রাসুল (সা.)-কে আল্লাহ পাঠিয়েছেন সুসংবাদদাতা, সতর্ককারী, শিক্ষক, সহজকারী, শিক্ষাবিদ ও পবিত্রকারী হিসেবে। কোরআনে বলা হয়েছে, “হে নবী, আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষী, সুসংবাদদাতা, সতর্ককারী এবং আল্লাহ মহানের অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারী ও আলোকবর্তিকা হিসেবে।” (সুরা আহযাব, আয়াত: ৪৫-৪৬)
আবার বলা হয়েছে, “তিনিই তাঁদের মধ্য থেকে নিরক্ষরদের জন্য একজন রাসুল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে তাঁর আয়াত পাঠ করেন, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেন।” (সুরা জুমা, আয়াত: ২)
জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ মহান আমাকে কঠোর বা জটিলকারী হিসেবে পাঠাননি; বরং আমাকে শিক্ষক ও সহজকারী হিসেবে পাঠিয়েছেন।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৪৭৮)
আরবি ভাষায় অন্তিম উপদেশকে বলে অসিয়ত। অসিয়ত বলতে বোঝায় কাউকে মৃত্যুর পর কিছু করার জন্য নির্দেশ দেওয়া বা কোনো কাজের দায়িত্ব অর্পণ করা।
অন্তিম উপদেশের ধারণা
আরবি ভাষায় অন্তিম উপদেশকে বলে অসিয়ত। অসিয়ত বলতে বোঝায় কাউকে মৃত্যুর পর কিছু করার জন্য নির্দেশ দেওয়া বা কোনো কাজের দায়িত্ব অর্পণ করা; যেখানে দুনিয়ার কল্যাণকে আখিরাতের কল্যাণের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। সত্যিকারের উপদেশ কেবল একজন আন্তরিক, সৎ ও কল্যাণকামী ব্যক্তি থেকেই আসে।
রাসুল (সা.) ছিলেন এমন একজন, যিনি সাহাবিদের এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য সর্বদা কল্যাণ কামনা করতেন। কোরআনে বলা হয়েছে, “তোমাদের মধ্য থেকে একজন রাসুল এসেছেন, যিনি তোমাদের দুঃখ-কষ্টে কষ্ট পান, তোমাদের কল্যাণের জন্য অত্যন্ত আগ্রহী এবং মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল ও দয়ালু।” (সুরা তাওবা, আয়াত: ১২৮)।
যখন এমন একজন আন্তরিক ব্যক্তি উপদেশ দেন, তখন তা গ্রহণ করা এবং তদনুযায়ী আমল করা প্রতিটি মুমিনের দায়িত্ব। বিশেষ করে যখন এই উপদেশ রাসুল (সা.)-এর, যিনি উম্মাহকে সব ভালো কাজের পথ দেখিয়েছেন এবং সব মন্দ কাজ থেকে সতর্ক করেছেন। কিছু উপদেশ যদিও নির্দিষ্ট সাহাবীর প্রতি দেওয়া হয়েছিল, তবে এগুলো সব মুসলিমের জন্য প্রযোজ্য।
সাহাবিদের প্রতি উপদেশ
আবু যার (রা.)-এর প্রতি উপদেশ: আবু যার (রা.) বলেন, “আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আমাকে উপদেশ দিন।’ তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে কোরআন তিলাওয়াত এবং আল্লাহর জিকিরের উপদেশ দিচ্ছি। কারণ, এটি তোমার জন্য দুনিয়াতে আলো এবং জান্নাতে সম্পদ।’ আমি বললাম, ‘আরও বলুন।’ তিনি বললেন, ‘অতিরিক্ত হাসি থেকে বিরত থাকো, কারণ এটি হৃদয়কে মৃত করে দেয়।’ (ইবনে হিব্বান, হাদিস: ৬৪৩৪)
এই উপদেশে অতিরিক্ত হাসি-ঠাট্টার ক্ষতি সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত হাসি হৃদয়ের সংবেদনশীলতা নষ্ট করে, যা আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য ক্ষতিকর।
অতিরিক্ত হাসি থেকে বিরত থাকো, কারণ এটি হৃদয়কে মৃত করে দেয়।
ইবনে হিব্বান, হাদিস: ৬৪৩৪
আবু হুরায়রা (রা.)-এর প্রতি উপদেশ: আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, “আমার প্রিয় বন্ধু রাসুল (সা.) আমাকে তিনটি উপদেশ দিয়েছেন: প্রতি মাসে তিন দিন রোজা পালন করা, দুই রাকআত চাশতের নামাজ পড়া এবং ঘুমানোর আগে বিতর নামায পড়া” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৯৮১)
বিদায় হজের উপদেশ
মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের শেষ সময়ে, যখন তিনি আরাফাতের ময়দানে ১০ হিজরির ৯ জিলহজে লাখো মুসলমানের সামনে ভাষণ দেন, তখন বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ প্রদান করেন।
১. আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর ইবাদত: মহানবী (সা.) জোর দিয়ে বলেন যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং তাঁর ইবাদত করতে হবে। তিনি মুশরিকি ও অন্যায় আচরণ থেকে বিরত থাকতে বলেন।
২. কুরআন ও সুন্নাহর প্রতি আনুগত্য: তিনি বলেন, “আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যদি তা দৃঢ়ভাবে ধরে রাখো, তবে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না: আল্লাহর কিতাব (কুরআন) এবং আমার সুন্নাহ।” (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১৮৫১৭; সুনানে দারিমি, হাদিস: ২৬১৯)
৩. মানুষের সমতা: তিনি বলেন, “কোনো আরবের উপর অ-আরবের, কোনো সাদার উপর কালোর, বা কোনো কালোর উপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, শ্রেষ্ঠত্ব কেবল তাকওয়া (আল্লাহভীতি) দ্বারা।” (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২৩৪৮৯)
৪. রক্ত, সম্পদ ও সম্মানের পবিত্রতা: তিনি বলেন, “তোমাদের রক্ত, সম্পদ ও সম্মান একে অপরের জন্য হারাম (নিষিদ্ধ), যেমন এই কাবাঘর সম্মানিত।” (সহিহ বুখারি, হাদিস নং: ১০৫; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৬৭৯)
৫. নারীদের প্রতি সদাচরণ: তিনি বলেন, “তোমরা নারীদের প্রতি সদাচরণ করো, কারণ তারা তোমাদের দায়িত্বে ন্যস্ত।” (জামে তিরমিজি, হাদিস: ১১৬৩)
৬. ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব: তিনি মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে এবং বিভেদ এড়াতে উপদেশ দেন। তিনি বলেন, “তোমরা বিভক্ত হয়ো না এবং পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া করো না।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১২১৮)
৭. আমানতের প্রতি যত্নশীলতা: তিনি বলেন, “তোমরা আমানত ফিরিয়ে দাও যার কাছে তা রাখা হয়েছে এবং প্রতারণা করো না।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২৩৮৪)
তিনি মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে এবং বিভেদ এড়াতে উপদেশ দেন। তিনি বলেন, “তোমরা বিভক্ত হয়ো না এবং পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া করো না।”
শেষ উপদেশ
মহানবী (সা.)-এর দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার আগ মুহূর্তে তাঁর শেষ উপদেশ ছিল নামাজের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া এবং মানুষের প্রতি সদাচরণের নির্দেশ। তিনি তাঁর শেষ মুহূর্তে বলেছিলেন: “আস-সালাত, আস-সালাত, ওয়া মা মালাকাত আইমানুকুম” (অর্থাৎ, নামাজ, নামাজ এবং তোমাদের অধীনস্থদের প্রতি সদাচরণ করো)। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২৪২১৭)
এটি তাঁর জীবনের শেষ বাক্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নবীজি (সা.) তাঁর শেষ মুহূর্তে নামাজ এবং অধীনস্থদের প্রতি সদাচরণের কথা বলেছেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৯৪৭)
রাসুল (সা.)-এর উপদেশগুলো মুসলিমদের জন্য জীবনাচরণের পথপ্রদর্শক। এগুলো কেবল সাহাবীদের জন্য নয়, বরং প্রতিটি মুসলিমের জন্য প্রযোজ্য। এই উপদেশগুলো আমাদেরকে আল্লাহ মহানের ইবাদতে আন্তরিকতা, সৎকর্ম, উত্তম আখলাক এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালনের শিক্ষা দেয়। আমাদের উচিত এই উপদেশগুলো গ্রহণ করা এবং জীবনে প্রয়োগ করা, যাতে আমরা দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভ করতে পারি।