ইসলাম ও ধর্ম ডেস্ক, আজনিউজ২৪: প্রথম নবী আদম (আ.) থেকে শুরু করে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সব নবী-রাসুলই ছিলেন মানবজাতির জন্য শিক্ষক। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৯)
মুয়াবিয়া (রা.) বলেন, ‘তাঁর জন্য আমার বাবা ও মা উৎসর্গিত হোক। আমি তাঁর আগে ও পরে তার চেয়ে উত্তম কোনো শিক্ষক দেখিনি। আল্লাহর শপথ! তিনি কখনো কঠোরতা করেননি, কখনো প্রহার করেননি, কখনো গালমন্দ করেননি।’ (সহিহ মুসলিম)
মহানবী (সা.) যেভাবে পাঠদান করতেন
রাসুল (সা.)-এর শিক্ষাপদ্ধতির কিছু দিক তুলে ধরা হলো—
উপযুক্ত পরিবেশে শিক্ষাদান : শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ অপরিহার্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত পরিবেশের অপেক্ষা করতেন। জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নিশ্চয়ই বিদায় হজের সময় রাসুল (সা.) তাকে বলেন, মানুষকে চুপ করতে বলো। অতঃপর তিনি বলেন, আমার পর তোমরা কুফরিতে ফিরে যেয়ো না…।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭০৮০)
ভাষা ও দেহভাষার সমন্বয় : রাসুলুল্লাহ (সা.) কোনো বিষয়ে আলোচনা করলে তাঁর দেহাবয়বেও তার প্রভাব প্রতিফলিত হতো। যাতে বিষয়ের গুরুত্ব, মাহাত্ম্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে শ্রোতা-শিক্ষার্থীরা সঠিক ধারণা লাভে সক্ষম হয়। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) যখন বক্তব্য দিতেন তাঁর চোখ লাল হয়ে যেত, আওয়াজ উঁচু হতো এবং ক্রোধ বৃদ্ধি পেত, যেন তিনি (শত্রু) সেনা সম্পর্কে সতর্ককারী।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৩)
গল্প বলার মিষ্টি ভঙ্গি : গল্প-ইতিহাস জ্ঞানের সমৃদ্ধ এক ভাণ্ডার। রাসুল (সা.)-ও পাঠদানের সময় গল্প বলতেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘দোলনায় কথা বলেছে তিনজন : ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.)…। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি (মুগ্ধ হয়ে) রাসুল (সা.)-এর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তিনি আমাকে শিশুদের কাজ সম্পর্কে বলছিলেন। তিনি তার মুখে আঙুল রাখলেন এবং তাতে চুমু খেলেন। ’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৮০৭১) অর্থাৎ তিনি শিশুদের মতো ঠোঁট গোল করে তাতে আঙুল ঠেকালেন।
শিক্ষার্থীর কাছে প্রশ্ন করা : রাসুল (সা.) পাঠদানের সময় শিক্ষার্থীদের কাছে প্রশ্ন করতেন। যেন তারা প্রশ্ন করতে এবং তার উত্তর খুঁজতে অভ্যস্ত হয়। মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করেন, হে মুয়াজ! তুমি কি জানো বান্দার কাছে আল্লাহর অধিকার কী? তিনি বলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ভালো জানেন। রাসুল (সা.) বলেন, তাঁর ইবাদত করা এবং তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক না করা।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৩৭৩)
উপমা দিয়ে বোঝানো : নবী করিম (সা.) অনেক সময় কোনো বিষয় স্পষ্ট করার জন্য উপমা ও উদাহরণ পেশ করতেন। সাহাল ইবনে সাদ (রা.) বলেন রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমি ও এতিমের দায়িত্ব গ্রহণকারী জান্নাতে এমনভাবে অবস্থান করব। সাহাল (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) তাঁর শাহাদাত ও মধ্যমা আঙুলের প্রতি ইঙ্গিত করেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০০৫)
শিক্ষার্থীর প্রশ্ন গ্রহণ ও প্রশংসা করা : আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে প্রশ্ন করে, আমাকে বলুন! কোন জিনিস আমাকে জান্নাতের নিকটবর্তী করে দেবে এবং কোন জিনিস জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে নেবে। নবী করিম (সা.) থামলেন এবং তার সাহাবাদের দিকে তাকালেন। অতঃপর বললেন, তাকে তাওফিক দেওয়া হয়েছে বা তাকে হিদায়াত দেওয়া হয়েছে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১২)
আমলের মাধ্যমে শিক্ষাদান : শিক্ষার সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হলো প্রাকটিক্যাল বা প্রয়োগিক শিক্ষা। রাসুল (সা.) বেশির ভাগ বিষয় নিজে আমল করে সাহাবিদের শেখাতেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা নামাজ আদায় করো, যেমন আমাকে আদায় করতে দেখো।’ (সুনানে বায়হাকি, হাদিস : ৩৬৭২)
রেখাচিত্রের সাহায্যে স্পষ্ট করা : কখনো কখনো কোনো বিষয়কে স্পষ্ট করার জন্য রাসুল (সা.) রেখাচিত্র ও অঙ্কনের সাহায্য নিতেন। আবু মাসউদ (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) একটি চারকোনা দাগ দিলেন। তার মাঝ বরাবর দাগ দিলেন, যা তা থেকে বের হয়ে গেছে। বের হয়ে যাওয়া দাগটির পাশে এবং চতুষ্কোণের ভেতরে ছোট ছোট কিছু দাগ দিলেন। তিনি বললেন, এটি মানুষ। চতুষ্কোণের ভেতরের অংশ তার জীবন এবং দাগের যে অংশ বের হয়ে গেছে সেটি তার আশা।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৪১৭)
গুরুত্বপূর্ণ কথার পুনরাবৃত্তি : রাসুল (সা.) তাঁর পাঠদানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তিনবার পর্যন্ত পুনরাবৃত্তি করতেন। আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) তাঁর কথাকে তিনবার পুনরাবৃত্তি করতেন, যেন তা ভালোভাবে বোঝা যায়।’ (শামায়েলে তিরমিজি, হাদিস : ২২২)
ভুল সংশোধন : রাসুলুল্লাহ (সা.) ভুল সংশোধনের মাধ্যমে শ্রোতা ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতেন। এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে অভিযোগ করে যে, হে আল্লাহর রাসুল! আমি নামাজে অংশগ্রহণ করতে পারি না। কারণ অমুক ব্যক্তি নামাজ দীর্ঘায়িত করে ফেলে।… রাসুল (সা.) বলেন, ‘হে লোকসকল! নিশ্চয়ই তোমরা অনীহা সৃষ্টিকারী। সুতরাং যে মানুষ নিয়ে (জামাতে) নামাজ আদায় করবে, সে তা যেন হালকা করে (দীর্ঘ না করে)। কেননা তাদের মধ্যে অসুস্থ, দুর্বল ও জুল-হাজাহ (ব্যস্ত) মানুষ রয়েছে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৯০)
শারীরিক শাস্তি পরিহার : গুরুতর অপরাধের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো তাঁর শিষ্য ও শিক্ষার্থীদের শাস্তি দিয়ে সংশোধন করতেন। তবে রাসুল (সা.) বেশির ভাগ সময় শারীরিক শাস্তি এড়িয়ে যেতেন। ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতেন। যেমন—উপযুক্ত কারণ ছাড়া তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করায় কাব ইবনে মালিক (রা.)-সহ কয়েকজনের সঙ্গে রাসুল (সা.) কথা বলা বন্ধ করে দেন, যা শারীরিক শাস্তির তুলনায় বেশি ফলপ্রসূ ছিল।