সংস্কৃতি ও বিনোদন ডেস্ক, আজনিউজ২৪: আবেদ সাহেবের বাসা, স্ত্রী ও দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে সংসার। ছেলে ও মেয়েগুলো ভীষণ লক্ষী ও পড়াশোনায় বেশ ভালো। বড় মেয়ে জুই এবছর এসএসসি পরীক্ষা দিবে, মেঝ ছেলে ক্লাস সেভেনে পড়ে আর ছোট মেয়েটা ক্লাস ফাইভে পড়ছে। সন্ধ্যা হলেই তিন ভাইবোনের সুর করে পড়া শুরু হয়ে যায়, কাউকে বকা ঝকা করতে হয় না, যে যার মত বসে পড়ে, মা সানজিদা দূর থেকে দেখে খুব সুখ অনুভব করে। আবেদ সাহেব একটা বেসরকারি অফিসে চাকুরী করে, বেতন মোটামুটি ভালোই পান, বাসা ভাড়া, ছেলেমেয়েদের খরচ ও সংসারের খরচ বাদেও মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা সানজিদা ব্যাংকে রাখেন, বলা তো যায় না কখন কোন বিপদে লেগে যাবে।
আবেদ সাহেব: কইরে তোরা কোথায়, এই নে তোদের জন্য মিষ্টি ও দই নিয়ে এসেছি, জানিস আমি না লোভ সামলাতে পারেনি, তিনটি মিষ্টি ও দুই প্লেট দই খেয়ে নিয়েছি দোকানে, আহ! কি যে মজা।
সানজিদা: কি, তুমি দই মিষ্টি খেয়েছ, তোমার না ডায়াবেটিস সুগার লেভেল কি হবে একবার কি ভেবে দেখেছো, আমি আর তোমাকে নিয়ে পারি না, টানা তিন দিন করলা ভেজানো পানি খাবে সকালে, এতে যদি সুগার টা একটু কমে, হাঁটতেও হবে কিন্তু তোমাকে সকালে, সকালে, তোমার তো আবার ঘুমই ভাঙ্গে না।
মা: জুই, মা নেতো মিষ্টি ও দই এর প্যাকেট গুলো ফ্রিজে তুলে রাখ, একটু ঠান্ডা হলে সবাই মিলে একসাথে খাবো।
জুই: ঠিক আছে মা, তাই হবে কেয়া ও রয়ালের তো দই মিষ্টি ভীষণ পছন্দ।
প্রায় দুই ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, বিকাল তখন পাঁচ টা, যেহেতু শুক্রবার, সবাই বাসায়, মা বড় যত্ন করে ওয়ালটন ফ্রিজ টা কিনেছে কিস্তিতে, প্রতিদিন কি পরম আবেশে না ওটা মুছে, ১৪ সেফটি ফ্রিজ, – যখন ফ্রিজ ছিল না তখন পাশের বাসায় ঠান্ডা পানি রাখতে যে কি কষ্ট লজ্জা লাগতো জুই হারে হারে জানে। পাশের বাসায় বেল দিলেই কেমন রুষ্ট হয়ে দরজা খুলতো, পানি নিয়ে যখন চলে আসতাম তখন ধপাস করে ওরা দরজাটা লাগাতো, এখনো বুকের ভিতরটায় কষ্ট হয়। তবে রোজার সময় রুহাফজা দিয়ে যখন ঠান্ডা পানির শরবত সবাই তৃপ্তি সহকারে খেতাম তখন বুকের সব কষ্ট গুলো চলে যেত। আচ্ছা মধ্যবিত্তের এত কষ্ট থাকবে কেন, এতো টানাটানি থাকে, মাঝে মাঝে কোন কিছুই ভালো লাগেনা। বাবা যেদিন ফ্রিজটা কিনে আনল, আমরা তিন ভাইবোন যে কি আনন্দ করেছিলাম, কেয়াতো কাঁচা দুধ দিয়ে আইসক্রিম বানাতে গেল, রয়েল দুইদিন শুধু বরফ কামড়ে কামড়ে