আধুনিক বিশ্বে মুসলিম যুবসমাজ এক গভীর পরিচয় সংকটের মুখোমুখি। তাদের ধর্মীয় পরিচয়, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি বর্তমানে নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি এবং বিশ্বায়নের ফলে তরুণ প্রজন্ম একে অপরের সংস্কৃতির সাথে সহজে পরিচিত হচ্ছে, যা যেমন ইতিবাচক তেমনি নেতিবাচক প্রভাবও ফেলে। ফলে মুসলিম যুবসমাজের মধ্যে ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে একধরনের বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাবের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে তারা কীভাবে তাদের ধর্মীয় ও নৈতিক পরিচয় ধরে রাখতে পারে, সেটাই এখন এক বড় প্রশ্ন।
বিশ্বায়নের এই যুগে মুসলিম যুবসমাজ ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, তার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। আধুনিক সংস্কৃতি, বিশেষ করে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি, তরুণদের প্রতি প্রভাব বিস্তার করছে। আজকাল তরুণরা সোশ্যাল মিডিয়া, সিনেমা, সিরিজ এবং গান-বাজনা থেকে এমন কিছু মূল্যবোধের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে, যা তাদের নিজস্ব ধর্মীয় পরিচয়ের সাথে প্রায়ই সাংঘর্ষিক। এই দ্বন্দ্ব থেকে বের হতে গিয়ে অনেকেই ধর্মীয় চেতনাকে ভুলে বা উপেক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ইসলামের শিক্ষা তাদের কীভাবে সাহায্য করতে পারে, তা বিবেচনার জন্য সময়োপযোগী।
ইসলামের মূল শিক্ষাগুলো আত্ম-উন্নয়ন ও সমাজকল্যাণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যা তরুণদের জন্য প্রেরণা হতে পারে। প্রথমত, ইসলাম ব্যক্তির আত্মপরিচয় এবং নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রাখার গুরুত্বকে উচ্চমূল্য দেয়। ইসলাম শিক্ষা দেয় যে, প্রতিটি মুসলিমের উচিত তার নিজস্ব পরিচয় গড়ে তোলা এবং তা বজায় রাখা, তবে তা যেন অন্য কারো ওপর অন্যায় বা জোরপূর্বক কিছু চাপিয়ে দেয়ার রূপ না নেয়। কুরআনের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা হলো: “তোমরা যেন ন্যায়ের আদেশ কর এবং মন্দ থেকে বিরত থাকো” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১১০)। অর্থাৎ ইসলামের মূল শিক্ষায় আত্ম-উন্নয়ন এবং ব্যক্তিগত দায়িত্বের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, যা এই সংকটকালে যুবসমাজকে ইতিবাচক দিকে পরিচালিত করতে পারে।
বিভিন্ন সামাজিক চ্যালেঞ্জে ইসলামের শিক্ষা তরুণদের যে মানসিক শক্তি প্রদান করতে পারে, তার একটি উদাহরণ হল তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা। ধর্মীয় শিক্ষা একদিকে যেমন তাদের নৈতিক মূল্যবোধ মজবুত করে, তেমনি তাদের অন্তরশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। কুরআন বারবার অনুপ্রেরণা দিয়ে বলেছে যে, “আল্লাহ যার সহায়ক, কেউ তাকে পরাজিত করতে পারে না” (সূরা আল ইমরান, ৩:১৬০)। এই ধরনের শিক্ষায় তরুণদের মনোবল বৃদ্ধি পায় এবং তারা আত্মবিশ্বাস নিয়ে সমাজের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে। বিশ্বায়নের যুগে অন্যান্য সংস্কৃতির সাথে ভারসাম্য রেখে নিজস্ব পরিচয় বজায় রাখা কঠিন হতে পারে, তবে ইসলামিক শিক্ষা সেই ভারসাম্য বজায় রাখতে একটি শক্ত ভিত হিসেবে কাজ করে।
