রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও সিনেটের ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার। এদিন সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত ক্যাম্পাসের ৯টি একাডেমিক ভবনে স্থাপিত ১৭টি ভোটকেন্দ্রে ভোট গ্রহণ হবে। এরপর বিকেল পাঁচটা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে কেন্দ্রীয়ভাবে ফলাফল গণনা শুরু হবে। ১৭টি কেন্দ্রের ফলাফল সর্বোচ্চ ১৭ ঘণ্টার মধ্যে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছে রাকসুর নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচনের প্রস্তুতির সবশেষ নিয়ে আজ বুধবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক এফ নজরুল ইসলাম। পরে নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মোস্তফা কামাল আকন্দ সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। লিখিত বক্তব্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, তাঁরা আনন্দের সঙ্গে জানাতে চান, নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। তাঁদের মূল লক্ষ্য একটি অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়া। তাই প্রতিটি ধাপে নির্বাচনকে বিতর্কমুক্ত রাখতে তাঁরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছেন।
এবারের রাকসু নির্বাচনে ২৮ হাজার ৯০১ জন ভোটার ৮৬০ জন প্রার্থীকে ভোট দেবেন বলে উল্লেখ করেন নজরুল ইসলাম। তিনি জানান, ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে ৯টি একাডেমিক ভবনে স্থাপিত ১৭টি ভোটকেন্দ্রে। কেন্দ্রীয় রাকসুর ২৩টি পদে মোট ৩০৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে রয়েছে সহসভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদ। সিনেটের ছাত্র প্রতিনিধির পাঁচটি পদে ৫৮ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। অন্যদিকে ১৭টি হল সংসদের ২৫৫টি পদে মোট ৫৫৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মোট ভোটারের ৩৯ দশমিক ১০ শতাংশ নারী, ৬০ দশমিক ৯০ পুরুষ।
নির্বাচনী দায়িত্বপ্রাপ্ত ২১২ জন শিক্ষকের মধ্যে ১৭ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা এবং অবশিষ্ট শিক্ষকেরা সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা হিসেবে ভোট পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন বলে জানান প্রধান নির্বাচন কমিশনার। ৯১ জন কর্মকর্তা পোলিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বলেও জানান তিনি।
রাকসু নির্বাচন ঘিরে নিরাপত্তাব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন নজরুল ইসলাম। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুই হাজার পুলিশ সদস্য, ছয় প্লাটুন বিজিবি ও ১২ প্লাটুন র্যাব পুরো ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। প্রতিটি ধাপে পূর্ণ নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখার ব্যবস্থা নিয়েছে কমিশন। নির্বাচনপ্রক্রিয়ার প্রতিটি কার্যক্রম সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় থাকবে। ভোট গ্রহণে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ব্যবহার করা হবে। অভিজ্ঞ-বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে গণনা ও ফলাফল প্রস্তুত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
প্রশ্নোত্তর
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের লিখিত বক্তব্যের পর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন রাকসুর অন্যতম নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মোস্তফা কামাল আকন্দ।
রাকসু নির্বাচন ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকার মানুষের প্রভাব পড়তে পারে—এমন আলোচনার বিষয়ে একজন সাংবাদিকের প্রশ্ন করেন।
উত্তরে মোস্তফা কামাল আকন্দ বলেন, রাকসু নির্বাচন ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে স্থানীয়দের বিষয়টি নিয়ে তাঁরা যথাযথভাবে প্রশাসনের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার আলোচনা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শুধু তার নিজস্ব ক্যাম্পাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগীয় শহরে অবস্থিত। এখানকার জনগোষ্ঠী যাঁরা আছেন, তাঁরাও এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক সময় সহযোগিতা করেন, সংশ্লিষ্ট থাকেন। ফলে স্থানীয়-অস্থানীয়—এ ধরনের কোনো বিভেদ তাঁরা করছেন না। সবাই এখানে নির্বাচনকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য ইতিবাচকভাবে সহযোগিতা করছেন।
নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা প্রসঙ্গে আরেক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন। এর জবাবে এই অধ্যাপক বলেন, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তাঁরাই প্রথম ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কাজটি শুরু করেছিলেন। যদিও বিশেষ কারণে তাঁরা সবার শেষে নির্বাচন করছেন। তাঁরা মনে করেন না, এতে করে কোনো ক্ষতি হয়েছে। নির্বাচনের ফলাফলের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে তিক্ত অভিজ্ঞতা, সেগুলো তাঁদের অনেক শিক্ষা দিয়েছে। তাঁরা এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন, সতর্ক আছেন। ফলাফল প্রকাশে তাঁরা স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত সময় নেবেন না।
এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার মোস্তফা কামাল আকন্দ বলেন, ১৭টি হলের জন্য ১৭টি ভোটকেন্দ্র করা হয়েছে। ২৮ হাজার ৯০১ জন ভোটারের প্রত্যেকে ছয় পৃষ্ঠার ব্যালটে ভোট দেবেন। তাঁরা হিসাব করে দেখেছেন, সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত সাত ঘণ্টা ভোট গ্রহণ হলে প্রত্যেক ভোটার ১০ মিনিট করে সময় পেলেও এই সময়েই ভোট সম্পাদন করতে পারবেন। চারটায় ভোট শেষ হয়ে যাওয়ার পর পাঁচটার মধ্যে তাঁরা গণনা শুরু করবেন। ১৭টি কেন্দ্রের ফল তাঁরা সর্বোচ্চ ১৭ ঘণ্টার মধ্যে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। ভোট দেওয়ার পর শিক্ষার্থীদের আঙুলে অমোচনীয় কালির দাগ উঠে যাওয়া নিয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। রাকসুর ক্ষেত্রে এ ধরনের বিতর্ক এড়াতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে—জানতে চান সাংবাদিক। নির্বাচন কমিশনার মোস্তফা কামাল আকন্দ বলেন, তাঁরা শুধু অমোচনীয় কালির ওপর নির্ভর করছেন না। তাঁরা থ্রিডি লেভেলের (ত্রিমাত্রিক পর্যায়) নিরাপত্তাব্যবস্থা রেখেছেন। যে শিক্ষার্থী পরিচয়পত্র নিয়ে আসবেন, প্রথমে সেটির অথেন্টিসিটি যাচাই করা হবে। শুধু পরিচয়পত্র হলেই হবে না, তাঁর ভোটার আইডির জন্য একটি ইউনিক আইডি দেওয়া হয়েছে। সেটিও যাচাই করা হবে। এরপর তাঁর ছবিযুক্ত ভোটার আইডি আছে। সেটি তাঁরা মিলিয়ে ভোটারের পরিচয় নিশ্চিত করবেন। এ বিষয়ে কোনো ধরনের সন্দেহ তৈরি হলে একটি বিশেষ গোপনীয় কিউআর কোডও আছে। পুরো প্রক্রিয়াকে তাঁরা বলছেন, থ্রি ডাইমেনশনাল সিকিউরিটি (ত্রিমাত্রিক নিরাপত্তা)। এটিকে অগ্রাহ্য করে কোনো অবস্থাতেই ভোট জালিয়াতি করার সুযোগ নেই।
ডাকসুর ব্যালট নীলক্ষেতে ছাপানো নিয়ে নির্বাচনের পরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। রাকসুর ব্যালট ছাপানোর ক্ষেত্রে বিতর্কের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাওয়া হয়। অধ্যাপক মোস্তফা কামাল আকন্দ বলেন, তাঁরা এমন কোনো সংস্থা থেকে ব্যালট পেপার তৈরি করেননি। এই বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাসংক্রান্ত কাজে যাদের অভিজ্ঞতা আছে, তাদের আট ধরনের সিকিউরিটি চেক (নিরাপত্তা যাচাই) করে এই দায়িত্বটি দেওয়া হয়েছে। সবাইকে তাঁদের ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান তিনি।
কমিশনার মোস্তফা কামাল আকন্দ বলেন, ‘রাকসু নির্বাচন নিয়ে আমরা অনেক ধরনের ভিত্তিহীন ও অগ্রহণযোগ্য কিছু কথাবার্তা শুনেছি। কিন্তু আমরা বলতে চাই, কোনো অবস্থাতেই ভোটারসংখ্যার অতিরিক্ত কিংবা ভোটারসংখ্যার কম ব্যালট পেপার ছাপানোর কোনো আইন পৃথিবীতে কোথাও নেই। ২৮ হাজার ৯০১ জন ভোটারের জন্য ২৮ হাজার ৯০১টি ব্যালটই ছাপানো হয়েছে। এর বাইরে কেন্দ্রে একটিও কম যাবে না, একটিও বেশি যাবে না।’
সাংবাদিকদের জন্য রাকসুর নির্বাচন কমিশনের ইস্যু করা কার্ডের মান নিয়ে এক সাংবাদিক প্রশ্ন তোলেন। এর জবাবে দুঃখ প্রকাশ করেন নির্বাচন কমিশনার মোস্তফা কামাল আকন্দ।