খেয়েছে, মাকে দেখেছি প্রতিদিন বড় এক বোতল ঠান্ডা পানি , ছোট বোয়াকে যাবার সময় দিয়ে দিয়েছে , বোধ হয় নিজেদের ফ্রিজ না থাকায় কষ্টটা অনুভব করেছে। আসলে সবারই পৃথিবীতে কষ্ট থাকে, যেমন এখন আমাদের ফ্রিজ, টিভি, সোফা হয়েছে, কিন্তু নিজেদের কোন বাড়ি বা ফ্ল্যাট ঢাকায় নেই, তাই একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটে আমাদের, আসলে স্বপ্ন আছে বলেইতো মানুষ বেঁচে থাকে।
বাবা: মা জুই, এক গ্লাস পানি দেতো, একটু ঠান্ডা পানি দিস, দেখিস তোর মা যেন না দেখে।
জুই: বাবা! তোমায়তো ঠান্ডা পানি দেওয়া যাবে না, দাঁড়াও একটু নরমাল পানির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছি।
বাবা: আহা! কি শান্তি, ঠান্ডা পানি খেলে দিলটা আসলেই ঠান্ডা হয়ে যায়।
জুই বাবাকে পুরা ঠান্ডা পানিই দিয়েছে, নরমাল পানি মিশায়নি , মাঝে মাঝে ও এটা করে, বাবাকে ভীষণ ভালোবাসেতো, যদিও এটা ঠিক হয়নি, ভালোবাসাটাই আসলে এক রকম অদ্ভুত ব্যাপার, ন্যায় অন্যায় গুলো সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায় না।
বাবা: মা জুই, নে এই খামটা তোর মাকে দে।
জুই: ঠিক আছে বাবা।
মা: কিরে, তোর বাবা কখন আসলো।
জুই: এইতো মা, কিছুক্ষণ হলো, নাও মা।
বাবা দিয়েছে, রেখে দাও, বোধহয় বেতনের টাকা।
মা: দে মা, বাজারের যে অবস্থা, বিশ দিনও যায় না, মাসের শেষ দিনগুলো যেন আর যেতেই চায়না।
বাবা: সানজিদা ও সানজিদা শুনছো, আজ যে রুই মাছটা আনছি, ওই মাছটা, ভেজে, আলু বেগুন দিয়ে রান্না করবা, চিকন বিরই চাল আনছি, তিন কেজি, পরিমাণগত রান্না করবা, চিংড়ি মাছের দোপেয়াজা, বেতন পেয়েছি, দু একদিন একটু ভালো না খেলে কি আর চলে, বল।
রাত প্রায় দশটা সবাই মিলে একসাথে খেতে বসেছে।
মা: কিরে কেয়া, তুই খাচ্ছিস না কেন।
কেয়া: খাচ্ছিতো মা, তোমার রান্না কিন্তু দারুণ হয়েছে, চিংড়ি মাছটা এত্ত মজা, মা আরেকটা মাছ দিবা।
মা: পাগলী আমার, নে দুইটাই নে।
সবাই হাসাহাসি করছে, আবেদ সাহেব মন ভরে খা, সানজিদা অপলক দৃষ্টিতে দেখছে , সংসারটা কিন্তু বড় অদ্ভুত মায়ার জায়গা , কোথাকার কোন আবেদ সাহেব, চেনা নেই, জানা নেই, বাবা মা পছন্দ করে ১৮ বছর বয়সে বিয়ে দিল, সেই যে হাত ধরলাম, একসাথে চললাম, কতদিন কত বছর পার কইরা দিলাম, মানুষটা ভালো, কখনো বকাবকি, রাগারাগি করে নাই।
সংসারে প্রাচুর্য দিতে পারে নাই, দুঃখ নাই, যে সুখ দিছে, অমন সুখ কজন পায়, বড় আদর করে, বড় দেখভাল করে।
বাবা: না, না আজ মাথাটা আমার জুই মা খাবে, জুই মাকে দাও, আমাকে মাছের টুকরা দাও।