এছাড়াও, ইসলাম পরমতসহিষ্ণুতা এবং সকল ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কথা বলে। এটি যুবসমাজকে অন্য ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার শিক্ষা দেয়। আজকের যুবসমাজ যেহেতু বহুজাতিক সংস্কৃতির মধ্যে বড় হচ্ছে, তাই তাদের নিজ ধর্মের প্রতি সম্মান রেখে অন্যদেরও সম্মান প্রদর্শন করা জরুরি। এই ক্ষেত্রে ইসলামের সহিষ্ণুতা এবং উদারতার শিক্ষা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। কুরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে: “তোমাদের দ্বীন তোমাদের জন্য, আর আমার দ্বীন আমার জন্য” (সূরা আল কাফিরুন, ১০৯:৬)। এর অর্থ হলো, প্রত্যেকের নিজস্ব ধর্ম পালনের স্বাধীনতা থাকা উচিত, এবং এটি যুবসমাজকে অন্য সংস্কৃতি ও মতামতকে শ্রদ্ধা করতে শেখায়।
তরুণদের ধর্মীয় পরিচয়কে আরও দৃঢ় করতে ইসলামে দেওয়া সমাজকল্যাণের গুরুত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ইসলাম শিক্ষা দেয় যে, সমাজের উন্নয়ন ও কল্যাণের দায়িত্ব প্রত্যেক ব্যক্তির। জাকাতের মাধ্যমে সমাজের গরিব ও অসহায়দের প্রতি সাহায্য প্রদান করার মাধ্যমে একধরনের সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে উৎসাহ দেয় ইসলাম। এই প্রেক্ষাপটে, যুবসমাজ ইসলামের শিক্ষা অনুসরণ করে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এটি তাদের জীবনের অর্থ এবং উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করবে, যা তাদের পরিচয় সংকট মোকাবিলায় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
মুসলিম যুবসমাজের ধর্মীয় পরিচয়কে ধরে রাখার জন্য পরিবার ও শিক্ষাব্যবস্থারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পরিবার থেকে প্রাপ্ত ধর্মীয় শিক্ষা তাদের আত্মিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। এছাড়া স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করলে তরুণরা তাদের ধর্ম সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারবে এবং তা আত্মস্থ করতে পারবে। অনেক সময় দেখা যায় যে তরুণরা ধর্মীয় শিক্ষা থেকে দূরে থাকায় তারা বিভিন্ন ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। এজন্য পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষায় ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান অত্যন্ত জরুরি।
ইসলামের উদারতা এবং সহনশীলতার শিক্ষা যুবসমাজকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করতে পারে। এটি তরুণদের মনে নৈতিক মূল্যবোধ তৈরি করে এবং অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে শেখায়। ফলে, তারা সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল এবং সচেতন হয়ে ওঠে। আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা যেসব কল্যাণকর কাজ কর, তা পরিপূর্ণভাবে কর এবং অপরের প্রতি দয়া প্রদর্শন কর” (সূরা আল-বাকারা, ২:১৯৫)। এই ধরনের শিক্ষা তরুণদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ এবং দায়িত্বশীলতার অনুভূতি গড়ে তোলে, যা তাদের ধর্মীয় পরিচয়কে দৃঢ় করতে সহায়ক।
আজকের মুসলিম যুবসমাজের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রভাবে প্রভাবিত না হয়ে নিজস্ব মূল্যবোধ ধরে রাখা। ইসলাম এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নির্দেশনা প্রদান করেছে, যা তরুণদের জন্য পথপ্রদর্শক হতে পারে। ধর্মীয় শিক্ষা কেবল ব্যক্তিগত পরিচয় সংরক্ষণের বিষয় নয়, বরং এটি এক শক্তিশালী চেতনার মূর্ত প্রতীক। ইসলাম চায় তার অনুসারীরা একাধারে সৎ, দায়িত্বশীল, এবং পরমতসহিষ্ণু হোক। আজকের মুসলিম তরুণরা যদি এই শিক্ষাগুলো ধারণ করে, তাহলে তারা তাদের ধর্মীয় পরিচয়কে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখতে পারবে এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবে।
সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, হাবীবুল্লাহ্ বাহার কলেজ, ঢাকা।