ভারতে এয়ার ইন্ডিয়ার উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে অনেকেই আশা করেছিলেন, এবার দুর্ঘটনাটি সম্পর্কে একটা মীমাংসা হবে। গত মাসে গুজরাটে হওয়া এ দুর্ঘটনায় ২৬০ জন নিহত হন।
কিন্তু ১৫ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনটি জল্পনাকল্পনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিবেদনের সংযত ভাষা সত্ত্বেও এর একটি তথ্য তদন্তকারী, উড়োজাহাজ বিশ্লেষক এবং সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগাচ্ছে।
আকাশে ওঠার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ১২ বছরের পুরোনো বোয়িং–৭৮৭ উড়োজাহাজের জ্বালানি সরবরাহের দুটি সুইচই (ফুয়েল-কন্ট্রোল সুইচ) হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়।
ককপিটের ভয়েস রেকর্ডিংয়ে শোনা যায়, একজন বিমানচালক আরেকজনকে জিজ্ঞেস করছেন, তিনি ‘কেন এটা বন্ধ করেছেন’। উত্তরে দ্বিতীয়জন বলছেন, তিনি বন্ধ করেননি। তবে কোন বিমানচালক কোন কথাটা বলেছেন, রেকর্ডিং থেকে তা বোঝা যায়নি। মাটি ছেড়ে উড়ে যাওয়ার সময় সহবিমানচালক উড়োজাহাজটি চালাচ্ছিলেন। আর ক্যাপ্টেন তদারক করছিলেন।
প্রাথমিক প্রতিবেদনে সম্পূর্ণ ককপিট ভয়েস রেকর্ডারের (সিভিআর) ট্রান্সক্রিপ্ট প্রকাশ করা হয়নি। শুধু উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার আগের মুহূর্তের একটি ভয়েস রেকর্ড প্রকাশ করা হয়েছে।
জ্বালানি সুইচগুলো পরে আবার উড়ন্ত অবস্থায় যেমন থাকে, তেমন অবস্থানে নেওয়া হয়। এতে ইঞ্জিন স্বয়ংক্রিয়ভাবে আবারও চালু হয়। বিধ্বস্ত হওয়ার সময় একটি ইঞ্জিন শক্তি ফিরে পেয়ে সচল হচ্ছিল। কিন্তু অন্যটি মাত্র চালু হয়েছিল, শক্তি ফিরে পায়নি। উড়োজাহাজটি এক মিনিটের কম সময় আকাশে ছিল। এরপর গুজরাট রাজ্যের আহমেদাবাদ শহরের একটি আবাসিক এলাকায় ভেঙে পড়ে।
প্রাথমিক প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর বিভিন্ন অনুমাননির্ভর তত্ত্ব সামনে এসেছে। সম্পূর্ণ তদন্ত প্রতিবেদন পেতে এক বছর কিংবা আরও বেশি সময় লাগতে পরে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ‘গত মাসে এয়ার ইন্ডিয়ার উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার তদন্তে পাওয়া নতুন তথ্য ককপিটে থাকা জ্যেষ্ঠ পাইলটের দিকে নজর ঘুরিয়ে দিচ্ছে।’
ইতালির সংবাদপত্র করিয়েরে দেলা সেরা দাবি করেছে, তাদের সূত্র বলেছে ফার্স্ট অফিসার (সহবিমানচালক) বারবার ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন তিনি ইঞ্জিন বন্ধ করেছিলেন।
ওই ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন ছিলেন ৫৬ বছর বয়সী সুমিত সভারওয়াল। সহবিমানচালক ছিলেন ৩২ বছর বয়সী ক্লাইভ কুণ্ডার। উড়োজাহাজটি তিনি চালাচ্ছিলেন। তাঁদের দুজনের ১৯ হাজার ঘণ্টার বেশি উড়োজাহাজ চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল, যার প্রায় অর্ধেকটাই বোয়িং ৭৮৭-এ। ফ্লাইট চালানোর আগে দুজনই স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
এ ধরনের জল্পনাকল্পনা ফাঁসের ঢেউ তদন্তকারীদের বিচলিত করেছে। আর বিষয়টি ভারতীয় বিমানচালকদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
ওই ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন ছিলেন ৫৬ বছর বয়সী সুমিত সভারওয়াল। সহবিমানচালক ছিলেন ৩২ বছর বয়সী ক্লাইভ কুণ্ডার। উড়োজাহাজটি তিনি চালাচ্ছিলেন।
