বধ্যভূমি হয়ে ওঠা গাজায় প্রতিদিন শিশুসহ নরহত্যা ‘উৎসব’ চলছে। এখন শুরু হয়েছে অপুষ্টি ও অনাহারে মৃত্যু। সঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মাথা গোঁজার ঠাঁই। সব দেখে এখন বুঝতে পারি মানুষের বিবেক ও চেতনারও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। গাজায় যাঁরা অবিরাম নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছেন, তাঁদের তো এখন জৈবশক্তির জোরেই টিকে থাকতে হচ্ছে।
আক্রমণকারী শক্তি ইসরায়েল নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত রণাঙ্গন ছাড়বে বলে মনে হয় না। অতীতে দেখা যেত, সংঘাতের বাইরের দর্শক বাকি বিশ্বের নেতাদের চাপে এমন নিষ্ঠুরতা থামাতে হতো। হামাসের ৭ অক্টোবরের (২০২৩) হামলার প্রতিশোধ নেওয়া শুরু করেছিল ইসরায়েল নভেম্বর থেকে। তার মিত্রদের যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত পশ্চিম ইউরোপের পরামর্শে তারা ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ একবার যুদ্ধবিরতি মেনে ছিল; কিন্তু তারপর মার্চ থেকে আবারও পূর্ণোদ্যমে গাজার নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণের ওপর যে নৃশংস হামলা শুরু করেছে, তা আর বন্ধ করছে না।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির সব প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিয়ে ইসরায়েলের অবিরাম নিষ্ঠুরতার পক্ষে কাজ করে চলেছে, শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ বন্ধ করে নিজেরাও সাম্প্রতিককালের এই গণহত্যার অংশীজন হয়ে গেল। মোটকথা তারা শান্তি আলোচনার সুযোগ রুদ্ধ করে রেখেছে। প্রায় ২১ মাসের একতরফা হামলার মধ্যে ইসরায়েল তার লক্ষ্য কয়েক দফায় বিস্তৃত করেছে। এটা তারা করেছে মুরব্বি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপীয় মিত্রদের নব্য ঔপনিবেশিক নীলনকশার পুরোভাগের বাহিনী হিসেবে।
পুরো বিশ্বের ওপর পশ্চিম ইউরোপীয় সাতটি দেশের আধিপত্যের শুরু মহাসাগরীয় অভিযাত্রার কালে (পঞ্চদশ–অষ্টাদশ শতাব্দী) দুই আমেরিকা ও সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়ায় স্থানীয় ভূমিসন্তানদের নির্মম-নিষ্ঠুরতায় সম্পূর্ণ, কোথাও আংশিক বিনাশ করে ইউরোপীয় বসতি স্থাপনের মাধ্যমে। দীর্ঘ লাগাতার চক্রান্ত, মিথ্যা আশ্বাস এবং চরম নিষ্ঠুরতার পরও যারা বেঁচে গিয়েছিল, তাদের নিজস্ব ভাষা-কৃষ্টির ওপর ঔপনিবেশিক ইউরোপীয় ভাষা-সংস্কৃতির বাধ্যতা চাপানো হয়েছিল, যেমনটা ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের উত্তরাধিকারের দায় আমাদেরও বইতে হয়েছে, হচ্ছে।
যে দুটি মহাদেশ পূর্ণাঙ্গ দখলের বাইরে ছিল, সেই এশিয়া ও আফ্রিকায় তারা উপনিবেশ স্থাপন করে অবিরাম লুণ্ঠন ও নিষ্পেষণ চালিয়ে গেছে। এভাবে শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী ঊনবিংশ শতক নাগাদ বিশ্বের ভূমি এবং সম্পদ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতেই পুঞ্জীভূত হয়ে যায়।
বিশ্বের ভূমি ও সম্পদের ওপর দখল কায়েমের প্রকল্প ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর ঠান্ডা মাথার পরিকল্পনায় হয়েছিল। ১৮৮১ সালে প্রাশিয়ার জেনারেল অটো ফন বিসমার্ক বার্লিনে নিজেদের মধ্যে আফ্রিকার ভাগ–বাঁটোয়ারা নিয়ে সম্মেলন ডেকেছিলেন, ইতিহাসে এটি ‘স্ক্র্যাম্বল ফর আফ্রিকা’ বা আফ্রিকার জন্য কাড়াকাড়ি নামে আখ্যায়িত হয়েছে। পশ্চিম ইউরোপের সাতটি দেশ—যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, পর্তুগাল নিজেদের মধ্যে মহাদেশটি ভাগাভাগি করে নিয়েছে। পরে তাতে ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্র যোগ দিয়েছিল। বাদ ছিল শুধু দুটি দেশ—ইথিওপিয়া ও লাইবেরিয়া।
