নবুয়তপূর্ব জীবনের কিছু ঘটনা মহানবী (সা.)-এর মহান চরিত্র, নৈতিকতা এবং সমাজে তাঁর প্রভাবের প্রমাণ বহন করে। এর মধ্যে হারবুল ফিজার ও হিলফুল ফুজুল অন্যতম।
এই ঘটনাগুলো তাঁর যৌবনকালে মক্কার সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঘটেছিল, যা তাঁর নবুয়তের পূর্বাভাস এবং তাঁর নৈতিক মর্যাদার প্রকাশ ঘটায়। এ ছাড়া খাদিজা (রা.)-এর সঙ্গে বিবাহের ঘটনাও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তাঁর প্রথম জীবনের ৫টি দৃশ্যপট হাজির করছি।
১. হারবুল ফিজার: অধর্মের যুদ্ধ
হারবুল ফিজার ছিল মক্কায় কুরাইশ এবং তাদের মিত্র কিনানা গোত্র এবং কায়স আইলান গোত্রের মধ্যে একটি সংঘাত। ইবনে কাসিরের মতে, এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল যখন মহানবীর বয়স ছিল ২০ বছর। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ২/২৮১, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)
তবে ইবনে হিশামের বর্ণনায় বলা হয়েছে, তাঁর বয়স তখন ১৪ বা ১৫ বছর ছিল। (সিরাতুন নবী, ১/১৮৬, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
আমি আমার চাচাদের জন্য তির ফিরিয়ে দিতাম, যখন শত্রুরা তাদের ওপর তির নিক্ষেপ করত।
ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/১৮৮
এই যুদ্ধের নাম “ফিজার” (অধর্ম) রাখা হয় কারণ এটি পবিত্র মাসে (শাবান) সংঘটিত হয়, যখন যুদ্ধ ছিল নিষিদ্ধ। মহানবী এই যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেননি; তিনি তাঁর চাচাদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন এবং তাঁদের জন্য তির সংগ্রহ করতেন। তিনি বলেন, “আমি আমার চাচাদের জন্য তির ফিরিয়ে দিতাম, যখন শত্রুরা তাদের ওপর তীর নিক্ষেপ করত।” (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/১৮৮, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
যুদ্ধটি চারটি ভিন্ন ভিন্ন নামের দিনে বিভক্ত ছিল: শামতা, আবলা, শারিব ও হুরাইরা। নবীজি (সা.) ‘শারিব’ নামের দিন, যেদিন সবচেয়ে তীব্র যুদ্ধ হয়, সেদিন উপস্থিত ছিলেন। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ২/২৮৩, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)
২. হিলফুল ফুজুল: ন্যায়ের শপথ
হারবুল ফিজারের চার মাস পর, জিলকদ মাসে হিলফুল ফুজুল নামে একটি ঐতিহাসিক শপথ গ্রহণ করা হয়। এটি ছিল আরবদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত চুক্তি। এই শপথের উৎপত্তি হয় যখন যুবাইদ গোত্রের একজন ব্যক্তি মক্কায় ব্যবসার জন্য এসে আস ইবনে ওয়াইলের কাছে তার পণ্য বিক্রি করেন, কিন্তু তিনি তার পাওনা পরিশোধ করেননি।
যুবাইদি ব্যক্তি কাবার কাছে দাঁড়িয়ে সাহায্যের জন্য চিৎকার করে বলেন, “হে ফিহরের লোকেরা, আমি একজন মজলুম, মক্কার উপত্যকায় আমার অধিকার হরণ করা হয়েছে।” (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/১৯০, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
এই ঘটনায় যুবাইর ইবনে আবদুল মুত্তালিব উদ্যোগী হন এবং হাশিম, যুহরা ও তাইম গোত্রের নেতাদের নিয়ে আবদুল্লাহ ইবনে জুদ্আনের বাড়িতে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তারা শপথ করেন যে, তারা মক্কায় কোনো মজলুমের পক্ষে দাঁড়াবে, তিনি মক্কার বাসিন্দা হন বা বাইরের লোক। (আবু বকর আল-বাইহাকি, দালাইলুন নুবুওয়া, ২/৩৬, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৮৫)