গত সপ্তাহে দুর্ঘটনার প্রধান তদন্ত সংস্থা ভারতের দুর্ঘটনা তদন্ত ব্যুরোর (এএআইবি) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘কিছু কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম পছন্দসই এবং যাচাই না করা তথ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত টানার চেষ্টা করছে।’ বিজ্ঞপ্তিটি বলছে, তদন্ত চলমান থাকার সময় এ ধরনের কর্মকাণ্ড দায়িত্বজ্ঞানহীন।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ডের চেয়ারওম্যান জেনিফার হোমেনডি তদন্তে সহায়তা করছেন। তিনি এক্সে (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে লিখেছেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো ‘অপরিণত ও অনুমাননির্ভর’। তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনার তদন্তে অনেক সময় লাগে।
তড়িঘড়ি করে বিমানচালকদের দায়ী করার প্রচেষ্টাকে ‘হঠকারী’ ও ‘অত্যন্ত অসংবেদনশীল’ বলে এর নিন্দা জানিয়েছে ভারতের উড়োজাহাজ চালকদের সংগঠন ইন্ডিয়ান কমার্শিয়াল পাইলটস অ্যাসোসিয়েশন। চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত সংযম বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে তারা।
ভারতীয় বিমানচালকদের আরেকটি সংগঠন এয়ারলাইন পাইলটস অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার প্রধান স্যাম থমাস বিবিসিকে বলেন, ‘স্বচ্ছতাকে ডিঙিয়ে জয়ী হয়েছে অনুমান।’ তিনি ককপিট ভয়েস রেকর্ডারের পাশাপাশি উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণের ইতিহাস ও নথিপত্র পর্যালোচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কানাডাভিত্তিক একজন উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা তদন্তকারী বলেছেন, প্রতিবেদনে কথোপকথনের যে অংশটি প্রকাশিত হয়েছে, তা কয়েকটি সম্ভাব্য পরিস্থিতির কথা বলে।
ওই তদন্তকারী বলেন, যদি ‘পাইলট বি’ ভুলবশত বা অজান্তেই সুইচগুলো চালু করে থাকেন, পরে তিনি তা অস্বীকার করতেই পারেন।
‘কিন্তু “পাইলট এ” যদি ইচ্ছাকৃত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সুইচগুলো নাড়াচাড়া করে থাকেন, তাহলে তিনি হয়তো জেনেবুঝেই ওই প্রশ্ন করেছেন। কারণ, তিনি জানতেন ককপিট ভয়েস রেকর্ড তদন্ত করা হবে। এভাবে তিনি মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে দিতে এবং নিজের দায় এড়াতে চাইতে পারেন,’ বলেন কানাডার ওই তদন্তকারী।
ভারতের তদন্ত সংস্থার উচিত পুরো ভয়েস রেকর্ডার ট্রান্সক্রিপ্ট প্রকাশ করা, যেখানে পাইলটদের কণ্ঠস্বর শনাক্ত করা হবে।
পিটার গোয়েলজ, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ডের (এনটিএসবি) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক
ওই তদন্তকারী বলছেন, এএআইবি শেষ পর্যন্ত যদি শনাক্ত করতেও পারে কে কোন কথা বলেছেন, তবু নিশ্চিতভাবে জানা যাবে না যে জ্বালানির সুইচ কে বন্ধ করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা হয়তো কখনোই এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানতে পারব না।’
ভারতের দুর্ঘটনার তদন্তকারীরা বিবিসিকে বলেছেন, জ্বালানি সুইচগুলো হাত দিয়ে বন্ধ করার যথেষ্ট পোক্ত প্রমাণ আছে বলে মনে হচ্ছে। তবু সব সম্ভাবনার জন্য ‘মন খোলা রাখা’ এখনো গুরুত্বপূর্ণ।
কিছু কিছু বিমানচালকের মতে, উড়োজাহাজের ফুল অথরিটি ডিজিটাল ইঞ্জিন কন্ট্রোল (এফএডিইসি) ব্যবস্থায় ত্রুটি দেখা দিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এফএডিইসি ইঞ্জিনের অবস্থা ও কর্মক্ষমতা পর্যবেক্ষণে রাখে।
