৭৪তম মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতার মঞ্চে ১২১ জন প্রতিযোগীর আলো ছাপিয়ে যখন এক তরুণীর মাথায় সেরার মুকুট উঠল, বিশ্ব তখন একটাই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,কে এই ফাতিমা বশ? মেক্সিকোর এই তরুণী শুধু সৌন্দর্যেই নয়, ব্যক্তিত্ব, সাহস ও মানবিকতায় জয় করেছেন কোটি হৃদয়।
শুক্রবার (২১ নভেম্বর) থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত গ্র্যান্ড ফিনালেতে গতবারের বিজয়ী ডেনমার্কের ভিক্টোরিয়া কিয়ার থেইলভিগ তার মাথায় পরিয়ে দেন মিস ইউনিভার্স ২০২৫–এর কাঙ্ক্ষিত মুকুট। কিন্তু তার সাফল্যের গল্প শুরু হয়েছিল অনেক আগেই অবহেলা, সংগ্রাম, অপমান আর লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে।
২০০০ সালের ১৯ মে মেক্সিকোর তাবাস্কোর ভিলাহেরমোসায় জন্ম ফাতিমার। শৈশব থেকেই প্রাণবন্ত ও প্রকৃতিপ্রেমী এই মেয়েটি ছয় বছর বয়সে জীবনের কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হন। তার মস্তিষ্কজনিত জটিল রোগ ডিসলেক্সিয়া ও এডিএইচডি ধরা পড়ে। শিক্ষাজীবন যেমন হুমকির মুখে পড়ে, তেমনি হতাশাও ঘিরে ধরতে শুরু করে তাকে। কিন্তু পরাজয় ছিল না ফাতিমার অভিধানে। তিনি ঠিক করেন, দুর্বলতা নয় প্রতিটি বাধাকেই নিজের শক্তিতে পরিণত করবেন।
১৬ বছর বয়সে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান। এক বছর পরে স্বপ্নপূরণের ডাক তাকে ফের টেনে আনে মেক্সিকোতে। আর মাত্র ১৭ বছর বয়সেই তিনি জিতে নেন ‘ফ্লোর তাবাস্কো’ সুন্দরী প্রতিযোগিতার মুকুট যা ছিল তার শৈশবের স্বপ্ন।
এরপর ফ্যাশন নিয়ে পড়াশোনা করেন মেক্সিকো সিটির ইবেরোমেরিকানা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর ইতালির মিলানে নুওভা আক্কাদেমিয়া দি বেল্লে আর্তি–তে ডিজাইনের উচ্চতর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। অর্থাৎ ফাতিমা শুধু সুন্দরী নন তিনি মেধাবী, শিল্প–সচেতন ও উচ্চশিক্ষিত।
মানবিকতার অসাধারণ দৃষ্টান্ত
ফাতিমা বশের পরিচয় শুধু ‘মিস ইউনিভার্স’ নন। নয় বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন। প্রতিবার বড়দিনে তাবাস্কোর অনকোলজি হাসপাতালে তিনি শিশুদের জন্য আয়োজন করেন উপহার বিতরণ অনুষ্ঠানের।
তার উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে রুটা মোনার্কা এবং কোরাজোন মিগ্রান্তে যার মাধ্যমে পরিবেশ সচেতনতা, অভিবাসীদের অধিকার এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন তিনি।
সৌন্দর্য, মমত্ববোধ ও দায়িত্ববোধ সব মিলিয়েই তিনি হয়েছেন অনন্য। যেখানে সাহস দেখালেন বিশ্ব ‘ডাম্বহেড’ অপমানের সামনে দাঁড়ালেন অটল হয়ে
মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতার আগে প্রিপ্যাজেন্টের সময় একটি প্রোমোশনাল ভিডিও দেরিতে পোস্ট করা নিয়ে থাইল্যান্ডের পরিচালক নাওয়াত ইতসারাগ্রিসিল তাকে সবার সামনে ‘ডাম্বহেড’ বলে কটাক্ষ করেন।
দর্শকরা হতবাক। কিন্তু ফাতিমা থামেননি। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে পরিচালকের দিকে তাকিয়ে বলেন, “আপনি আমাকে একজন নারী হিসেবে সম্মান দিচ্ছেন না।” এই এক বাক্যে তিনি বিশ্বজুড়ে নারীর সম্মানের প্রতীক হয়ে ওঠেন।
পরিচালক আরও চাপ সৃষ্টি করলে বাকি প্রতিযোগীরাও প্রতিবাদে ফাতিমার পাশে দাঁড়ান। হল থেকে বেরিয়ে যান সবাই।সরাসরি সম্প্রচারিত সে মুহূর্তে বিশ্ব দেখেছে অপমান নয়, সম্মানই নারী অধিকার।
ঘটনার জেরে পরিচালক নাওয়াতকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয় মিস ইউনিভার্স কর্তৃপক্ষ। ফাতিমার নাম তখনই আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনার কেন্দ্রে।
অপমানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সেই সাহসী তরুণী যখন ফাইনালের মঞ্চে দাঁড়ালেন, দর্শকদের চোখে তিনি শুধু প্রতিযোগী নন এক অনুপ্রেরণা, এক প্রতীক।
অবশেষে সব বাধা পেরিয়ে মাথায় উঠল বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সৌন্দর্য মুকুট মিস ইউনিভার্স ২০২৫।
ফাতিমার নিজের ভাষায়,“একুশ শতকে কোনো নারীই কারো হাতের পুতুল হয়ে থাকবে না। আমাকে অসম্মান করা মানে সব নারীকে অসম্মান করা।”
এই কথার মধ্যেই বোঝা যায় তিনি শুধু মঞ্চের নয় সময়ের, সমাজের এবং নারীর এক সাহসী প্রতিনিধি।