হারবুল ফিজারের চার মাস পর, জিলকদ মাসে হিলফুল ফুজুল নামে একটি ঐতিহাসিক শপথ গ্রহণ করা হয়। এটি ছিল আরবদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত চুক্তি।
নবীজি (সা.) এই চুক্তিতে অংশ নেন এবং বলেন, “আমি আবদুল্লাহ ইবনে জুদআনের বাড়িতে এমন একটি শপথে অংশ নিয়েছিলাম, যা আমার কাছে লাল উটের চেয়েও প্রিয়। এমনকি ইসলামের যুগেও যদি আমাকে এই শপথের জন্য ডাকা হতো, আমি সাড়া দিতাম।” (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/১৯১, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
এই শপথের প্রভাব পরবর্তীকালে দেখা যায়, যখন হুসাইন (রা.) মদিনায় ওয়ালিদ ইবনে উতবার বিরুদ্ধে এই শপথের নামে প্রতিকার দাবি করেন এবং আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর ও অন্যান্যরা তাঁর সমর্থনে দাঁড়ান। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/১৯২, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
৩. খাদিজার সঙ্গে বিবাহ
খাদিজা ছিলেন কুরাইশের একজন সম্ভ্রান্ত ও ধনী ব্যবসায়ী নারী। তিনি মহানবীর সততা, নৈতিকতা ও বিশ্বস্ততার কথা শুনে তাঁকে তাঁর ব্যবসার জন্য শামে পাঠান। তিনি মহানবীকে অন্যান্য ব্যবসায়ীদের চেয়ে বেশি মজুরি দেওয়ার প্রস্তাব দেন এবং তাঁর সঙ্গে তাঁর গোলাম মাইসারাকে পাঠান। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/১৯৩, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
মহানবী শামে যান এবং একটি গাছের নিচে বিশ্রাম নেন। সেখানে একজন খ্রিষ্টান সন্ন্যাসী মাইসারাকে বলেন, “এই গাছের নিচে কেবল একজন নবীই বিশ্রাম নিতে পারেন।” (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/১৯৪, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
মাইসারা আরও লক্ষ্য করেন যে, তীব্র গরমে দুজন ফেরেশতা মেঘ হয়ে মহানবীকে ছায়া দিচ্ছে।
মক্কায় ফিরে আসার পর দেখা যায় খাদিজা তাঁর ব্যবসায় ব্যাপক মুনাফা লাভ করেছেন। তিনি মাইসারার কাছ থেকে বাণিজ্যপথের ঘটনাগুলো শুনে মুগ্ধ হন এবং তাঁর বোনের মাধ্যমে মহানবীকে বিবাহের প্রস্তাব দেন, বলেন, “তোমার আত্মীয়তা, গোত্রে তোমার মর্যাদা, সততা, নৈতিকতা এবং সত্যবাদিতার কারণে আমি তোমাকে পছন্দ করেছি।” (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/১৯৫, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
মহানবী শামে যান এবং একটি গাছের নিচে বিশ্রাম নেন। সেখানে একজন খ্রিষ্টান সন্ন্যাসী মাইসারাকে বলেন, “এই গাছের নিচে কেবল একজন নবীই বিশ্রাম নিতে পারেন।” মহানবী তাঁর চাচা হামজার সঙ্গে খাদিজার পিতা বা চাচা আমর ইবনে আসাদের কাছে গিয়ে খাদিজাকে বিয়ের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠান। তাঁর বয়স তখন ২৫ বছর এবং খাদিজার বয়স ৩৫ বা ২৫ বছর বলে বিভিন্ন মত রয়েছে। (আবু বকর আল-বাইহাকি, দালাইলুন নুবুওয়া, ২/৬৮, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৮৫)
খাদিজা তাঁকে ২০টি উট দেন। এটি ছিল নবীজির প্রথম বিবাহ এবং খাদিজার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি অন্য কোনো স্ত্রী গ্রহণ করেননি। ইবরাহিম ছাড়া নবীজির সকল সন্তানের জননী ছিলেন খাদিজা (রা.)। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/১৯৬, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)।
