‘মা’ কথাটি খুব ছোট অথচ ঐ শব্দই পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম শব্দ; মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও স্নেহের সাথে অন্য কোনো সম্পর্কের তুলনা চলে না। মায়ের স্পর্শেই সন্তান ধীরে ধীরে পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠে। পৃথিবীর সব ধর্মেই মায়ের মর্যাদাকে উচ্চাসীন করেছে। ৩৬৫ দিনের প্রতিটি সেকেন্ডেই মনে করতে চাই ‘মা’ শব্দটিকে। মা, আম্মা, আম্মি, মাম্মি- সন্তানেরা যে যেইভাবে ডাকুক; এই শান্তির ডাক শতকিছুর বিনিময়েও অন্য কোন শব্দের সাথে তুলনা করা যাবে না।
বিভিন্ন ভাষাভাষির সন্তানের কাছে ‘মা’ ডাক শব্দটি কতোই না আপন। প্রথম দিন থেকে জীবণের শেষ পর্যন্ত সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসার কোনো পরিবর্তন হয় না। মা তাই আমাদের কাছে অতুলনীয়, তিনি অনন্য। সন্তান যত বড়ই হোক না কেন মায়ের জন্য সেই শিশুটিই থাকে। মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক চিরন্তন। কিন্তু সেই অতুলনীয় মানুষটিকে অনেক সময় তাদের সন্তানরা উপযুক্ত প্রতিদান দিতে ব্যর্থ হয়। তখনও মা আগের মতোই তাঁর সন্তানের জন্য মঙ্গল কামনা করেন।
‘মা’ দিবস পালন করা হয়েছে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের সবক’টি দেশেই। পার্থিব উপন্যাসে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘মানুষ যখন ভয় পায়, যখন বিপদে পড়ে, যখন মনে হয় একা- তখন ভয়ার্ত শিশুর মত মাকেই আঁকড়ে ধরে।’ সন্তানের জন্য মায়ের আবেগ অনন্তকালের। অন্যদিকে সন্তানের কাছে মায়ের কোল পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়।
আম্মা তোমাকে খুব মনে পড়ে। বাবা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে আপনি যেমনটি করে আটটি সন্তানকে লালন পালন করেছেন সেটি আমার দৃষ্টিতে খুবই নজিরবিহীন। আমি তখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়াশুনা করি। প্রতিদিনের ন্যায় আমার আম্মা ফজর নামায শেষে পুরো বাড়িটির আঙ্গিনা নিজের হাতে ঝাড়ু দিতেন। এক তলা ভবন আর টিনসেড বাড়িটির সামনে কিছু ফুলের গাছে (বেইলী, গন্ধরাজ, হাসনেহানা) নিজ হাতে পানি দিতেন আমার মা। তারপর আমাদের কোন না কোন ভাইকে বলতেন, আমার জন্য চা নিয়ে আয়। তখন সুশান ভাই নাস্তার সাথে আম্মার জন্য চা নিয়ে আসতো।
আম্মা নাস্তা-চা-পান সেরে আবার পুকুর ঘাঁটে গিয়ে থালাবাসন ধুয়ে-মুছে সাফ করতেন। কোন কোন সময় আমি আম্মাকে সহযোগিতা করতাম কিছু কাজে। আমার আম্মা সব সময় নিজের কাজ নিজেই করতে পছন্দ করতেন। ১৯৯৪ সালের ২৫ মে, রোজ বুধবার। প্রতিদিনের ন্যায় ঐ দিনও সকাল থেকে আম্মা ব্যস্ত ছিল সংসাসের কাজ আমাদের দুপুরের খাবার তৈরী করা নিয়ে। মিঞা ভাই (রিপন) তার পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকতেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য সেখানে দাদা ভাই (লিটন) ও ঢাকার বাসায় থাকতেন।
কিন্তু হঠাৎ দাদা ভাই অসুস্থ হলে বাড়িতে চলে আসেন। আম্মা তাঁর দ্বিতীয় সন্তানটির জন্য সারাদিন টেনশন করতেন, আমার লিটনের কি হয়েছে। তোর কি খেতে মন চায়। কি রান্না করবো তোর জন্য। তুই গরুর গোসস্ত খাসনা। তোর জন্য কলমি শাক ভাজি আর পেঁপে ডাল রান্না করবো। এই নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন আমার আম্মা। আমি আর আহসান (সর্বকনিষ্ঠ ছেলে) আম্মার কাছাকাছি থাকতাম। মিলন (মেঝ ভাই) থাকতো আমাদের মার্কেটের নিজ দোকানের কাজে ব্যস্ত। সুশান (সেজ ভাই) ও নোমান বাজারের আশপাশেই ছিল।
