চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ১২ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজ ৮ বছরেও শেষ হয়নি। ২০১৭ এবং ২০১৯ সালে এসব বিদ্যালয়ের নির্মাণের জন্য দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ পায়। ১৭ মাসের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও বারবার সময় বর্ধিত করে বিল নিয়ে ৮ বছরে ভবনের দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ফরিদপুরের করিম গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ওয়াহেদ কনস্ট্রাকশন ও সরকার স্টিল ইঞ্জিনিয়ারিং ।
জানাগেছে, মিরসরাই উপজেলার ১২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাজ পায় ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশন ও সরকার স্টিল লিমিটেড। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্ষমতার দাপটে বড় বড় কাজ বাগিয়ে নিতো ফরিদপুরের করিম গ্রুপের এই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান । এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা আওয়ামী সরকারের আমলে কাউকে তোয়াক্কা করতো না বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তাদের ইচ্ছে মতো কাজ না করেও বিল উত্তোলন করে নিতো। আওয়ামীলীগ সরকারের পালানোর পর মিরসরাইয়ে ৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাজ না করে পালিয়ে গেছে এ প্রতিষ্ঠান। সরকার স্টিল লিমিটেড একি ভাবে তাদের ৫টি স্কুল স্টিল কাজ করেই চলে যায়। উপজেলা প্রকোশলীর কার্যালয় এ প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে লিখিত প্রতিবেদন দিলেও উপর মহলে গেলে সব নিমিষেই ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশন ম্যানেজ করে ফেলতো।
৮ বছর ধরে এসব বিদ্যালয়ে ভবনের অভাবে আবাসন সংকটে ক্লাস নিতে হচ্ছে খোলা জায়গায়, কোথাও টিনসেড বেড়ার ঘরে । শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট কক্ষে অস্থায়ী টিনের ঘরে প্রচন্ড গরমের মধ্যে গাদাগাদি করে বসে অসুস্থ হয়ে যায়। পাঠদানের পরিবেশ না থাকায় শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকেরাও ভোগান্তির শিকার হয়েছেন।
উপজেলা এলজিআরডি অফিস সুত্রে জানাগেছে, মিরসরাই উপজেলায় ১২ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জন্য সরকার বরাদ্দ দেয় ৫১ কোটি ৩২ লাখ ৩১ হাজার ৩৮৪ টাকা। প্রতিটি বিদ্যালয়ের ভবনে নির্মাণের জন্য ৪ কোটি ২৭ লাখ ৬৯ হাজার ২৮২ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ভবন নির্মাণ কাজের জন্য সময় দেওয়া হয় ১৭ মাস। ৮ বছর শেষ হয়ে গেলেও বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ কাজের এখনো দৃশ্যমান অগ্রগতি যৎসামান্য ৩০% হতে পারে । অভিযোগ রয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়াহেদ কনস্ট্রাকশন এবং সরকার স্টিল আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠতার কারনে গাফলতি করে ১৭ মাসের কাজ।৮ বছরেও শেষ করেনি।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে মিরসরাই উপজেলায় ৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মানের কার্যাদেশ পায় ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশন। বিদ্যালয় গুলো হচ্ছে, বদিউল্লাহপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, পদুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শফিউল আলম আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মধ্যাম মিঠানালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় , ফয়েজউল্ল্যাহ মাষ্টার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাইতকান্দি চৌধুরী পারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় , ডোমখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও গোলকিরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।এছাড়া ৫ টি স্টিল স্ট্রাকচারের তিন তলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মানের কাজ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সরকার স্টিল ইঞ্জিনিয়ারিং । সরকার স্টিলের ৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হচ্ছে, কমরআলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মধ্যাম ডোমখালী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, সফিউল্ল্যাহপারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাজী কামাল পাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বিশ্বদরবার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের জন্য ১৬ মাসের সময় নির্ধারণ থাকলেও, ৮ বছরে বিদ্যালয় কতৃপক্ষকে কাজ বুঝিয়ে দিতে পারেনি ঠিকাদারি ওয়াহেদ কনস্ট্রাকশন ও সরকার স্টিল।
