২০২০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মুজিববর্ষের উপহার হিসাবে সারা দেশে চার দফায় আড়াই লাখ ঘর দেওয়া হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুঁজে খুঁজে স্থানীয় প্রতিনিধিদের স্বজন ও আওয়ামী লীগ ঘরানার ব্যক্তিদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে গরিবের ঘর। এ কারণে উদ্বোধনের পর থেকেই তালাবদ্ধ হয়ে আছে অনেক ঘর।
ঘর নির্মাণের নামে লুটপাটের আয়োজন করে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। ভোটের জন্য ‘ট্রাম্পকার্ড’ মুজিববর্ষের উপহার গরিবের কোনো উপকারে আসেনি। এ অবস্থায় গরিবের সঙ্গে ধোঁকাবাজির এ প্রকল্প ইতোমধ্যে সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়েছে।
ঘরগুলোর অধিকাংশই এখন ফাঁকা। তালা মেরে অন্যত্র চলে গেছেন উপকারভোগীরা।
প্রথম পর্যায়ে প্রতিটি ঘরের ব্যয় ধরা হয়েছিল এক লাখ ৭১ হাজার টাকা, দ্বিতীয় পর্যায়ে এক লাখ ৯০ হাজার, তৃতীয় পর্যায়ে দুই লাখ ৬৪ হাজার ৫০০ এবং চতুর্থ পর্যায়ে তিন লাখ পাঁচ হাজার টাকা। প্রতিটি ধাপেই ঘর নির্মাণের অর্থ লোপাট হয়েছে। বরাদ্দের অর্ধেক অর্থে নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে তৈরি হয়েছে ঘর।
স্থানীয় প্রশাসন-জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগ নেতারা এমন লুটপাটের ভাগিদার হয়েছেন। গরিবের ঘরের নামে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। নামমাত্র ‘ঘর’ নির্মাণের পরপরই ধসে গেছে অনেক স্থাপনা। ফেটে গেছে দেওয়াল, উড়ে গেছে টিনের চাল। মাত্র তিন বছরেই এসব ঘর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
সরেজমিন প্রকল্প এলাকা ঘুরে প্রতিনিধিরা জানান, অনেক এলাকায় ব্যক্তির জমিতেও অনেকটা প্রভাব খাটিয়ে তৈরি করা হয়েছে গরিবের ঘর। এখন এসব ঘরে কেউ থাকতে পারছেন না।
বাউফলের উপকারভোগী শাহ আলম ও তার স্ত্রী রহিমা বেগম বলেন, আমাদের এখানকার কয়েকটি ঘর মালিকানা জমিতে স্থাপন করা হয়েছে। এখন মালিকরা এসে বলছেন আমাদের জমিতে গাছপালা লাগাবেন না।
স্থানীয় জামাল হোসেন খান নামের এক ব্যক্তি বলেন, আমার পৈতৃক জমি দখল করে মুজিববর্ষের ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে শতাধিক ঘর ফাঁকা পড়ে আছে। যার প্রয়োজন নেই তাকে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যার প্রয়োজন আছে তাকে ঘর দেওয়া হয়নি।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার দাইন্যা ইউনিয়নের বাসারচর আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৯৩টি ঘরের ১৫টি বিক্রি করে অন্যত্র চলে গেছেন সুবিধাভোগীরা। প্রতিটি ঘর ১০ হাজার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। শুধু টাঙ্গাইল নয় দেশের অন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পগুলোর চিত্রও একই। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা সচ্ছলের নামে ঘর বরাদ্দ নিয়ে তা গরিবের কাছে বিক্রি করেছেন। বসবাসের অনুপযোগী হওয়ায় সেই ঘরও এখন ফাঁকা পড়ে আছে।
মুজিববর্ষের উপহারের এসব ঘর এখন মাদকসেবী সন্ত্রাসীদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো ঘর গরু-মুরগির খামার বানানো হয়েছে। অনেক ঘরের টিন, রড এমনকি ইট খুলে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। সরেজমিন অনেক ঘরের অস্থিত্বও পাওয়া যায়নি।