রয়েল সবার দিকে তাকাচ্ছে, ভেবেছিল ওই বুঝি পাবে।
মা: না, না আমার সংসারে ছেলে মেয়ে সবাই সমান, সামনের মাসে মাথা খাবে কেয়া, এর পরের মাসের রয়েল, তারপর আমরা, কেমন।
কি মায়ার সংসার, কি ভালো লাগার সংসার, কি টান, কি ভালোলাগা।
বাবা: কিরে, তোরা এখনো জেগে আছিস কেন, এখন কি লুডু খেলার সময়, চল সবাই ঘুমাবি, এই লাইট বন্ধ করে দিলাম।
ভাইবোনেরা – বাবা কি করলা, মাত্র তো খেলাটা জমে উঠেছিল, আহা! বাবা লাইটটা জ্বালাও না।
বাবা: না, না এখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ো, সকালে উঠতে হবে না।
ভোর প্রায় পাঁচটা, ফজরের আজান হচ্ছে, সানজিদা উঠেছে অজু করতে।
সানজিদা: এই ওঠ, ওঠ, নামাজ পরবে না।
আবেদ সাহেব: হ্যাঁ পরবো, মশারি টা একটু খুলে দাও তো।
মশারিটা সানজিদা খুলে দিল, আবেদ সাহেব উঠে দাড়িয়েই হঠাৎ করে বিছানায় পড়ে গেল।
সানজিদা: এই কি হলো, কি হলো।
তুমি এমন করছ কেন?
আবেদ সাহেব: সনজিদা একটু পানি দাওতো, তাড়াতাড়ি।
সানজিদা: জুই, কেয়া, রয়েল তোরা কোথায় আছিস, তাড়াতাড়ি আয়, দেখ তোর বাবা কেমন জানি করছে।
আবেদ সাহেব কে ডাক্তার দেখানো হয়েছে, ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে, এক পা প্যারালাইসিস হয়ে গেছে। বাসায় আত্মীয় পরিজন অনেকেই এসেছে দুই পরিবারেরই, অনেকের বেশ কিছু টাকা খামে করে দিয়েও গেছে, মুখ ফুটেতো এ সময় হাত বাড়িয়ে টাকা চাওয়া যায় না, এমন বিপদের সময় আত্মীয়স্বজনরা যে পারিবারিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে সাহায্যর হাত বাড়িয়েছে এই বা কম কিসে। আবেদ সাহেবের অফিস থেকেও কিছু সাহায্য পাঠিয়েছে, যাহোক সাহায্যে কি আর দিন যায়, চার মাস কোনরকমে সানজিদা সংসারটা টেনে নিয়ে আসছে, আর যে পারছে না, গ্রামে কিছু জমি ছিল, সেটাও বিক্রি করেছে, প্রায় পাঁচ লাখ টাকা পেয়েছে, ব্যাঙ্কে রেখে প্রায় সাড়ে সাত হাজার টাকার মতো পায়। ঘোর অন্ধকার, এখন কি করবে, ফ্লাট বাসা ছেড়ে দিয়ে টিনশেডের বাসায় এক রুমে বারান্দা সহ উঠেছে, ছেলেটা বারান্দায় ঘুমায়, চারদিকে পলিথিন দিয়ে ঘেরাও দিয়ে নিয়েছে। বড় মেয়ে জুই এর লেখাপড়া বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে, মেয়েটা গার্মেন্টসে টাইম কিপার পদে চাকরি নিয়েছে, সব মিলিয়ে প্রায় ১০ থেকে ১১ হাজার টাকা পায়, রয়েল ও কেয়া সরকারি স্কুলে পড়ছে এখন, যতই কষ্ট হোক ওদের পড়া বন্ধ করতে দিবে না, জুইতো তাই বলে। আমি মা, আমি তো আর পথ দেখছি না। সানজিদাকেও কাজ করতে হবে, অনেক জনকেই বলেছে, কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতা খুব বেশি না, এইচ এস সি পাশ, পাশের বাড়ির স্বপ্না আপা একটা চাকরির কথা, কয়েকদিন হল বলতাছে, দেখি এই সপ্তাহে একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।