৪. কাবার পুনর্নির্মাণে ন্যায়সঙ্গত ফয়সালা
তাঁর বয়স যখন ৩৫ বছর, তখন কুরাইশের সকলে কাবা পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। কাবার ধনভাণ্ডারে চুরি এবং বন্যার কারণে এর দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তারা কাবার উচ্চতা বাড়াতে এবং ছাদ দিতে চান।
তবে কাবা ভাঙার সময় তারা ভয় পান, কারণ একটি সাপ প্রতিদিন কাবার কূপ থেকে বেরিয়ে দেয়ালে উঠত। একদিন একটি পাখি সেই সাপকে তুলে নিয়ে যায়। কুরাইশরা এটা দেখে অনুমান করে, তাদের সংস্কার ইচ্ছা আল্লাহর অনুমোদন করেছেন। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/১৯৮, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
নির্মাণের সময় হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) স্থাপন নিয়ে কুরাইশ গোত্রগুলোর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। তারা সিদ্ধান্ত নেন, প্রথম যিনি মসজিদে প্রবেশ করবেন, তিনিই এই বিরোধ নিষ্পত্তি করবেন। নবীজি প্রথম প্রবেশ করেন। এর আগে থেকেই সততার জন্য তাঁকে “আল-আমিন” (বিশ্বস্ত) বলে ডাকা হতো। তিনি একটি কাপড়ে হাজরে আসওয়াদ রাখেন এবং প্রতিটি গোত্রকে কাপড়ের একটি প্রান্ত ধরে তুলতে বলেন। শেষে তিনি নিজ হাতে পাথরটি স্থাপন করেন। এতে সবাই সন্তুষ্ট হন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৫৮২)
৫. নবুয়তের পূর্বাভাস
নবুয়তের পূর্বে বিভিন্ন ঘটনা নবীজির আগমনের পূর্বাভাস দিয়েছিল। খাদিজার চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নাওফাল, যিনি ছিলেন একজন খ্রিষ্টান পণ্ডিত, মাইসারার বর্ণনা শুনে বলেন, “যদি এটি সত্য হয়, তবে মুহাম্মদ এই উম্মতের নবী। আমি জানতাম যে এই সময়ে একজন নবী আসবেন।” (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, খণ্ড ১, পৃ. ১৯৭, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
তবে কাবা ভাঙার সময় তারা ভয় পান, কারণ একটি সাপ প্রতিদিন কাবার কূপ থেকে বেরিয়ে দেয়ালে উঠত। একদিন একটি পাখি সেই সাপকে তুলে নিয়ে যায়।
তিনি তাঁর কবিতায় মহানবীর (সা.) আগমনের প্রত্যাশা প্রকাশ করেন। এছাড়া, ইহুদি ও খ্রিষ্টান পণ্ডিতরা তাঁর আগমনের কথা তাদের কিতাবে পেয়েছিলেন। কোরআনে বলা হয়েছে, “তারা তাঁকে তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পায়, যিনি মানুষকে সৎকাজের নির্দেশ দেন এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করেন।” (সুরা আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৭)।
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, “আল্লাহ প্রত্যেক নবীর কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন যে, মুহাম্মদ যদি তাদের সময়ে আসেন, তবে তারা তাঁর প্রতি ইমান আনবেন এবং তাঁকে সমর্থন করবেন।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৪৪১)
সালমান ফারসির জীবনী এই পূর্বাভাসের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। তিনি খ্রিষ্টান সন্ন্যাসীদের কাছ থেকে মহানবীর বৈশিষ্ট্য শুনে মদিনায় এসে তাঁর সাথে সাক্ষাত করেন এবং তাঁর কাঁধে নবুয়তের মোহর দেখে ইসলাম গ্রহণ করেন (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/২৩৮-২৪৩, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)।