আলোচিত ‘জুলাই সনদ’ চূড়ান্ত করতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবারও আলোচনায় বসছে। আগামী ১৭ জুন ঢাকার রমনায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এটি হবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ডাকে দ্বিতীয় অধিবেশনের দ্বিতীয় বা শেষ বৈঠক।
সূত্র মতে, জাতীয় ঐক্য কমিশনের এই বৈঠকে জুলাই ঐক্য ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনা হবে। এই আলোচনায় কোনো কোনো বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত আর কোনো কোনো বিষয়ে একমত না বা আংশিকভাবে একমত তাও চূড়ান্ত করা হবে। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হবে।
এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, আগামী সপ্তাহে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এই বৈঠক হবে। বৈঠকে জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ নিয়ে আলোচনা হবে। আমাদের কাজ একটা ঐকমত্যে পৌঁছানো। সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেসব সুপারিশ চূড়ান্ত হবে, সেটি নিয়েই গঠিত হবে চূড়ান্ত ‘জুলাই সনদ’।
কতটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা হবে- জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, প্রায় ৩০টির মতো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক হবে। যত দ্রুত সম্ভব আলোচনা শেষ করা হবে।
সূত্র মতে, এই ঘোষণাপত্রকে জুলাই চার্টার নামে বা ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ নামেও অভিহিত করা হতে পারে। জাতীয় ঐক্য কমিশনের চেয়ারম্যান ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সব দলের মতামতের ভিত্তিতে ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলোতে দলগুলোর সম্মতি স্বাক্ষরও নিতে চান। যাতে এগুলো মৌলিক ও অপরিবর্তনীয় সংস্কার হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলো আর পরিবর্তন করতে না পারে।
সূত্র আরও জানায়, নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত প্রায় ৩০টি রাজনৈতিক দলকে এবারের অধিবেশনে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। আজ রবিবার বা আগামীকাল সোমবার রাজনৈতিক দলগুলোকে চিঠি, মেসেজ বা ফোন কলে বৈঠকের আমন্ত্রণ জানানো হবে।
ইতোপূর্বে দু’দফা আলোচনায় সরকারের স্থায়িত্বের জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের আস্থা ভোটের পক্ষে বিএনপি, এনসিপিসহ কয়েকটি দল ঐকমত্য পোষণ করেছে। তবে কোনো কোনো দল বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনার জন্য বলেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামি প্রস্তাব দিলেও বিএনপি তাতে বিরোধীতা করে বলেছে, বিএনপি চায় না তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হোক। এনসিপিও দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন চেয়েছে। সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদ বিরোধী দল থেকে নেওয়াসহ অন্য ইস্যুতেও সব রাজনৈতিক দল একমত হতে পারেনি।
এ সব বৈঠকে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, নিম্নকক্ষে নারী আসন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নির্ধারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ও কার্যপরিধির একটি অংশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আলোচনা করে। তবে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি রাষ্ট্রীয় সংস্কার ইস্যুতে এসব বৈঠকেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠে।
সর্বশেষ বৈঠকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, ‘সংস্কার কার্যক্রমে বিভিন্ন কমিশনের প্রস্তাবই চূড়ান্ত নয়। রাজনৈতিক দলগুলো যে সব মতামত দিয়েছে, সে আলোকে পরিবর্তিত প্রস্তাব নিয়েই জাতীয় সনদ (জুলাই সনদ) করা হবে। আমরা চাই এমন কিছু ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে চাই, যেখানে সব রাজনৈতিক দল অন্তত ন্যুনতম পর্যায়ের ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে এবং সেগুলো সংরক্ষণ করা যায়। সেটাই এই সংলাপের মূল উদ্দেশ্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘কিছু কিছু বিষয়ে হয়তো একমত হওয়া যাবে। তবে প্রত্যেক দলই তাদের নিজ নিজ অবস্থান, দলীয় ইশতেহার এবং রাজনৈতিক অভিপ্রায় ধরে রাখবে। তবে কোনো দল যদি অতিরিক্ত কিছু যুক্ত করতে চায়, তাদের সেই মতামত প্রকাশের সুযোগ থাকবে। জাতীয় সনদে আমরা কেবল সে সব প্রস্তাবই অন্তর্ভুক্ত করতে চাই, যেগুলোতে আপনাদের সম্মতি থাকবে। আমরা আলাদাভাবে প্রতিটি দলের সঙ্গে আলোচনা না করে সম্মিলিত সংলাপের পথ বেছে নিয়েছি, যাতে পারস্পরিক যুক্তি-বিশ্লেষণের মাধ্যমে অবস্থানে পরিবর্তন আসতে পারে। সেই বিবেচনায় একটি কাঠামো দাঁড় করাতে চাই আমরা।’
বিগত বৈঠকগুলোতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে কিনা, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন। এসব বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়, বিএনপি চায় না তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হোক। তবে জামায়াতে ইসলামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে জোরালো অবস্থান প্রকাশ করে। অপর দল এনসিপিও দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছে। তবে বৈঠকে অংশ নেওয়া কিছু রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে একমত হতে পারেন নি।
এ ছাড়া সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদ বিরোধী দলকে দেওয়া নিয়ে স্পষ্ট মতবিরোধ রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। তবে সংসদের ডেপুটি স্পিকারের পদটি প্রধান বিরোধী দল থেকে নেওয়ার সুপারিশে তেমন কোনো দ্বিধাবিভক্তি ছিল না। এ ব্যাপারে বিএনপিসহ বেশিরভাগ দলগুলো বলেছে, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদে প্রধান বিরোধী দল থেকে নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে তারা একমত নয়। কয়েকটি কমিটিতে প্রধান বিরোধী দল থেকে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে, তবে সব স্থায়ী কমিটিতে প্রধান বিরোধী দল থেকে নিয়োগ দেওয়াকে তারা বাস্তবসম্মত প্রস্তাব মনে করেন না।
সূত্র মতে, এ সব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেখানে যেখানে মতবিরোধ কিংবা বিভক্তি রয়েছে, এবারের শেষ পর্যায়ের আলোচনায় সব ইস্যুতে ঐকমত্যে আনার চেষ্টা করা হবে। যে সব সুপারিশে দ্বিমত থেকেই যাবে, সেগুলো বাদ দিয়ে ঐকমত্যে হওয়া ইস্যুগুলো নিয়েই ‘জুলাই সনদ’ চূড়ান্ত করে তা জাতির সামনে প্রকাশ করা হবে। এরপরই পুরো নির্বাচনের পথে যাত্রা করবে পুরো দেশ।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ফের ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক ১৭ জুন
দেশজুড়ে
7,647 Views