প্রথম মহাযুদ্ধের পর অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে তারা মুসলিম অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্য, মিসর প্রভৃতি অঞ্চল পুনর্গঠনের মাধ্যমে তাদের আধিপত্য আরও বিস্তৃত ও দৃঢ় করার চেষ্টা চালিয়েছিল। ১৯২৯-৩০ সালের মহামন্দা ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধকলে ইউরোপীয় শক্তি হ্রাস পাওয়ায় উপনিবেশগুলো ছেড়ে দেওয়ার বাস্তবতা তৈরি হয়। এর পেছনে স্থানীয় কারণ হলো দেশগুলোতে স্বদেশ ও স্বাধীনতা চেতনার বিকাশ এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের তীব্রতা। এখন সময়ের ব্যবধানে বিচার করলে মনে হয়, যেসব দেশে প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক শাসন চলেছে, সেখানে ঔপনিবেশিক শক্তি শাসনকাজে স্থানীয় সহায়ক শ্রেণি তৈরি করতে গিয়ে স্বদেশ ও স্বাধীনতা চেতনায় উজ্জীবিত কিছু মানুষের জন্ম দেয়।
এমন মানুষদের নেতৃত্বে উপনিবেশায়িত দেশে দেশে তীব্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গত শতকের মধ্যভাগ থেকে এশিয়া-আফ্রিকায় নতুন স্বাধীন দেশের আবির্ভাব হতে থাকে। এই বাস্তবতা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থানের প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সূচিত হয় স্নায়ুযুদ্ধ। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপ পুনর্গঠনের দায় এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নেতৃত্ব চলে আসে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। শিল্পবিপ্লব যেমন সবার জন্য সুযোগ তৈরি করলেও এর আঁতুড় যুক্তরাজ্য ও আঙিনা পশ্চিম ইউরোপের ফসলের উত্তমর্ণ হিসেবে নিয়ন্তার ভূমিকায় ছিল, তেমনি আজকের নতুন প্রযুক্তির প্রভাব ও বিশ্বায়নের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। এতে শরিক হতে হচ্ছে সব দেশ ও জাতিকে এবং এর লভ্যাংশে সবার সুযোগ থাকলেও উত্তমর্ণের নিয়ন্তা-ভূমিকা পাল্টায়নি। মঞ্চ তাদের জন্যই সাজানো আছে।
নতুনভাবে ইরান এখন পশ্চিমের মাথাব্যথার কারণ।
নতুনভাবে ইরান এখন পশ্চিমের মাথাব্যথার কারণ।ছবি : রয়টার্স
বিশ্ব নিয়ন্ত্রণে তাদের সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলেও পুরোনো পারমাণবিক শক্তির দেশ রাশিয়াকে গণ্য করতে হয় এবং রাশিয়া-চীন জোট বাঁধলে তা মাথাব্যথার কারণ হয়। ইউক্রেন আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে দায়ী করেও এ যুদ্ধ প্রলম্বিত করার গূঢ়ার্থ খেয়াল করতে হবে। ন্যাটোর প্রসারণের হুমকি বজায় রেখে তারা এ যুদ্ধকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে মূলত দীর্ঘ মেয়াদে রাশিয়ার অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি খর্ব করার লক্ষ্য নিয়ে।