আরেক ভাই আমান ঢিল ছুঁড়ে মারলো আম গাছে, যদি পাকা আমটি পড়ে যায়। কিন্তু সেই ঢিল এসে পড়লো পাশের বাড়ির জেঠাতো ভাইয়ের ছেলে পারভেজের মাথায়। তাৎক্ষণিক মাথা ফেটে রক্ত দেখে আম্মা এতোটা কষ্ট পেলেন, যে বারবার আমানকে বোকা দিচ্ছেন তুই করলি কি? কেন গাছে ঢিল মারলি, এখন কি হবে। যাক সেটি কোন রকম ম্যানেজ করলেন আম্মা।
তখন দুপুর পৌনে ২টা আমরা সবাই খাওয়া-দাওয়া করলেও আম্মা ঘরের কাজ সেরে নামায আদায় করার জন্য কলপাড়ে (টিউবওয়েল) গেলেন। হঠাৎ আম্মা বলছেন লিটন আমার খুব খারাপ লাগছে, তোরা কে কোথায়। সঙ্গে সঙ্গে ধরাধরি করে বিছানায় নিয়ে আসলাম আমি, দাদা ভাই আর পাসের বাড়ির জেঠি। একি আম্মা এইরকম করছেন কেন? আমরা সবাই দৌড়াদড়ি শুরু করলাম ডাক্তার আনার জন্য।
ডাক্তার আনা হলো, তখন ঘড়ির কাটায় সন্ধ্যা ৬:১৫ মিনিট। আমার আম্মা আর নেই। চলে গেলেন পৃথিবী আর আট সন্তানকে রেখে না পরপারের আসল ঠিকানায়। আর দেখা হবে দুনিয়ায় আম্মার সাথে। হে আল্লাহ আমার আম্মাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুক.. আমীন। মে মাসের ২৫ তারিখে আমার মমতাময়ী’র ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। মরহুমার বাসভবন ‘কলাবাগান বাজার কমপ্লেক্সে বিদেহী আত্মার মাগফেরাতের জন্য দোয়া মাহফিল আয়োজন করবে। আন্তর্জাতিক মা দিবসে সশ্রদ্ধা ভরে সালাম জানাই আমার মাকে।
আজ আমার মা পৃথিবীতে নেই। সকল সন্তানরা যেন মা’ শব্দটিকে মূল্যায়ন করে। বৃদ্ধা কিংবা অসুস্থ থাকা মাকে কোন সন্তান যেন কষ্ট না দেয়, সেদিকে সবাই সজাগ থাকতে হবে। যেহেতু মা’র বিকল্প কিছুই নেই। ‘মা যে দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধরিয়া, করেছেন আমাদের ঋণি, গায়ের চামড়া কাটিয়া দিলেও, সেই ঋণ সুদ হবেনা জানি’। ‘মায়ের একধার দুধের দাম, কাটিয়া গায়ের চাম’।
‘এমন একটা মা দেনা’। ‘মাগো মা, ওগো মা, আমারে বানাইলি তুই দিওয়ানা’। এমন অসংখ্য গান, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস আর নাটক যাকে নিয়ে লেখা হয়েছে তার নাম ‘মা’। সব দুঃখ কষ্টকে মাটি চাপা দিয়ে ১৯৯৬ইং সালে যখন মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পাশ করি, ঠিক তখনই ঢাকায় নিয়ে আসেন আমার মা-বাবা সমতুল্য অভিভাবক মিঞা ভাই (আট ভাইয়ের সবার বড়)। ঠিকই তখন থেকে আরেকটি অধ্যায়ের জন্ম নেয়।
মায়ের হাতে মা দিবসের কার্ড দিয়ে কিংবা মায়ের প্রিয় রঙের শাড়িটি তুলে দিয়ে। অথবা মাকে চমকে দিয়ে তাঁর প্রিয় খাবারটি নিজের হাতে রান্না করে। অপরিশোধ্য মাতৃঋণের বদলে মাকে ক্ষণিকের আনন্দ দিয়ে খুশি হবে সন্তানেরা। দূরে থাকা মায়ের ছোঁয়া যাঁরা পাবেন না, তাঁরা দ্বারস্থ হবেন মুঠোফোনের। আর মাতৃহারা সন্তান বুকের সবকষ্ট চেপে মনে মনে বলে উঠবে, ‘আমি খুঁজেছি তোমায় মাগো’। ‘মা যে দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধরিয়া, করেছেন আমাদের ঋণি, গায়ের চামড়া কাটিয়া দিলেও, সেই ঋণ সুদ হবেনা জানি’। ‘মায়ের একধার দুধের দাম, কাটিয়া গায়ের চাম’। ‘এমন একটা মা দেনা’। ‘মাগো মা, ওগো মা, আমারে বানাইলি তুই দিওয়ানা’।
এমন অসংখ্য গান, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস আর নাটক যাকে নিয়ে লেখা হয়েছে তার নাম ‘মা’। এ বিষয়ে একটি ঘটনা খুব উলেখযোগ্য। এক ব্যক্তি বিশ্ব মুসলিম জাহানের শান্তির দূত মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সালাম -এর নিকট এসে জানতে চাইল কে তার কাছে বেশি সেবা পাবার হকদার। রাসূল (সা:) বললেন তার মা। লোকটি একই প্রশ্ন তিনবার করলো। আর রাসূল (সা:) তিনবারই বললেন তার মায়ের কথা। তবে চতুর্থবার একই প্রশ্ন করলে রাসূল (সা:) তার বাবার কথা বললেন।
