১-এ স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত বিভক্ত করে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা ভারত ও পাকিস্তান। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এই সময়কে পাকিস্তান আমল হিসেবে পরিচিত ছিল।
মুসলিম আধিক্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সীমানা চিহ্নিত করা হয়, যার ফলে মানচিত্রে দুটি পৃথক অঞ্চল গড়ে ওঠে। তৎকালীন পূর্ব বঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশ যার একটি পূর্ব পাকিস্তান এবং অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল প্রধানত পূর্ব বঙ্গ নিয়ে, যা বর্তমানের বাংলাদেশ।
এবার চলে আসি কিভাবে ভাষার লড়াই তার একটি সারসংক্ষেপ..১৯৫০ সালে ভূমি সংস্কারের অধীনে ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তীত জমিদার ব্যবস্থা রদ করা হয়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যাগত গুরুত্ব সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানিদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সংঘাতের প্রথম লক্ষণ হিসেবে প্রকাশ পায়।
পরবর্তী দশকজুড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়ে নানা পদক্ষেপে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ মানুষের মনে বিক্ষোভ দানা বাধতে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে লক্ষণীয় চড়াই, উৎরাই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে মায়ের ভাষার লড়াই গুরুত্ব পায়।
এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এক নতুন সূর্য উধিত হয় ১৯৫২’র মহান ২১ ফেব্রুয়ারির। যদিও আরও বিশেষ দিন রয়েছে ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে কিন্তু সময় আর ইতিহাস বলে ৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান দ্বারা অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে তৎকালীন মুসলীম লীগ সরকারের উপর। তার প্রতিফলন ঘটে ১৯৫৪ সালের ৮ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারর্দীর নেতৃত্বে গঠিত মোর্চা যুক্তফ্রন্ট তাদের ২১ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে নির্বাচনে বিপুল বিজয় লাভ করে সরকার গঠন করে।
কিন্তু ১৯৫৪ সালের ৩০ মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নরের শাসন জারি করে। স্বায়ত্তশাসন থেকে বঞ্চিত করা হয় পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশের জনগণকে।১৯৬৬ সালে ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬ দফা দাবি পেশ করেন।
ছয় দফার দাবির মূল উদ্দেশ্য-পাকিস্তান হবে একটি Federal বা যৌথরাষ্ট্র এবং ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে এই Federation বা যৌথরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। পরবর্তীতে এই ৬ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার করা হয়। এই আন্দোলনকে শিথিল করার উদ্দেশ্যে সরকার মে মাসে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে।
এবং পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরও কিছু বাঙালি সেনা, নৌবাহিনীর সদস্য ও প্রশাসনের পদস্থ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে একটি ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। এই মামলার বিরুদ্ধে গণআন্দোলন পরবর্তীতে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
১৯৬৯ সালে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ প্রবল রূপ ধারণ করে। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচি পেশ করেন। কিন্তু তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খান এই দাবি অগ্রাহ্য করে আন্দোলনকারীদের উপর দমনপীড়ন শুরু করেন। এই আন্দোলনের বিভিন্ন ঘটনায় প্রাণ হারান ছাত্রনেতা আসাদ, কিশোর মতিউর, সার্জেন্ট জহুরুল হক, শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাসহ আরও অনেকে।
এইসব ঘটনায় সরকারের উপর চাপ বৃদ্ধি পেলে ২২ ফেব্রুয়ারি সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল বন্দিদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। অবশেষে আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন এবং ২৪ মার্চ তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে ইয়াহিয়া খান সাধারণ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিলে বিক্ষোভের অবসান হয়।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় পরিষদের নির্বাচন এবং ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের ৫টি প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন। উভয় পরিষদের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬০ আসন অধিকার করে। অন্যদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি ৮৮ আসন অধিকার করে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মর্যাদা লাভ করে।
