চলতি বছরের মে মাসে ভারতের সঙ্গে যে সামরিক উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল, সেটি হঠাৎই পাকিস্তানের বৈশ্বিক অবস্থানকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এ ঘটনা পাকিস্তানের জন্য একধরনের বিরল কূটনৈতিক ও কৌশলগত সুবিধা নিয়ে এসেছে। এখন দেশটি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে নিজের অবস্থান নতুন করে নির্ধারণ করতে শুরু করেছে।
এই সংঘাত বিপজ্জনক হলেও পাকিস্তানের জন্য এটি এক অপ্রত্যাশিত কূটনৈতিক সুযোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে দিল্লির দীর্ঘদিনের যে প্রচারণা পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিকভাবে আলাদা করে রাখার কাজে ব্যবহার করা হতো, এখন সেটি আর আগের মতো বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। বিশেষ করে পেহেলগামে পাকিস্তানের সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়েছিল বলে ভারতের তোলা অভিযোগের স্পষ্ট প্রমাণ না মেলায় সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে ভারতের প্রচারণা এখন আর গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না।
ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক জবাব ছিল নিয়ন্ত্রিত, কিন্তু দৃঢ়। পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া অনেক পর্যবেক্ষককে চমকে দিয়েছে। এটি এক নতুন কৌশলগত আত্মবিশ্বাসেরও বার্তা দিয়েছে। এই সময়েই ওয়াশিংটনের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতার সম্পর্ক আবারও গোপনে সক্রিয় হয়েছে। এটি পাকিস্তানের কূটনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে। এই নতুন পরিস্থিতিতে কিছু বিষয় বিশেষভাবে নজরে পড়ে। এখন চীন পাকিস্তানের প্রধান কৌশলগত অংশীদার হয়ে উঠেছে। আর চীনের পরই রয়েছে তুরস্ক। একই সঙ্গে পাকিস্তানের ভূগর্ভস্থ বিশাল খনিজ সম্পদের দিকে আন্তর্জাতিক আগ্রহ নতুন করে বাড়ছে।
আফগানিস্তানের বর্তমান পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি এবং পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে অর্জিত সাফল্য দেশটিকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের সময় পাকিস্তানের কূটনৈতিক অবস্থানও দেশটির কৌশলগত গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই পরিবর্তনগুলো ঘটছে এমন একসময়, যখন মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও ককেশাস অঞ্চলে পুরো ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ত্বরিত রূপান্তর ঘটছে।
ভারতের প্রতি তার প্রতিবেশীদের অসন্তুষ্টি বাড়ছে। অন্যদিকে রাশিয়ার আঞ্চলিক ভূমিকাকে এ অঞ্চলের দেশগুলো আগের চেয়ে বেশি স্বার্থকেন্দ্রিক মনে করছে। ফলে পাকিস্তানের সামনে এখন নতুন জোট গড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে পাকিস্তান যদি তার নিজের কৌশলগত অবস্থান ধরে রাখতে পারে, তাহলেই সেটি সম্ভব।
বাইরের সুযোগগুলো কাজে লাগাতে হলে পাকিস্তানের ভেতরের পরিস্থিতি মজবুত করা জরুরি। পাকিস্তান যদি তার নতুন পাওয়া আন্তর্জাতিক গুরুত্ব ধরে রাখতে চায়, তাহলে তাকে দেশের ভেতরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতা আনতে হবে। ভেতরে শক্ত ভিত না থাকলে তার কূটনৈতিক অর্জনগুলো দীর্ঘস্থায়ী না-ও হতে পারে।
পাকিস্তান এখন এই উপলব্ধিতে পৌঁছেছে যে সাম্প্রতিক কৌশলগত ও কূটনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখতে হলে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইকে আরও কার্যকর ও আধুনিকভাবে পরিচালনা করতে হবে।
গত সপ্তাহে সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্ব এই বিষয় স্পষ্টভাবে সামনে এনেছে। তারা বলেছে, সব ধরনের জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সব পর্যায়ে ‘সিদ্ধান্তমূলক ও সার্বিক পদক্ষেপ’ নেওয়া দরকার।
এই আহ্বানই দেখিয়ে দেয় ভবিষ্যতে যদি পাকিস্তান আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজের গুরুত্ব ধরে রাখতে চায়, তাহলে তাকে ভেতর থেকে শক্ত হতে হবে এবং জঙ্গিবাদ দমনে আরও কঠোর ও সমন্বিতভাবে এগোতে হবে।
এই মুহূর্তে পাকিস্তান বেলুচিস্তান ও আফগান সীমান্তবর্তী খাইবার পাখতুনখাওয়া অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ ও বিদ্রোহ দমনে অভিযান চালাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহল এ ধরনের প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এই দুই দেশের কৌশলের ভিন্নতা চোখে পড়ে। ভারত এখনো কূটনৈতিক চাপ তৈরি করতে তার বক্তব্যকেই মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা ও নিয়মকানুন মেনে চলার মাধ্যমে ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজের অবস্থান শক্ত করছে।
