গাজীপুরের টঙ্গী এলাকায় অভিযানে গিয়ে ইয়াবাসহ এক মাদক বিক্রেতাকে গ্রেপ্তারের পর তাঁর বাসায় গিয়ে একটি ব্যাংক চেক নেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। গত জুনের ওই ঘটনায় করা মামলার জব্দ তালিকায় সেই চেক দেখাননি তাঁরা। এ ঘটনায় অধিদপ্তরের এক সহকারী পরিচালকসহ চার কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ওই সহকারী পরিচালকের অফিসকক্ষ সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। তিনি স্বীকার করেছেন যে অভিযানে উদ্ধার করা আলামতের মধ্যে একটি ব্যাংকের চেক পাওয়া গেছে। সেটি কত টাকার চেক, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ঘটনা সম্পর্কে অবগত এক কর্মকর্তা বলেছেন, সেটি কয়েক লাখ টাকার চেক। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, অভিযানে আসামির বাসা থেকে পাওয়া ব্যাংক চেক জব্দ তালিকায় না দেখানো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। ওই ব্যাংক চেক দিয়ে টাকা উত্তোলনের চেষ্টা করা হয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার মাদক বিক্রেতার পরিবার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগ করলে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু হয়। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে গতকাল বুধবার রাতে অভিযানে যাওয়া চার কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়। পাশাপাশি অভিযানসংশ্লিষ্ট মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় গোয়েন্দা বিভাগের সহকারী পরিচালক মারফিয়া আফরোজার অফিসকক্ষ সিলগালা করে দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে।
গাজীপুরের টঙ্গী সরকারি কলেজের সামনে থেকে গত ২২ জুন ইয়াবাসহ মো. রমিজ উদ্দিন নামের এক মাদক বিক্রেতাকে আটক করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। পরে রমিজকে নিয়ে টঙ্গীর দক্ষিণ খা পাড়ায় তাঁর ভাড়া বাসায় যান কর্মকর্তারা। তাঁর বাসায় তল্লাশি করে দুটি পলিব্যাগে ১৫ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। রমিজের পরিবারের অভিযোগ, এ সময় বাসা থেকে মোটা অঙ্কের টাকার একটি ব্যাংক চেক নিয়ে আসেন কর্মকর্তারা।
মাদক উদ্ধারের এ ঘটনায় সহকারী পরিচালক মারফিয়া আফরোজ বাদী হয়ে মামলা করেন। এজাহারে জব্দ তালিকায় একটি পলিব্যাগের মধ্যে ৫ হাজার ইয়াবা ও আরেকটি পলিব্যাগে ১০ হাজার ইয়াবার কথা উল্লেখ করেন। আসামির কাছ থেকে উদ্ধার একটি মুঠোফোনও জব্দ তালিকায় দেখানো হয়। কিন্তু জব্দ তালিকায় কোনো ব্যাংক চেক দেখানো হয়নি। মামলায় সাক্ষী হিসেবে দুজনের নাম রয়েছে। তাঁদের একজন স্থানীয় বাসিন্দা নূর মোহাম্মদ রাহাত। তিনি বলেন, অভিযান শেষে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। ইয়াবা জব্দ দেখিয়ে তাঁর স্বাক্ষর নেওয়া হয়।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা গত মঙ্গলবার ঢাকার গেন্ডারিয়া বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ে যান। সেখানে সহকারী পরিচালক মারফিয়া আফরোজার অফিসকক্ষটি সিলগালা করে দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার থেকে তিনি ছুটিতে ছিলেন। কিন্তু অভিযোগটি গুরুতর হওয়ায় ছুটির মধ্যেই তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ফোন করে ডেকে আনা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে মারফিয়া আফরোজ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এখন তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে আজ বৃহস্পতিবার মারফিয়া আফরোজের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, অভিযানের সময় আসামির বাসা থেকে কললিস্টের (সিডিআর) তালিকা পাওয়া গেছে, যেটা স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আসামি রমিজ উদ্দিনের স্ত্রীর এক আত্মীয় পুলিশে চাকরি করেন বলে জানান।
ব্যাংক চেকের বিষয়ে জানতে চাইলে মারফিয়া আফরোজ বলেন, ‘অভিযান হয়েছিল জুন মাসে। বৃহস্পতিবার অভিযানে অংশ নেওয়া সিপাহি সোহেল রানা আলামতের ভেতর ব্যাংক চেকটি দেখতে পান। পরে সেটা আমার অফিসকক্ষের ড্রয়ারে রাখেন। আমি নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছি। ব্যাংক চেকটি কী করব, সেটা বুঝতে পারিনি।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, রমিজ উদ্দিনকে গ্রেপ্তারের ওই অভিযানে গিয়েছিলেন গোয়েন্দা বিভাগের বিভিন্ন পদমর্যাদার আট কর্মকর্তা। সহকারী পরিচালক মারফিয়া আফরোজের নেতৃত্বে ওই অভিযানে আরও ছিলেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক শাহরিয়া শারমিন, উপপরিদর্শক আবদুল আল মামুন ও মো. জান্নাতুল ফেরদৌস, সহকারী উপপরিদর্শক মো. আতাউল হক, সিপাহি সোহেল রানা, আবদুর রহমান, সাইমুন হাসান খান ও মো. লুৎফর রহমান। অভিযোগের বিষয়ে প্রাথমকি সত্যতা পেয়ে গতকাল রাতে অভিযানসংশ্লিষ্ট চার কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে তাঁদের প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়। এই চার কর্মকর্তার মধ্যে মারফিয়া আফরোজ ছাড়া বাকিরা হলেন, উপপরিদর্শক মো. জান্নাতুল ফেরদৌস, সহকারী উপপরিদর্শক মো. আতাউল হক ও সিপাহি সোহেল রানা।
অভিযানে আটজন গেলেও চারজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সমালোচনা করেছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তাঁর বলছেন, শাস্তি হলে সবারই শাস্তি হওয়া উচিত। এখানে চারজনকে বাঁচিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে আজ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সেগুনবাগিচার প্রধান কার্যালয়ে যান এই প্রতিবেদক। অভ্যর্থনাকক্ষে গিয়ে একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ফোন করলে কেউ ফোন ধরেননি। পরে অভ্যর্থনাকক্ষের ফোন দিয়ে কথা হয় পরিচালক (অপারেশনস) অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মো. বশির আহমেদের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তিনি রাজি হননি। পরে ফোনে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরেরর জনসংযোগ কর্মকর্তাকে দেওয়া আছে। তাঁর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
পরে কথা হয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মোস্তাক আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা হঠাৎ করে মারফিয়ার অফিসকক্ষে পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। তখন তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। মামলার আলামতসহ সার্বিক বিষয় সন্তোষজনক না হওয়ায় তাঁকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে।
মোস্তাক আহমেদ আরও বলেন, কোনো ব্যক্তির অপরাধের দায়ভার প্রতিষ্ঠান নেবে না। কেউ অপরাধ করলে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।