প্রাথমিক প্রতিবেদনে ককপিট ভয়েস রেকর্ডারের (সিভিআর) সম্পূর্ণ ট্রান্সক্রিপ্ট বা লিখিত বয়ান প্রকাশ করা হয়নি। শুধু উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার আগের কয়েক মুহূর্তের একটি কথোপকথন প্রকাশ করা হয়েছে। বেছে বেছে এটুকু বয়ান প্রকাশ করায় প্রশ্ন উঠেছে যে তদন্তকারী দল কি কথোপকথনকারীদের পরিচয় নিশ্চিত করতে পেরেছে; কিন্তু সংবেদনশীলতার কারণে তা চেপে গেছে? নাকি তারা এখনো তা নিশ্চিত হতে পারেনি এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাতে তাদের আরও সময় দরকার?
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ডের (এনটিএসবি) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পিটার গোয়েলজ বলেছেন, ভারতের তদন্ত সংস্থার উচিত বিমানচালকদের কণ্ঠস্বর শনাক্ত করে পুরো রেকর্ডিংয়ের লিখিত বয়ান প্রকাশ করা।
পিটার গোয়েলজ বলেন, উড়ালের সময় উড়োজাহাজে কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে তা ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডারে (এফডিআর) ধরা পড়ত। পাশাপাশি এমন ত্রুটি ফ্লাইট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে সতর্কবার্তা দিত। সেগুলো বিমানের কর্মীরা নিশ্চিতভাবে খেয়াল করতেন এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করতেন।
তদন্তকারীরা তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ওহাইও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উড়োজাহাজ নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক বিমান দুর্ঘটনা তদন্তকারী শন প্রুচনিকি বলেন, ‘আমাদের সতর্ক হতে হবে। কারণ, সুইচগুলো বন্ধ করা হয়ে থাকলে সেটাকে বিমানচালকের ইচ্ছাকৃত ভুল, আত্মহত্যা বা অন্য যেকোনো কিছু বলে ধরে নেওয়াটা সহজ কাজ। কিন্তু আমাদের হাতে যে সীমিত তথ্য আছে, তার ভিত্তিতে এ ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক।’
এদিকে বাজারে নানা বিকল্প তত্ত্ব ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসসহ কয়েকটি ভারতীয় সংবাদপত্র উড়োজাহাজের লেজে বৈদ্যুতিক আগুন লাগাকে দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে গুরুত্ব দিচ্ছে।
কিন্তু প্রাথমিক প্রতিবেদন স্পষ্ট করেছে যে উড়োজাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ হয়েছিল; কারণ দুটি জ্বালানি সুইচই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ফ্লাইট রেকর্ডার এই তথ্যকেই নিশ্চিত করেছে। একজন স্বাধীন তদন্তকারী আরও বলছেন যদি উড়োজাহাজের পেছনে আগুন ধরে থাকে, তাহলে সেটি দুর্ঘটনার পর ঘটেছে বলে মনে হয়। ছিটকে পড়া জ্বালানি বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাটারি থেকেও আগুন লাগতে পারে।
গত সপ্তাহে এএআইবির প্রধান জিভিজি যুগান্ধর জোর দিয়ে বলেন, প্রাথমিক প্রতিবেদনের লক্ষ্য হলো কী ঘটেছে, সে সম্পর্কে তথ্য দেওয়া।
জিভিজি যুগান্ধর বলেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য আরও সময় দিতে হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এখনো তদন্ত চলছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার মূল কারণ এবং প্রয়োজনীয় সুপারিশ থাকবে। প্রযুক্তিগত বা জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে নতুন কিছু পেলে সেটা সবাইকে জানানো হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।