তবে এখনো একটি বড় দুর্বলতা থেকে গেছে। সেটি হলো, যেসব জঙ্গিগোষ্ঠী একসময় ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সক্রিয় ছিল, সেই লস্কর-ই-তৈয়বা এবং জইশ-ই-মুহাম্মদ-এর কিছু সদস্য এখনো পাকিস্তানে সক্রিয় আছেন বলে অভিযোগ আছে। এই অভিযোগকে ভারত নিয়মিতভাবে কাজে লাগাচ্ছে।
গত কয়েক বছরে পাকিস্তান এসব নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে কিছু বাস্তব পদক্ষেপ নিয়েছে। মূলত অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা এফএটিএফ এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর কূটনৈতিক চাপের কারণে পাকিস্তান এসব পদক্ষেপ নেয়।
এই পদক্ষেপ নেওয়ার পরও ভারত বলে আসছে, এসব জঙ্গি সংগঠনের কিছু অংশ এখনো পাকিস্তান ও আজাদ কাশ্মীরে সক্রিয়। ভারত এই বক্তব্য দিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে, বিশেষ করে পশ্চিমা নীতিনির্ধারকদের মধ্যে পাকিস্তানবিরোধী ধারণা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ভারত এখন পর্যন্ত তাদের এই কূটনৈতিক কৌশল থেকে সরে আসার কোনো ইঙ্গিত দেয়নি।
তবে এখন ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে, শুধু কথা বলে নয়, এই ধরনের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে হলে বাস্তব প্রমাণ এবং নতুন যুক্তিও লাগবে।
যদি ভারতের এই দাবি প্রমাণ ছাড়া বারবার তোলা হয় এবং সেটি আন্তর্জাতিক মহলে গুরুত্ব হারাতে শুরু করে, তাহলে ভারতকেও হয়তো তার কৌশল বদলাতে হবে।
এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে পাকিস্তানের সঙ্গে আরও সমতার ভিত্তিতে আলোচনার একটি সুযোগ তৈরি হতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও পাকিস্তান এফএটিএফে যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, তাতে দেখা যায়, সন্ত্রাসে অর্থায়ন মোকাবিলায় দুই দেশের দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই ভিন্ন।
পাকিস্তানের প্রতিবেদন ছিল গঠনমূলক ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিতে তৈরি। অন্যদিকে, ভারতের রিপোর্ট ছিল অনেক বেশি বেছে বেছে সাজানো, যেন তা তাদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বক্তব্যকে সহায়তা করে।
এফএটিএফের প্রতিবেদনে ভারতের দেওয়া তথ্য মূলত ইন-কাইন্ড পদ্ধতি, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের অপব্যবহার, অনলাইন পেমেন্ট এবং ভিপিএনের মাধ্যমে একক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন—এই বিষয়গুলোর সঙ্গে এসেছে।
ভারত দুটি কেস স্টাডি দিয়েছে। একটি হলো ২০২২ সালের ৩ এপ্রিল গোরক্ষনাথ মন্দিরে হামলার চেষ্টা। আরেকটি হলো ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জন ভারতীয় নিরাপত্তাকর্মীর মৃত্যু। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, এফএটিএফের প্রতিবেদনে কোথাও পেহেলগাম ঘটনার উল্লেখ করা হয়নি।
ভারতের কেস স্টাডিগুলোর তথ্য কোথা থেকে এসেছে, তা স্পষ্টভাবে বলা হয়নি। পক্ষান্তরে, পাকিস্তান তাদের রিপোর্টে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) ও ইসলামিক স্টেট খোরাসানের (আইএস-কে) কথা বলেছে।
এই সংগঠনগুলো কীভাবে হুন্ডি বা অনানুষ্ঠানিক ব্যাংকিং পদ্ধতি ব্যবহার করে অর্থ সংগ্রহ করে, কিংবা মুক্তিপণ আদায়ের মতো কৌশল ব্যবহার করে অর্থায়ন করে, তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পাকিস্তান এসব তথ্য জাতীয় সন্ত্রাসবিরোধী কর্তৃপক্ষ (ন্যাকটা) সূত্রে দিয়েছে। ফলে এসব তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা আরও বেশি।
এই দুই দেশের কৌশলের ভিন্নতা চোখে পড়ে। ভারত এখনো কূটনৈতিক চাপ তৈরি করতে তার বক্তব্যকেই মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা ও নিয়মকানুন মেনে চলার মাধ্যমে ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজের অবস্থান শক্ত করছে।
বর্তমান ভূরাজনৈতিক পরিবেশে এই ধরনের ধীর ও কাঠামোগত অগ্রগতি ভবিষ্যতে আরও টেকসই ফল দিতে পারে।
মোহাম্মাদ আমির রানা পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিশ্লেষক
দ্য ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত