টানা বৃষ্টি এবং উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন এলাকায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে এসব এলাকার নদ-নদীর পানি। অনেক স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে গেছে। এতে পানিতে ভেসে গেছে ঘর-বাড়ি। ডুবে গেছে হাজার হাজার বিঘা ফসলি জমি। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। চালু করা হয়েছে মেডিকেল টিম। পানিবন্দি মানুষের মাঝে খাবার সরবরাহের জন্য প্রশাসনের সাথে কাজ করছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতারা। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) উপদেষ্টা পরিষদের সভায় আলোচনা হয়েছে।
টানা বৃষ্টি এবং ভারত থেকে নেমে আসা পানির কারণে ফেনীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২১টি স্থানে ভেঙে গেছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে পানি ঢুকে পড়েছে। এতে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তবে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় পরশুরাম উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করেছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ফেনী-ফুলগাজী ও ফেনী-ছাগলনাইয়া আঞ্চলিক সড়কের ওপর দিয়ে ২ থেকে ৪ ফুট পর্যন্ত পানির প্রবাহ ছিল। তবে ফেনী শহরের প্রধান সড়কে যে জলাবদ্ধতা ছিল- তা কেটে গেছে। শহর এলাকায় যান চলাচল স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। প্রশাসন, বিভিন্ন সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবীরা দুর্গত এলাকাবাসীর পাশে থেকে মানবিক সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
গত সোমবার থেকে ভারী বর্ষণের কারণে ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর উপজেলার অন্তত শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়। পরবর্তীতে বৃষ্টি কমতে শুরু করায় বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পরশুরাম উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে। তবে পানি ফুলগাজীর নিম্নাঞ্চল গড়িয়ে ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলায় ঢুকতে শুরু করে।
বৃহস্পতিবার সকালে ফেনী-ছাগলনাইয়া সড়কের রেজুমিয়া থেকে পৌরসভা পর্যন্ত অংশে পানি এক থেকে দুই ফুট ওপর দিয়ে গড়িয়ে যেতে দেখা গেছে। এতে নতুনভাবে ছাগলনাইয়া উপজেলার পাঠাননগর, রাধানগর, ছাগলনাইয়া পৌরসভার অন্তত ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ফেনী সদর উপজেলার কাজিরবাগ, মোটবী, ছনুয়া, ফাজিলপুর ইউনিয়নের অন্তত ২০টি গ্রাম নতুন ভাবে প্লাবিত করেছে।
ফেনী জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, পরশুরামে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। ফুলগাজীতেও কিছুটা ভালোর দিকে রয়েছে। তবে বৃহস্পতিবার বন্যার পানি ছাগলনাইয়ার প্রধান সড়ক গড়িয়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। আশা করি শুক্রবার পর্যন্ত জেলাজুড়ে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি শুরু হবে। এখন পর্যন্ত ৫০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৪ উপজেলায় প্রায় ৭ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। ২০ হাজারের বেশি পানিবন্দি মানুষের মাঝে খাবার সরবরাহের জন্য প্রশাসনের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতারা কাজ করে যাচ্ছেন।
নোয়াখালীতে পানিবন্দি ৪২ হাজার পরিবার
নোয়াখালীতে টানা ভারী বর্ষণের ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৪১ হাজার ৮৪০টি পরিবার। জেলায় মোট ৪৬৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ২ লাখ ৩ হাজার ১০০ মানুষ। বিধ্বস্ত হয়েছে ৪০ ঘরবাড়ি। এমতাবস্থায় ৫১টি মেডিকেল টিম চালু করেছে প্রশাসন। বৃহস্পতিবার বিকালে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ।
বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে আবহাওয়া কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নোয়াখালীতে আবারও শুরু হয় বৃষ্টি। পানিতে ডুবে গেছে গ্রামের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও ফসলের মাঠ। এতে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে পানিবন্দি মানুষের মধ্যে।
জানা গেছে, নোয়াখালী সদর, সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ ও সুবর্ণচরের বিভিন্ন অঞ্চলের নিচু এলাকায় বৃষ্টির পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে জেলা শহর মাইজদীর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, মৎস্য অফিস, জেল খানা সড়ক, পাঁচ রাস্তার মোড়, পৌর বাজারসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তাগুলো তলিয়ে গেছে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা এখনও অনেক এলাকায় কার্যকর না হওয়ায় ঘরবাড়ি ও সড়কে পানি জমে আছে। ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে কর্মজীবী মানুষ এবং যানবাহনের চালকদের।
জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ বলেন, টানা বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতায় ভোগান্তি বেড়েছে। আমরা বিভিন্ন স্থানে গিয়ে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের জন্য কাজ করছি। এছাড়া পানিবন্দি পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
আতঙ্কে দিন কাটছে গোমতী পাড়ের বাসিন্দাদের