১৯৭১ এর ২৫ মার্চের আগে ঢাকা থেকে সব বিদেশি সাংবাদিককে বের করে দেয়া হয়। সে রাতেই পাকিস্তান বাহিনী শুরু করে অপারেশন সার্চলাইট নামের হত্যাযজ্ঞ। যদিও এই হত্যাযজ্ঞে মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকা, পুরো দেশজুড়ে বাঙালি হত্যা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো ছিল তাদের বিশেষ লক্ষ্য। মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়কে পাকিস্তানি হায়েনার দল রোমহর্ষক বর্বরতা চালায় ওই মুহূর্তে। একমাত্র হিন্দু আবাসিক হল-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী।
এতে ৬০০ থেকে ৭০০ আবাসিক ছাত্র নিহত হয়। যদিও পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ধরনের ঠাণ্ডা মাথার হত্যাকাণ্ডের কথা অস্বীকার করেছে তবে হামিদুর রহমান কমিশনের মতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপক শক্তি প্রয়োগ করেছিলো।
জগন্নাথ হল এবং অন্যান্য ছাত্র হলগুলোতে পাকিস্তানীদের হত্যাযজ্ঞের চিত্র ভিডিওটেপে ধারণ করেন তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি বর্তমান বুয়েট অধ্যাপক নূর উল্লাহ। হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ বিভিন্ন ধর্মাবালম্বীরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয় এই দেশটিতে।
মধ্যরাতের আগেই, ঢাকা পুরোপুরি জ্বলছিল, বিশেষভাবে পূর্ব দিকের হিন্দু প্রধান এলাকাগুলো। ২ আগস্ট, ১৯৭১ টাইম সাময়িকীর প্রতিবেদন অনুযায়ী হিন্দু, যারা শরণার্থীদের (রিফিউজি) তিন চতুর্থাংশ, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ক্রোধ ও আক্রোশ বহন করছিল।
১৯৭১’র এইদিনে লাখো প্রাণের বিনিময়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশের মানুষ অর্জন করে দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল আজকের স্বাধীনতা। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে যে স্বাধীনতা, আমরা পেয়েছি যে বিজয়… সেই বিজয় অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো এদেশেরই কিছু মানুষরূপী নরপশু।
লাখো শহীদের রক্তে আর মা-বোনদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে কেনা আমাদের মাতৃভূমি। বিজয়ের ৪৭ বছরে সেই নরপশুদের বিচার হচ্ছে। সত্যি অন্যরকম স্বাধ, অভিপ্রায়- যে রাষ্ট্রনামক যন্ত্রটি তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় বিজয়ের উল্লাসের মধ্য দিয়ে অত্রিক্রম করছে। সত্যিই স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ এখন আর পরাধীন নয়। লাল-সবুজের মানচিত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার হওয়ার একটু আগে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর (অর্থাৎ ২৬ মার্চ) টিএন্ডটি ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) ওয়ারলেসের মাধ্যমে মেসেজে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড,পৃ:৫৬)।
২৫ মার্চ রাতের হত্যাযজ্ঞে আওয়ামী লীগের অনেক প্রধান নেতা ভারতে আশ্রয় নেয়। ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতারের কয়েকজন কর্মকর্তা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এমএহান্নান প্রথম শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রটি মাইকিং করে প্রচার করেন।
পরে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেন। (সূত্র : মেজর জিয়ার বেতার ঘোষণা এবং বেলাল মাহমুদের সাক্ষাৎকার) এই সময় তার সাথে উপস্থিত ছিলেন কর্নেল অলি আহমেদ (তৎকালীন ক্যাপ্টেন)।
সরাসরি সেনাবাহিনীর থেকে আহ্বান পাওয়ার পর সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটে এবং দেশের মানুষ নিশ্চিত হয় যে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। স্বাধীন স্বার্বভৌম একটি দেশ আজ বিজয়ের নিশান উড়িয়ে দিয়ে আমার, আপনার ও আমাদের মতো নতুন প্রজন্মকে জানতে, শিখাতে সাহস যুগিয়েছে।
আর এ ফলশ্রুতিতে বাঙালি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মানচিত্রে সত্যিকারের ইতিহাস তুলে ধরতে পেরেছে। যার প্রেক্ষাপটে কয়েক লাখ বাঙালি আপামর জনতার রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক-কবি-গবেষক