সন্তানের জন্যে জগতের সকল মায়ের ভালবাসায় কোন ভিন্নতা নাই। জাতি, ধর্ম, বর্ণের শ্রেষ্ঠত্বের বিভেদ টিকিয়ে রাখার জন্যে কোন মায়ের বুকের ধন কেড়ে নেয়া অন্যায়। তিনি এর প্রতিবাদে বিশ্বের সকল মাকে একতাবদ্ধ হওয়ার আহবান করেন। যদিও তিনি তার কাজে পুরোপুরি সফলকাম হতে পারেন নি, তার এই মহান কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন এ্যানা জার্ভিস এর কন্যা, দ্বিতীয় এ্যানা জার্ভিস। জুলিয়া ওয়ার্ডের পথ ধরে সুদীর্ঘ ৩৭ বৎসর সংগ্রামের পর ১৯০৭ সালে প্রথমবারের মতো ‘মা দিবস’ উৎসব পশ্চিম ভার্জিনিয়াতে উদযাপিত হয়।
আজ সারা পৃথিবী জুড়ে এপ্রিল থেকে মে মাসের শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এ মহান দিনটি পালিত হয়। এরপর থেকেই আস্তে আস্তে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি বিস্তার হতে থাকে চারপাশে এবং এক সময় এটি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে মা দিবস পালিত হয়। কারণ দিবসটি উদযাপনের সূত্রপাত বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম। তবে বেশীর ভাগ দেশে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার দিনটি পালিত হয়।
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই কবিতার মতোই হয়কো আপনিও আপনার মাকে এখনো পর্যন্ত মুখ ফুটে বলে উঠতে পারেননি আপনার ভালোবাসার কথা। কবি তার টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে মায়ের জন্য কমলালেবু কিনে এনেছেন। আর তাতেই মায়ের চোখ জলে ভরে উঠতো, মা বুঝে নিতেন কবির না বলা ভাষা। আপনিও পারেন ঠিক এমন করেই একটু অন্যভাবে মায়ের কাছে আপনার অনুভূতির প্রকাশ ঘটাতে। মা দিবসে বিশ্বের সমস্ত মায়ের প্রতি ভালোবাসা ও দেশের সার্বিক শিক্ষা প্রসারের মূল নেপথ্য শক্তি মায়েদের সচেতন করার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
যদি প্রশ্ন হয় কোন শব্দে সবচেয়ে বেশি আকুলতা, বেশি আবেগ, নিবিড় টান আছে-বিতর্ক ছাড়াই একটি উত্তরই আসবে প্রথিবীজুড়ে ‘মা’। মায়ের সঙ্গে সন্তানের গভীরতম সম্পর্কের কাছে সব সম্পর্কই যেন গৌণ। যে সম্পর্কের সঙ্গে আর কোনো তুলনা হয় না। একটি আশ্রয়র নাম ‘মা’। একটি শব্দই মনে করিয়ে দেয় অকৃত্রিম স্নেহ, মমতা আর গভীর ভালোবাসার কথা। মা চিরন্তন। শুধু বিশেষ দিন নয়; মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা প্রতিটি দিনের আর প্রতিটি মুহূর্তের। মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্বজুড়ে পালন করা হয় ‘মা দিবস’। প্রশ্ন জাগতে পারে, মা-তো প্রতিদিনের, প্রতিক্ষণের।
তাহলে ‘মা’ নিয়ে আবার বিশেষ দিন কেন? কিন্তু ক্ষতি কী, যদি একটি বিশেষ দিনে মায়ের দিকে আরেকবার প্রাণভরে তাকাই, যারা দূরে থাকি তারা আরেকবার মাকে বিশেষভাবে স্মরণ করি। মাকে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জানাতে নির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঠিক করা অনেকের কাছেই প্রহণযোগ্য না হলেও মাকে সম্মান দেখাতে, স্মরণ করতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মা দিবসের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
ইতিহাস যাই হোক, দিনটির তাৎপর্য এখানে যে, দিনটি মা’কে বিশেষ ভাবে মনে করিয়ে দিয়ে, মা’কে ভালবাসার কথা স্মরণ, ভক্তি করা এবং মা’য়ের প্রতি আমাদের কর্তব্যবোধ জাগিয়ে দিয়ে বরং আমাদেরই যেন লজ্জার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল। শুধু বছরে এক দিন নয়, বছরের প্রতিটি দিন যেন আমরা মা’কে ভালবাসি, মা’কে শ্রদ্ধা করি-আমরা যেন মা’য়ের ত্যাগ কখনো ভুলে না যাই, মা’য়ের প্রতি কর্তব্য ভুলে না যাই। “আমার মা-কে খুব মনে পড়ছে। তোমাকে খুব ভালোবাসি মা…”