টাঙ্গাইলের স্টাফ রিপোর্টার জাফর আহমেদ জানান, শুধু বাসারচর আশ্রয়ণ প্রকল্প নয়, এমন চিত্র জেলাজুড়ে। চিলাবাড়ী আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা নছিমন বেওয়া নামের এক বৃদ্ধ বলেন, এখানে ৪৯টি ঘর রয়েছে। তার মধ্যে ১৬টি ঘর ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছে।
স্থানীয় প্রভাবশালী যারা এই ঘর কেনাবেচা করেন, তাদের নাম বলা যাবে না। তবে প্রকল্পের পর আজও আমাদের জন্য কোনো নির্ধারিত সড়ক করে দেওয়া হয়নি। জেলা প্রশাসক শরীফা হক বলেন, কয়েক ধাপে জেলার ১২টি উপজেলায় তিন হাজার ৬১৪টি ঘর নির্মাণ ও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আশ্রয়ণের ঘর বিক্রি হচ্ছে, এমন অভিযোগ পেলে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জামালপুরের সরিষাবাড়ী প্রতিনিধি জহিরুল ইসলাম ঠান্ডু জানান, মুজিববর্ষের নামে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১৪৬টি ঘরের মধ্যে ১২৬টিই ফাঁকা পড়ে আছে। দীর্ঘদিন ধরে দুটি ঘর ভেঙে পড়ে আছে। সন্ধ্যা নামলেই আশ্রয়ণ প্রকল্পটি থাকে মাদক কারবারিদের নিয়ন্ত্রণে।
উপকারভোগী রেজাউল বলেন, এখানে আমাদের কোনো কর্মসংস্থান নেই। ৪টি নদী পাড়ি দিয়ে ৫-৬ কিলোমিটার দূরে উপজেলা সদরে দিনমজুরের কাজ করে জীবন জীবিকা চালাতে হচ্ছে। সরকারিভাবে আমাদের নামে কোনো ভিজিডি-ভিজিএফ কার্ড বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। আশপাশে ৩-৪ কিলোমিটারের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া কঠিন হয়ে পড়েছে। দুর্গম চরে আশ্রয়ণ প্রকল্পটি হওয়ায় মাদক সেবন ও মাদক কারবারিরা আস্তানা করে বসেছে।
ফরিদপুর ব্যুরো প্রধান জাহিদ রিপন জানান, সদরের পশরা গ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, ১৮ ঘরের মধ্যে বেশির ভাগ ঘর রয়েছে তালাবদ্ধ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রায় সবক’টি গৃহনির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে স্বল্পমূল্যের কাঠ ও টিন। ইটের গাঁথুনিতে সিমেন্ট বালুর পরিমাণ কম থাকায় ইতোমধ্যেই দেওয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। আলফাডাঙ্গার চাপুলিয়া গ্রামে মধুমতি নদীর পাড়ে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল ১৩০টি ঘর। গত দুই বছরের নদীর ভাঙনে প্রায় ১০০ ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। বাকি মাত্র ৩০টি ঘরের বাসিন্দারা থাকছেন আতঙ্কে। সদরপুরের আকোটের চর আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধিকাংশ ঘরে তালা ঝুলিয়ে উপকারভোগীরা চলে গেছেন। ঢেউখালী হরিনা আশ্রয়ণের বাসিন্দা সুমন মাতুব্বর জানান, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেও এখন দুর্ভোগের শেষ নেই। ঘরে বসবাসের পরিবেশ নেই।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার মুখ্যসচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া যুগান্তরকে বলেন, গত জুন মাসে প্রকল্প সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়েছে। এ প্রকল্প ঘিরে কেউ অনিয়ম-দুর্নীতি করে থাকলে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

