স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে বিদেশনির্ভরতা নয়, নিজেদের পুঁজি দেশের ভেতর থেকেই সংগ্রহ করতে হবে। আর দীর্ঘমেয়াদি পুঁজি সংগ্রহের একমাত্র মাধ্যম পুঁজিবাজার। কিন্তু দীর্ঘদিন থেকে দেশের পুঁজিবাজার ভঙ্গুর অবস্থায়। এ অবস্থার উত্তরণে সরকারকে বড় ভূমিকা নিতে হবে। আগামী বাজেটে সুনির্দিষ্ট প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের একটি ইতিবাচক বার্তা দিতে হবে। যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম এসব কথা বলেন। তার মতে-এবারের বাজেটে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর এআইটি (অগ্রিম আয়কর) এবং মূলধনি মুনাফা কমানো জরুরি। পাশাপাশি অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ দিতে হবে। এছাড়া শেয়ারবাজারে চ্যালেঞ্জ ও করণীয় নিয়ে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশেষ প্রতিনিধি মনির হোসেন
যুগান্তর : পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
মমিনুল ইসলাম : বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি ইতিবাচক নয়। নানামুখী সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাজার। এক্ষেত্রে মূল সমস্যার দুটি দিক রয়েছে। একটি হলো কাঠামোগত। এর আগে যেসব আইনকানুন করা হয়েছে, তা বাজারবান্ধব হয়নি। আবার সার্ভেইল্যান্সের (মনিটরিং) ইস্যু আছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্যা আছে। এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে টাস্কফোর্স তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে পুঁজিবাজার অত্যন্ত সংবেদনশীল। এখানে মনস্তত্ত্ব কাজ করে। দীর্ঘদিন থেকে বিনিয়োগকারীরা এখানে আস্থার সংকটে ভুগছে। ফলে তারা বিনিয়োগ করছেন না। উদাহরণস্বরূপ-খাতভিত্তিক বিবেচনায় এই বাজারে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী হলো ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকগুলো হাত গুটিয়ে বসে আছে। এছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠানের কাছে তারল্য আছে, তারা ট্রেজারি বিল বা বন্ডে বিনিয়োগ করছে। কারণ বর্তমানে এ খাতে গড়ে ১২ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যায়। এটি আকর্ষণীয় ও ঝুঁকিমুক্ত। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এসব বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারে আসতে চাইবে না। এর সঙ্গে সামষ্টিক অর্থনৈতিক কিছু বিষয় আছে। অন্যদিকে যেসব ব্যাংক আগে বেশি বিনিয়োগ করত, ওই ব্যাংকে বর্তমানে তারল্য নেই। তারা নিজেরাই সমস্যায় আছে। এছাড়া আরেক বড় সমস্যা আছে। এর আগে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ার মূল্যে ফ্লোর প্রাইস (নিম্নসীমা) দেওয়ার মতো অযৌক্তিক কিছু কাজ করা হয়েছে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বাজার থেকে বের হয়ে গেছে। এ অবস্থায় বাজারে একটি ইতিবাচক বার্তা দেওয়া জরুরি। বিনিয়োগকারীদের বার্তা দিতে হবে সরকার সঙ্গে আছে। এক্ষেত্রে বাজেটের মাধ্যমে সহায়তা দিতে হবে। বাজেটের বাইরেও বিভিন্ন নীতিসহায়তা ও পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
মমিনুল ইসলাম : আগামী বাজেটে শেয়ারবাজারের জন্য বড় ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজ দিতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব দিয়েছি। প্রথমে বলেছি, বর্তমানে টার্নওভারের (লেনদেন) ওপর ১ লাখ টাকায় ৫০ টাকা এআইটি কেটে নেওয়া হয়। এটি যে কোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি। ভারতে কাটা হয় ১ লাখে ১০ টাকা এবং পাকিস্তানে ১ লাখে মাত্র ০.৭৫ টাকা। এছাড়া শ্রীলংকা, ভিয়েতনাম এবং থাইল্যান্ডেও অনেক কম। কিন্তু বাংলাদেশে এই অতিরিক্ত কর নেওয়ার কারণে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। লোকসান করলেও এই কর দিতে হচ্ছে। ফলে এটি কমিয়ে আনা জরুরি। তবে এই কর কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) আবার ব্রোকারেজ হাউজগুলোর জন্য একটি সীমা দিতে পারে। অর্থাৎ তারা শেয়ার লেনদেনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে এই সীমার বেশি কমিশন নিতে পারবে না। ফলে লেনদেন বাড়বে। আর বেশি লেনদেন হলে সরকারের করও বাড়বে। দ্বিতীয় বিষয় হলো বর্তমানে ব্যক্তি পর্যায়ের করদাতারা তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার লেনদেন করে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত মুনাফা করলে কোনো কর দিতে হয় না। ৫০ লাখ টাকার পর মুনাফা করলে ১৫ শতাংশ কর দিতে হয়। আমরা এটি ৫ শতাংশ করতে বলেছি। কারণ হলো বর্তমানে আবাসন ও অন্যান্য খাতের তুলনায় পুঁজিবাজারে অনেক বেশি। কিন্তু বাস্তবতা হলো পুঁজিবাজারে কর আরও কম হওয়া উচিত। তৃতীয় বিষয় হলো বর্তমানে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এবং শেয়ারবাজারের বাইরে থাকা কোম্পানির করের পার্থক্য ৫ শতাংশ। অর্থাৎ শেয়ারবাজারের কোম্পানিকে মাত্র ৫ শতাংশ কর কম দিতে হয়। আমরা এই পার্থক্য ১০ শতাংশ করার কথা বলেছি। এতে নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্তিতে আগ্রহী হবে। এছাড়া অপ্রদর্শিত আয় বাজারে বিনিয়োগের সুযোগ দিতে হবে। কারণ এই টাকা ব্যবহার করে পাকিস্তানের মতো দেশ তাদের পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করেছে।
মমিনুল ইসলাম : বাজেটের বাইরে এর সঙ্গে আরও কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে। যেগুলো সরাসরি বাজেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। যেমন বাজারে বর্তমানে বড় অঙ্কের নেগেটিভ ইক্যুইটি (নেতিবাচক মূলধন) আছে। এটি বাজারের অন্যতম বড় সমস্যা। দীর্ঘদিন থেকে এই সমস্যা বাজারে আছে। এই সমস্যার সমাধান জরুরি। এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের নেগেটিভ ইক্যুইটির দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে হবে। এছাড়া দেশি-বিদেশি কোম্পানিতে সরকারের যে বিনিয়োগ আছে, সেগুলোকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনুকূলে হস্তান্তর করতে হবে। এক্ষেত্রে শর্ত দিতে হবে, তারা ৬ মাসের মধ্যে আইপিওতে (ইনিশিয়াল পাবলিক অফার) আসবে। এটি সম্ভব হলে সরকারও এই টাকাগুলো বাজেট ঘাটতি মোকাবিলায় ব্যবহার করতে পারবে। একই সঙ্গে ভালো কিছু কোম্পানিকে বাজারে নিয়ে আসা যাবে। বেশ কিছু বিদেশি প্রতিষ্ঠান যেমন ইউনিলিভার, নেসলে, স্ট্যাডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, এইচএসবিসি এবং মেটলাইফের মতো প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে আসেনি। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এগুলো তালিকাভুক্ত। এসব কোম্পানি বাজারে না এলে তাদের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করতে হবে।