বিশ্ব দরবার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন আনোয়ার জানান, আমাদের স্কুলটি স্টিল স্ট্রাকচারের উপর ৩ তলা ভবন হওয়ার কথা। কাজ করছে সরকার স্টিল ইঞ্জিনিয়ারিং । ঠিকাদার সামান্য কাজ করে পালিয়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষ না থাকায় পাশে বাঁশের বেড়া উপরে টিনের ঘরে গাদাগাদি করে বসে ক্লাস নিতে হচ্ছে। গরমে শিশুরা অসুস্থ্য হয়ে যাচ্ছে। সামনে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি পড়বে। উপজেলার যেসব অফিসার আসে তাদের বারবার বলেও কোন প্রতিকার মিলছে না। ৮ বছরে ধরে এই অবস্থায় স্কুলটি ধ্বংস হওয়ার অবস্থা। অথচ ১৭ মাসে আমাদের ভবন নির্মান শেষ করে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা।
ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশন এর প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার মোঃ আইয়ুব আলী জানান, তিনি এক বছর আগে মিরসরাই বদলী হয়ে আসেন। সে জন্য কতসালে কাজ শুরু হয়েছে সঠিক বলতে পারেন না। তাদের কোম্পানির ৭ টি স্কুলের জন্য ৩ কোটি ৮০ হাজার বা প্রায় ৪ কোটি বাজেট ছিলো। কাজ পাওয়ার পর শুরুতে দুই বছর কোভিট এর কারনে বন্ধ ছিলো। তারপর কেন বন্ধ ছিলো তিনি বলতে পারেননা। তবে এখন কাজ শুরু হয়েছে। কাজ শেষ হতে আগামী ৬ মাস বা আরো কিছু বেশি সময় লাগতে পারে।
মিরসরাই উপজেলা শিক্ষা অফিসার এ কে এম ফজলুল হক বলেন, মিরসরাই উপজেলার ১২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থী বিগত ৮বছর ধরে ঝড়বৃষ্টি, বর্ষা এবং গরমে মানবেতর জীবন যাপন করছে। উপজেলা প্রকোশলীর কার্যালয় এসব প্রকল্প দেখভাল করে।আমি মিরসরাই বদলি হয়ে গত ৯ মার্চ ২০২২সালে আসার পর বারবার যোগাযোগ করেছি। দুটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কিছুদিন যৎসামান্য কাজ করে আবার চলে যায়। দীর্ঘদিন আর খবর থাকেনা। এভাবে কবে শেষ হবে স্কুল নির্মাণের কাজ বলতে পারছিনা।
মিরসরাই উপজেলা প্রকৌশলী রনী সাহা বলেন, আমরা ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশন এবং সরকার স্টিল ইঞ্জিনিয়ারিং দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একাধিকবার চিঠি দিয়েছি। তারা কিছুদিন কাজ করে তারপর ফেলে চলে যায়। এভাবে ৮ বছর কাজ ফেলে রাখলে গুনগত মান ঠিক থাকবেনা। এলাকাবাসীর অভিযোগ আমরা তদন্ত করে রিপোর্ট করবো।
মায়ানী ইউনিয়নের শফিউল আলম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণ চন্দ্র দাস জানান, আমরা ক্লাস রুমের সংকটে আর ক্লাস নিতে পারছিনা। ৮ বছরেও আমরা ভবন পাইনি। আর কবে পাবো জানিনা। ৮ বছর ধরে ঝড়বৃষ্টি রোদে নির্মাণ সামগ্রী নষ্ট হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে দায়সারা রকমে ভবনের কাজ শেষ হলেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্লাস নিতে হবে। আমরা অনেক বার অভিযোগ দিয়েছি। ঠিকাদার মাঝে মধ্যে এসে কিছু কাজ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এভাবে নির্মান সামগ্রী ঝং ধরে প্লাস্টার উঠে নষ্ট হয়ে যায়। এতো নিন্মমানের কাজ হয়েছে বলার অপেক্ষা রাখেনা।
সরকার স্টিল লিঃ এর পরিচালক জামিল হোসেন সরকার জানান, আমরা ৫টি স্কুল নির্মানের কাজ পেয়েছিলাম। দুটি বাতিল হয়েছে। বাকি ৩টি হলো কমর আলী, বিশ্ব দরবার এবং শফিউল আলম।এ তিনটি স্কুলের কাজ দ্রুত সময়ের মধ্যে শুরু করবো। স্টিলের কাজ ভালো অগ্রগতি হয়েছে, তবে সিভিল কনস্ট্রাকশনের কাজ বাকি আছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আশা করি শেষ করতে পারবো।
তিনি আরো বলেন, ২০১৯ সালে কাজ শুরুর সাথে সাথে বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারনে স্টিলের দাম বেড়েছে। আমরা এলজিআরডি এবং বিশ্ব ব্যাংকের কাছে বারবার বরাদ্দ বাড়ানোর আবেদন করেছি। না বাড়ানোর কারনে এখন আমাদের সর্বস্ব বিক্রি করে হলেও কাজ বুঝিয়ে দিতে হবে।