ইকোনোমিক ডেস্ক : করোনার থাবায় মানুষের আয় কমে গেছে। নতুন করে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তথ্য মতে, করোনায় নতুন করে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। নতুন দরিদ্রদের বেশির ভাগই করোনার কারণে চাকরিহারা। দেশের অর্থনীতির সূচকগুলোও নড়বড়ে। রাজস্ব আয়েও নেই কোনো সুখবর। এমনই এক কঠিন সময়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আগামী বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন। এটি চলতি অর্থবছরের বাজেট থেকে ৩৫ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা বেশি।
আগামী বাজেটের ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বড় বাজেটের প্রয়োজনীয়তা আছে। অনেক দেশই করোনাকালে বাজেট বড় করেছে। সুতরাং এটি কোনো সমস্যা না। আগামী বাজেটে ঘাটতি বাড়লেও তাতে সমস্যা হবে না। এতে মূল্যস্ফীতিতে খুব একটা প্রভাব পড়বে না। করোনায় মানুষের আয় কমে গেছে। চাহিদা কমে গেছে। এটি বাড়াতে হবে। তাই বড় ঘাটতি সমস্যা না।
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাজেটে সমস্যার জায়গা হলো রাজস্ব আদায়। এই ব্যর্থতা মানা যায় না। দক্ষিণ এশিয়ায় তো অবশ্যই, গোটা বিশ্বেই কর জিডিপি হারে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। এটা বাড়াতে হবে। বাজেটে করের আওতা বাড়াতে হবে, করজাল বিস্তার করতে হবে। অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভ্যাটের আওতার বাইরে। সেগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। আর বাজেটে শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না। সঠিকভাবে ব্যয় করতে হবে। স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাত সঠিকভাবে অর্থ ব্যয় করতে পারছে না। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দুর্নীতি রোধ করতে হবে।
বাজেটে ব্যয় ও আয় : বাজেট মানে একটি দেশের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাব। আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার বা ব্যয় ধরা হচ্ছে ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা।
আগামী বাজেটে ব্যয়ের বিপরীতে মোট আয় ধরা হচ্ছে তিন লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে আয় বাড়ছে ১১ হাজার কোটি টাকা। মোট আয়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হচ্ছে। চলতি অর্থবছরেও এনবিআরকে একই পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া রয়েছে। প্রথমবারের মতো এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে না।
এ ছাড়া আগামী বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বহির্ভূত কর থেকে আসবে ১৬ হাজার কোটি টাকা। আর কর ব্যতীত প্রাপ্তি ধরা হচ্ছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার পরিমাণ ধরা হচ্ছে তিন হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।
আগামী বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হচ্ছে তিন লাখ ৬১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর আবর্তক ব্যয় ধরা হচ্ছে তিন লাখ ২৮ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বাবদ ব্যয় ধরা হচ্ছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। আর বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় ধরা হচ্ছে ছয় হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা।
এডিপি : বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হচ্ছে দুই লাখ ৩৭ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ধরা হয়েছে দুই লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। এডিপি এরই মধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) অনুমোদন করেছে।
ঘাটতি : উন্নয়নশীল দেশগুলো সাধারণত ঘাটতি বাজেট দিয়ে থাকে। বাংলাদেশও প্রতি অর্থবছর ঘাটতি বাজেট দেয়। করোনাভাইরাসের কারণে এই ঘাটতি এবার সব সীমা অতিক্রম করছে। আগামী বাজেটে ঘাটতি ধরা হচ্ছে ৬.২ শতাংশ। চলতি বাজেটে তা ৬.১ শতাংশ।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে অনুদান ব্যতীত ঘাটতির পরিমাণ সর্বকালের রেকর্ড ভেঙে দেবে। ঘাটতির পরিমাণ ধরা হচ্ছে দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। আর অনুদানসহ সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হচ্ছে দুই লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৬.১ শতাংশ।
আগামী অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নেবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। আর জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেবে ৩২ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য খাত থেকে নেওয়া হবে পাঁচ হাজার এক কোটি টাকা। বাজেটে বিদেশি উত্স থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা।
প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি : আগামী অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭.২ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি ৫.৩ শতাংশের মধ্যে সহনীয় পর্যায়ে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
সংশোধিত বাজেট : প্রতি অর্থবছরই ঢাউস সাইজের বাজেট দিয়ে অর্থবছরের মাঝামাঝিতে তা সংশোধন করা হয়। চলতি অর্থবছরের জন্য পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট দেন, সংশোধিত বাজেটে তা ৩০ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে পাঁচ লাখ ৩৮ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে করা হয়েছে তিন লাখ ৫১ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে এনবিআরকে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে তিন লাখ এক হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। চলতি বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮.২ শতাংশ। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৬.১ শতাংশ করা হয়েছে।