স্বপ্না আপা: আপা আসসালামুয়ালাইকুম, কেমন আছেন, কাল কিন্তু বনানী অফিসে আপনার ইন্টারভিউ, সকাল ১১ টায়, আমি আসব আপনাকে নিয়ে যেতে।
সানজিদা: ওয়ালাইকুম আসসালাম, ঠিক আছে আমি রেডি থাকবো।
সানজিদা সেলোয়ার কামিজ পরেই অফিসে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল, কিইবা এমন বয়স হয়েছে, খুব বেশি হলে পাঁচচল্লিশ হবে, ছিপছিপে গড়নের ও বেশ ফর্সা হওয়াতে বয়সটা বোঝাই যায়না। যাহোক চাকরিটা হয়েছে, প্লট ও ফ্ল্যাট বিক্রি করে কোম্পানিটি, সানজিদার কাজ ফ্ল্যাট ও প্লট বিক্রি করা-বেশ নার্ভাস হয়ে গেছে। মার্কেটিং এর ডাইরেক্টর স্যার বলেছে ভয় করার কিছু নাই, উনারা বলেছেন আমাকে নাকি সব শিখিয়ে পড়িয়ে নিবেন। আজ মাসের ১৭ তারিখ, সামনের মাসের ১ তারিখে আমাকে অফিসে জয়েন করতে বলেছে, সবকিছু ভেবে দেখলাম চাকরিটা আমার করতেই হবে, এদিকে আবিদের শরীরটাও ভাল যাচ্ছেনা, শ্বাসকষ্টও এখন অনেক বাড়ছে, শীতের দিন, ঠিকমত বাথরুমও করতে পারে না।
জুই: মা, ও মা, তাড়াতাড়ি এদিকে আসতো, দেখো বাবা খাট থেকে নিচে পড়ে গেছে।
মা: বাবা রয়েল তাড়াতাড়ি আয়, আমার সাথে ধর তোর বাবাকে, বিছানায় তুলতে হবে।
রয়েল: মা আমি আসছি।
কেয়া: বাবা কথা বল, চোখ খুলে বাবা।
না আবেদ সাহেব আর চোখ খুলে নি কথাও বলেনি, খাট থেকে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন । শুক্রবার বাদ আসর জানাজা শেষে দাফন হয়ে গেল। আত্মীয় পরিজনরা অনেক করেছেন, আজও করছেন, প্রায়তো তিন বছর যাবত সবাই জামাকাপড় দিয়েছেন, সানজিদা পুরনো শাড়ি কাপড় আত্মীয়-স্বজন থেকে গোপনে নিয়েছে, নতুন কাপড় কে কাকে কতদিন দিতে পারে বলেন। সমাজ সংসার, হায়রে সংসার, মানুষটা চলে গেছে, কিন্তু কত স্মৃতি রেখে গেছে, তার কাপড়-চোপড় গ্লাস, প্লেট, বাটি, বালিশ সবকিছু যেন তার কথা বলে। যাহোক বাঁচতে তো হবে, বাচ্চা গুলোতো মানুষ করতে হবে, জুই ওর ওতো বিয়ের বয়স হয়ে গেল, বিয়ে দিতে হবে।
মেয়ে বলে আমার, বিয়েই করবে না, ভাই বোনদের একটা ব্যবস্থা না করে নাকি ও বিয়ে করবে না, তাহলেতো মা জুই, না না ও ভাবতে পারে না, আমি মা, মা হয়তো মেয়ের জীবন ধ্বংস করতে পারবোনা। মেয়েটা আমার ভীষণ সুন্দর ও লক্ষী, বেশ ভালো ঘর থেকেই সম্মন্ধ আসছে। দেখি ওদের মামা চাচারা কি বলে, কিছুদিন পর আশা করছি ওর বিয়েটা দিয়ে দেব, মাতো আমি, ওর, ওদের সবার ভাল হলেইতো আমার ভালো, আমার আর চাওয়া পাওয়ার কি আছে, গত সাত দিন হল অফিসে চাকরি নিয়েছে সানজিদা, প্লট ও ফ্লাট এর কাস্টমার এলে তাদেরকে বিস্তারিত বুঝাতে হয়, কাজটা খারাপ না, ভালই লাগছে।
ছিমছাম গোছানো অফিস সব মিলিয়ে বিশ জনের মতো এই অফিসে বসেন, বাকিরা বিভিন্ন জায়গায় সাইড অফিসে বসেন।
ম্যানেজার: মিসেস সানজিদা, আপনি একটু আমার অফিসে আসেন তো।
সানজিদা: জি স্যার, আসছি।
ম্যানেজার: দেখুন মিস সানজিদা আপনার তো প্রায় দুই মাস হয়ে গেল চাকরির বয়স, এখনো একটি প্লট বা ফ্ল্যাট বিক্রি করতে পারলেন না, দেখুন আপনাকে আরো বেশি কাজের প্রতি সিরিয়াস হতে হবে, না হলে কিন্তু আমাকে কঠোর হতে হবে।
সানজিদা: স্যার আমি মনেপ্রাণে চেষ্টা করব।
মনটা ভালো নেই, সন্ধ্যায় বাসায় এসেই বিছানায় শুয়ে পরেছে।
রয়েল : মা, ও মা, এই নাও একটু চা খেয়ে নাও।
মা: সোনা বাপ আমার, কেন এত ভালবাসিস তোদের মা কে? কি করতে পারলাম বল তোদের জন্য।
রয়েল: মা, দেখো আমি বড় হলে তোমাকে আর কষ্ট করতে দেব না।
মা: লক্ষী ছেলে আমার।
কেয়া: মা, কাল আমার স্কুলের বেতন দিতে হবে, বাসায় যে ম্যাডাম পড়াতে আসেন ওনারও বেতন দিতে হবে।
মা: ঠিক আছে রে মা, ঠিক আছে, সব দিয়ে দেব।
সানজিদার হাতে তো তেমন টাকা নেই, কেয়াকে সব মিলিয়ে প্রায় ৪০০০ টাকা দিতে হবে।
সানজিদা: স্বপ্না আপা কেমন আছেন।
স্বপ্না: এইতো ভালো আছি, চাকরি কেমন যাচ্ছে।
সানজিদা: ভালো, আপা বলছিলাম কি ২০০০ টাকা দেওয়া যাবে, তা সামনের মাসেই দিয়ে দিতাম।
স্বপ্না: হ্যাঁ হ্যাঁ, একটু দাঁড়ান আপা ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
স্বপ্না আপা একাই থাকেন, সাথে এক খালাতো বোন থাকেন, পোশাক-আশাকে খুব সাজগোজ থাকেন, নানাজন নানান কথা বলেন ওনাকে নিয়ে, আমি কিন্তু অতশত বুঝিনা, এই মানুষটা আমার জন্য, আমার পরিবারের জন্য অনেক করেছেন। যখনই বিপদে পড়েছি কখনও না করেননি।
মা: কিরে মা জুই, ছেলে কেমন দেখলি।
জুই: জি মা, ভালো, তোমরা যাকে বলবে সেই তো ভালো, আর তুমি তো জানো তোমরা যার কাছে আমায় বিয়ে দিবে তাতেই আমি রাজি।
মা: জানিরে মা তা জানি।
জুই এর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, ছেলে অস্ট্রেলিয়াতে থাকে, বাবা নেই, মা বাড়িতে আছেন, দু’বোন তাদেরও বিয়ে হয়ে গেছে, সানজিদা খুব ভয়ে আছে, ব্যাংকের টাকা ভাঙ্গা ছাড়া তো আর কোন উপায় নাই।
