২১ জুলাই, ঘড়ির কাঁটা সবে বেলা একটার ঘর ছাড়িয়েছে। রাজধানী ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের স্কুল শাখায় খানিক্ষণ আগে ছুটির ঘণ্টা বেজেছে। শিশুরা কোলাহল করে শ্রেণিকক্ষের বাইরে বেরিয়ে কেউ মাঠে খেলছে, কেউ ক্যানটিনে গেছে খাবার কিনতে, কেউ তখনো শ্রেণিকক্ষে বই–খাতা গুছিয়ে ব্যাগে ভরছে।
সন্তানদের স্কুল থেকে নিতে আসা অভিভাবকেরা মাঠে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছেন, অপেক্ষা করছেন সন্তানকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার। হঠাৎই স্কুলের মাঠে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এফ-৭ বিজিআই মডেলের একটি যুদ্ধবিমান আছড়ে পড়ে সেটিতে আগুন ধরে যায় এবং তীব্র গতিতে সেটি সবকিছু ভেঙেচুরে মাঠের পাশে থাকা একটি দোতলা ভবনের ভেতর ঢুকে পড়ে। আগুনের গোলায় পরিণত হওয়া বিধ্বস্ত উড়োজাহাজটি চারপাশের সব কিছু নিয়ে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। কালো ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশে উঠে যাচ্ছে।
এ ভয়াবহ দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩২ জন নিহত ও ১৬৫ জন আহত হয়েছেন। হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া হতাহত ব্যক্তিদের প্রায় সবাই শিশু। আহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগের শরীরের অনেকাংশ পুড়ে যাওয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা হয়তো আরও বাড়বে। দেশে দেশে সামরিক উড়োজাহাজ ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে আগেও পড়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী ১০টির সামরিক উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা একনজরে দেখে নেওয়া যাক।
১. ইলিউশন ইল–৭৬ সামরিক উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা (২০০৩):
২০০৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি, ইরানের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কেরমানের কাছে দেশটির অভিজাত বাহিনী ইরান রেভল্যুশনারি গার্ডের একটি ইলিউশন ইল–৭৬ সামরিক পরিবহন উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয় এবং এতে থাকা ২৭৫ সেনাসদস্য ও ক্রুর সবাই নিহত হন।
উড়োজাহাজটি উড্ডয়নের এক ঘণ্টা পর কেরমান বিমানবন্দরে খারাপ আবহাওয়ার কারণে জরুরি অবতরণের অনুরোধ জানায়। এরপরই রাডার থেকে উড়োজাহাজটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং একটি পাহাড়ি এলাকায় আছড়ে পড়ে। এটি ইরানের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী সামরিক উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা।
২. অ্যারো এয়ার ফ্লাইট দুর্ঘটনা (১৯৮৫):
অ্যারো এয়ার ফ্লাইট ১২৮৫আর দুর্ঘটনাটি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সামরিক বিমান দুর্ঘটনা। এটি ছিল একটি আন্তর্জাতিক চার্টার ফ্লাইট।
উড়োজাহাজটিতে করে মিসরের কায়রো থেকে মার্কিন সেনাদের যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকিতে তাদের ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওই সামরিক পরিবহন উড়োজাহাজটি নিজের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি।
১৯৮৫ সালের ১২ ডিসেম্বর সকালে উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরই সেটি বিধ্বস্ত হয়। ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় উড়োজাহাজে থাকা ২৪৮ আরোহী ও ৮ জন ক্রুর সবাই নিহত হন। উড়োজাহাজটি কানাডার আকাশে বিধ্বস্ত হয়েছিল। এটিকে এখন পর্যন্ত কানাডায় বিধ্বস্ত হওয়া সবচেয়ে প্রাণঘাতী উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা ধরা হয়।
৩. খাম ডাক সি–১৩০ উড়োজাহাজ (১৯৬৮)
১৯৬৮ সালের এ দুর্ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম প্রাণঘাতী সামরিক উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার তালিকায় রয়েছে। সেই সঙ্গে এটি ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ঘটা সবচেয়ে প্রাণঘাতী উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা।
যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর লকহিড সি–১৩০বি হারকিউলিস উড়োজাহাজ খাম ডাক যুদ্ধের সময় দক্ষিণ ভিয়েতনামি নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার কাজে অংশ নিচ্ছিল।
দুর্ঘটনার কবলে উড়োজাহাজটিতে ভিয়েতনামের ১৮৩ নাগরিক ও সামরিক বাহিনীর ৬ জন কর্মী ছিলেন। তাঁদের সবাই ওই দুর্ঘটনায় নিহত হন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় প্রায় ১৫ শতাংশের বেশি সি–১৩০ হারকিউলিস উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়েছি বা হারিয়ে গিয়েছিল।
দুর্ঘটনায় পড়া উড়োজাহাজটিতে ভিয়েতনামের ১৮৩ নাগরিক ও সামরিক বাহিনীর ৬ জন কর্মী ছিলেন। তাঁদের সবাই ওই দুর্ঘটনায় মারা যান। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় প্রায় ১৫ শতাংশের বেশি সি-১৩০ হারকিউলিস উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়েছি বা হারিয়ে গিয়েছিল।
৪. টান সন নিউট সি–৫ সামরিক উড়োজাহাজ (১৯৭৫):
১৯৭৫ সালে অপারেশন বেবিলিফটে অংশ নেওয়া একটি লকহিড সি–৫এ গ্যালাক্সি উড়োজাহাজ জরুরি অবতরণের সময় দুর্ঘটনায় পতিত হয় এবং ১৩৪ আরোহী নিহত হন।
দক্ষিণ ভিয়েতনামের টান সন নিউট বিমানঘাঁটির রানওয়েতে ওই দুর্ঘটনা ঘটেছিল। পরে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উড়োজাহাজটির নিয়ন্ত্রণ হারানোর কথা উল্লেখ করা হয়।এটি ছিল সি–৫ গ্যালাক্সির প্রথম প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা এবং ভিয়েতনামে হওয়া ভয়াবহ সামরিক উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার একটি।
৫. তাচিকাওয়া এয়ার ডিজাস্টার (১৯৫৩):
এ উড়োজাহাজ দুর্ঘটনাটি ঘটে ১৯৫৩ সালে। ওই বছর গ্রীষ্মকালে একটি ডগলাস সি–১২৪ উড়োজাহাজ জাপানের তাচিকাওয়া থেকে রওনা হয়েছিল। কিন্তু উড্ডয়নের তিন মিনিটের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন সামরিক উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয় এবং সেটিতে থাকা ১২৯ যাত্রী ও ক্রুর সবাই নিহত হন।
এ দুর্ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে সবচেয়ে প্রাণঘাতী সামরিক উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা ছিল। পরে ১৯৬৮ সালের খাম ডাক উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনায় প্রাণহানি এ দুর্ঘটনাকে ছাড়িয়ে যায়।
২০১৭ সালের ৭ জুন, মিয়ানমার বিমানবাহিনীর একটি শানসি ওয়াই-৮-২০০এফ পরিবহন উড়োজাহাজ মিয়েক থেকে ইয়াঙ্গুনগামী পথে সাগরে বিধ্বস্ত হয়। উড়োজাহাজে ১২২ জন সামরিক সদস্য ও তাঁদের পরিবার ছিল। বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয় এবং সবাই নিহত হন।