বিস্তৃত কথা বাদ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, তারা যেকোনো মূল্যে ইসরায়েলের স্বার্থ সুরক্ষা করতে তো চায়ই, সেই সঙ্গে এ অঞ্চলে এবং উত্তর আফ্রিকায় হুমকিস্বরূপ কোনো স্বাধীনচেতা শাসকের উত্থান যেন না ঘটে, তা–ও নিশ্চিত করতে চায়। সে কারণেই দুই স্বাধীনচেতা শাসক ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ও লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে হত্যা ও উৎখাত করা হলো। যে অজুহাতে ও যে প্রতিশ্রুতিতে এই দুই দেশে সামরিক অভিযান হয়েছিল, তা সত্য ছিল না, হয়নি। কিন্তু এ দুজনের অনুপস্থিতিতে এ অঞ্চল থেকে তাদের জন্য হুমকি হয়ে ওঠার মতো কেউ যেমন থাকল না, তেমনি দেশ দুটি বহুকালের জন্য ধ্বংসাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে গেল।
নতুনভাবে ইরান এখন পশ্চিমের মাথাব্যথার কারণ। তারা ইসরায়েলের নিরাপত্তার অজুহাতকে বরাবর প্রয়োজনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে এবং এর জন্য অন্যদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করতে এবং সেই অন্যদের প্রতি চরম অমানবিক হতে বিন্দুমাত্র ভাবেনি। একটি কথা অবশ্য মনে রাখতে হবে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর গোত্র-বিভক্ত অনেক দেশে জাতি গঠনের যে দুর্বলতা, তারও সুযোগ নেওয়ার ইতিহাস রয়েছে।
বাস্তবতা হলো বিশ্বটা দাবার ছক হয়ে থাকলে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব একতরফা খেলে যাচ্ছে—বিশেষত সমাজতান্ত্রিক দ্বিতীয় বিশ্বের পতন ও বিশ্বায়নের সুবাদে। আপাতত তারা খেলছে যুগপৎ রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সমর ও অর্থশক্তির বিরুদ্ধে। একদিকে ইউক্রেন, অন্যদিকে ইসরায়েল রণাঙ্গনে লড়ছে, তবে সত্যিকার অর্থে ইসরায়েলের বাস্তব প্রতিপক্ষ আর নেই। মাঠে হামলা চালিয়ে যাওয়ার অজুহাত নেই।
মনে হচ্ছে, তবু পশ্চিমা শক্তি ইসরায়েলকে দিয়ে অন্যায় যুদ্ধ চালিয়ে যাবেই। হামাস বা হিজবুল্লাহ প্রতিরোধ না করলেও যুদ্ধবিরতি চুক্তির জন্য বারবার সম্মতি জানানো সত্ত্বেও ইসরায়েল হামলা বন্ধ করতে চায় না। বরং ইরানকে নতুন প্রতিপক্ষ খাড়া করেছে। পশ্চিম ইউরোপ চুপচাপ। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ—অবশ্যই ইসরায়েলের অনুকূলে। প্রতিদিন তারা মানুষ মারছে—এমন একতরফা নৃশংসতা এত দীর্ঘদিন চলতে আগে দেখেনি বিশ্ব। কিন্তু তা চলছে, চলতে পারছে, সম্ভবত নৃশংসতা নেওয়ার সামর্থ্য আর মানব–বিবেকের নেই। অসাড় হয়ে যাওয়া বিশ্ববিবেকের সুযোগ নিয়ে ইসরায়েল এবং তার পৃষ্ঠপোষক পশ্চিমা দুনিয়া মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে নতুন পরিকল্পনায় মত্ত হয়ে আছে।
আমরা নিজেদের এবং নিজেদের দেশ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত আছি। পশ্চিমা পরিমণ্ডলের বাইরের বিশ্বের ছোট–বড়, ধনী-দরিদ্র সব দেশেই অভ্যন্তরীণ সংকট বাড়ছে, কোথাও দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক সংঘাত চলমান। অথচ এই ফাঁকে বিশ্ব-বিবেকের টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে। প্রশ্ন হলো এটাই কি মানবজাতির ভবিতব্য? নাকি কোথাও থেকে প্রশ্ন উঠবে, প্রতিরোধের ডাক আসবে? অন্তত অতীতের জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের মতো একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মঞ্চ তৈরি হবে আবার—এমন প্রত্যাশা এবং উদ্যোগ ছাড়া দিনযাপনের গ্লানি তো আর টানা যাবে না। বিশ্বশান্তি, সভ্যতার নিরাময় এবং বিবেক রক্ষার একটা কোনো উদ্যোগ তো নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।