জুই: মা ও মা, এক ঘন্টা তো হইয়া গেল, বাথরুম থেকে বের হও, জ্বর চইলা আসবে তো।
মা: মারে চারিদিকে এত ময়লা, এত ধুলাবালি আমি যে সহ্য করতে পারিনা রে মা, খুব কষ্ট হয় খুব কষ্ট লাগে রে।
জুই: হইছে আর গোসল করতে হইবো না মা, এবার বের হইয়া আসো।
মা: হ্যাঁরে মা, আমি মইরা গেলে তোর কি খুব কষ্ট হইবো।
জুই: কী যে কও না মা, আসো মা বিছানার উপরে বস, আজ তোমারে আমি নিজ হাতে চা বানাইয়া খাওয়ামো, আর চুলে তেল দিয়া দিমু।
মা: হ মা দে, মাথাটা খুব গরম হইয়া আছে।
জুঁইয়ের বিয়ে হয়েছে, বেশ ভালো ভাবেই কাজ সম্পন্ন করেছে সানজিদা, আত্মীয়-স্বজনরা খুব সাহায্য করেছে।
রয়েল: মা ও মা, আমার না পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে, আমি জি পি এ ৫ পেয়েছি।
মা: বাবা খুব ভালো, খুব ভালো, আমি খুব খুশি হয়েছিরে বাবা।
মা কি আসলেই খুশি হয়েছে, মা আগের মত করে হাসে না, অফিস থেকে চলে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা ঝর্ণার পানিতে গোসল করে আর মাঝে মাঝেই বলে বাইরে নাকি অনেক ময়লা অনেক ধুলাবালি।
সানজিদার অফিসে অবস্থান এখন বেশ ভালো, প্রতিমাসেই দুই-একটা বা তিন-চারটে ফ্ল্যাট বা প্লট বিক্রি হচ্ছে, মালিকপক্ষ ওনার কাজে সবাই খুব খুশি। মেয়ে জুই অষ্ট্রেলিয়া চলে গেছে, ছেলেটাও রাজউক কলেজে ভর্তি হয়েছে, ছোট মেয়েটাও পড়াশোনায় ভালো করছে, জুয়েল যে ছেলেটার সাথে বিয়ে হয়েছে ওই তাদের দায়িত্ব নিয়েছে।
জুই: হ্যালো, কিরে কেয়া তোরা কেমন আছিস।
কেয়া: হ্যাঁ, আপা আমরা ভালো আছি, তুমি, দুলাভাই তোমরা ভালো আছো তো।
জুই: হ্যাঁ খুব ভালো আছি, রয়েল কোথায়।
কেয়া: ও কলেজে।
জুই: মা কইরে।
কেয়া: মার কথা আর বলো না, খালি গোসল করে, এখন দিনে দুই তিনবার, শুক্রবার তো প্রায় সারাদিন গোসলখানায় থাকে, হ্যাঁ আপা মাকে বোধহয় ডাক্তার দেখাতে হবে।
কেয়া: আপা মা গোসলখানা থেকে বের হয়েছে, নাও কথা বলো।
জুই: মা তুমি আবারও এতক্ষণ গোসলখানায় গোসল করলে, যদি ঠান্ডা হয় অসুস্থ হয়ে যাও।
মা: নারে মা, না, আমার আর কিছু হবেনা , মাদের যে কিছু হয় না, হতে নেই।
জুই: মা তুমি এমন হেঁয়ালি করে কথা বলবে না তো, আমার না খুব ভয় হয়।
মা: যাক তুই তো আছিস রয়েল ও কেয়ার জন্য, আমি না এখন খুব ক্লান্তি অনুভব করি রে, তুই কিন্তু মা ওদের পাশে থাকিস।
জুই: কেন তুমি এসব কথা বলছো, মা দেখো, ডাক্তার দেখাও ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করো দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।
মা: হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, হ্যাঁরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
লাইনটা কেটে গেল গভীর ঘুম আসছে সানজিদার, যেন কত বছর সে ঘুমায় না, না খেয়ে বৃহস্পতিবার রাতে ঘুমিয়ে পড়ল, বিভিন্ন শহরেই তো তাকে মার্কেটিংয়ের কাজে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে, কত কাজ, কত রকম কাজ।
স্বপ্না: কে, কে।
ময়না: আপা আমি।
স্বপ্না: হ্যাঁ রে, কেমন আছিস, ভালো আছিস তো।
ময়না: হ্যাঁ ভালোই আছি, জানো আপা এক মজার ঘটনা ঘটেছে, আজকাল নাকি ক্লায়েন্টরা বয়স্ক মহিলা খোঁজ করছে, মোকসেদ ভাই তো তাই বলল।
স্বপ্না আপা দেখবা নাকি, মোকসেদ ভাই এর শিকার, এই ভিডিও দিয়েই তো ব্ল্যাকমেইল কইরা মোকসেদ ভাই অনেক টাকা আয় করছে, মহিলাটা নাকি অনেক ভালো, সংসারে স্বামী নাই, তিনটা বাচ্চা, মাঝে-মাঝে কাইন্দা কাইন্দা নাকি কইতো, যা করতাছি ফান্দে পইরা করতাছি, টাকাও পাইতাছি, বাচ্চারাও মানুষ হইতাছে, সৃষ্টিকর্তাও ঠিক ওনারে নাকি মাফ কইরা দিব। এই কামে ফাইসা যাওনের পর থেকে উনি, যেখানে কাম করে ওখানের প্লট ও ফ্ল্যাট বিক্রি ও উনি অনেক ভাল ভাবে করতে পারছে।
সপ্না: দেখি দেখি ভিডিওটা দেখি।
একই সানজিদা আপা।
ময়না: আপা তুমি চেনো নাকি।
স্বপ্না: না, অনেক আগে একদিন ওনার অফিসে দেখা হয়েছিল।
ময়না: আপা, আজ উঠতে হবে, ভালো থেকো আপা।
স্বপ্না: আচ্ছা যা, ভালো থাকিস।
মনটা খারাপ হয়ে গেল, সানজিদা আপা কি করে ওই পিশাচ মোকছেদের খপ্পরে পড়লো, হায়রে জীবন।
স্বপ্না: কেয়া মা, কিয়া কেমন আছো মা।
কেয়া: জি, আন্টি ভালো, আপনি ভালো আছেন তো।
রত্না: হ্যাঁ ভালো, তোমার আম্মা কোথায় মা।
কেয়া: মা গোসল খানায়, খালি গোসল করে, গত সাত দিন হল মা অফিসে যাচ্ছেন না, প্রতিদিন তিন চারবার ১ থেকে ২ ঘন্টা করে গোসল করেন। ওনার শরীরে নাকি ময়লা নোংরা, কথায় কথায় রেগে যান। আজ ছোট মামা আসবেন, ও এইত মামা এসে গেছেন।
মামা: রয়েল, কইরে আয় বাবা আমার সাথে যাবি, আজি ডাক্তার বলেছে তোর মাকে জাতীয় মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
কেয়া: দাঁড়াও মামা মার জামাকাপড় এর ব্যাগটা দিয়ে দিচ্ছি।
মা: ছাড়, আমাকে ছাড়, আমি কোথাও যাবো না, আমি গোসল করব, সব ময়লা যে আমাকে ধুয়ে ফেলতে হবে।
*******************
কবি ও লেখক: মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন (সাবেক সেনা কর্মকর্তা)
তারিখ : ০৮-১০-২০১৯