টানা ভারী বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা ঢলে গোমতী নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় গোমতী নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার মাত্র ১ দশমিক ৬২ মিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। ফলে নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের মাঝে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। গত বছরের বন্যার ক্ষতি এখনো পুষিয়ে উঠতে না পারা এসব মানুষ এখন আরেকটি বন্যার মুখোমুখি। ফলে আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের।
কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খান মো. ওয়ালিউজ্জামান বলেন, বুধবার রাতে ভারী বর্ষণ ছিল না। ভোরে আবার বর্ষণ ছিল। পানির প্রবাহ কিছুটা কম গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে উজান থেকে নেমে আসা ঢল বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না।
কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) পঙ্কজ বড়ুয়া বলেন, গোমতীর পানি বৃদ্ধির লক্ষণ দেখা মাত্র আমরা ৫৮৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করেছি। পর্যাপ্ত শুকনো খাবার এবং সরকারি চাল মজুদ আছে। সব উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তাসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রাজবাড়ীতে সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে
টানা ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে রাজবাড়ী জেলার সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে বিপদসীমা অতিক্রম করেনি। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী এম এ শামীম।
রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা নদীর গোয়ালন্দ পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে শূন্য দশমিক ১৪ মিটার, মহেন্দ্রপুর পয়েন্ট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে শূন্য দশমিক ১৬ মিটার, পাংশার সেনগ্রাম পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে শূন্য দশমিক ৪৯ মিটার এবং কামারখালীর গড়াই নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে শূন্য দশমিক ২৬ মিটার।
রাজবাড়ী জেলায় গত একসপ্তাহ ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হলেও গত বুধবার থেকে টানা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বুধবার রাতেও থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। বৃহস্পতিবার ভোর থেকে আবারো শুরু হয়েছে মুষলধারে বৃষ্টি।
রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী এম এ শামীম বলেন, টানা বৃষ্টির কারণে রাজবাড়ী সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। পানি বিপদসীমার অনেক নিচেই রয়েছে। মানুষের পানিবন্দি হওয়ার এখনো কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বৃষ্টিতে কিছু এলাকায় নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। আমারা এ ব্যাপারে তৎপর রয়েছি।
মোরেলগঞ্জে হাজার বিঘা আমন বীজতলা পানির নিচে
বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে টানা ৮ দিনের ভারী বর্ষণে অন্তত দুই হাজার বিঘা আমন বীজতলা ও আউশ রোপা ফসলি জমি পানিতে ডুবে গেছে। এতে ক্ষতির আশংকায় রয়েছেন কৃষকেরা। বদ্ধকৃত খালগুলোর বাঁধ কেটে মাঠের পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
বৃহস্পতিবার সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ফসলি মাঠে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। যে কারনে চলতি আমন মৌসুমে বীজতলা ও আউশ রোপনকৃত প্রায় ২ হাজার বিঘা ফসলি মাঠ পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। বীজতলা পচে গিয়ে ব্যাপক ক্ষতির আশংকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা।
স্থানীয় একাধিক কৃষক বলেন, এ বছর আমন বীজতলা ফসলি মাঠে বীজ ধান ফেলেছেন। ধান ফেলার ৩/৪ দিন পরেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। একটানা বৃষ্টি চলছে। প্রত্যেক মাঠেই হাঁটু পানি জমে রয়েছে। পানি সরানোর কোন ব্যবস্থা নেই। অনেক খালে বাঁধ রয়েছে আবার কোনো কোনো স্থানে ঘন ঘন জাল পাতার কারণে পানি নামতে পারছে না।
এ বিষয়ে দৈবজ্ঞহাটী ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, নালা কেটে দ্রুত পানি অপসারণের জন্য চেষ্টা চলছে। ক্ষতির বিষয়ে এখনই বলা যাচ্ছে না।
মোরেলগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ফসলি মাঠে পানি জমে থাকার কারণে আমন বীজতলার ক্ষতির আশংকা করছেন কৃষকরা। তবে দুই-তিন দিনের মধ্যে পানি নেমে গেলে ক্ষতির পরিমাণ কমে আসবে। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা দুর্যোগের বিষয়ে সার্বক্ষণিক কৃষকদের খোঁজ নিচ্ছেন।
গোপালগঞ্জে ৬ ঘণ্টায় ৫১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত
গেল কয়েকদিন ধরে গোপালগঞ্জে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। তবে বৃহস্পতিবার সকাল সর্বোচ্চ ৫১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এতে অনেক স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। জনজীবনে নেমে এসেছে স্থবিরতা।
গোপালগঞ্জ জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু সুফিয়ান জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৫১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামীকাল থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত বৃষ্টিপাত কম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ১৪ জুলাই থেকে আবারও ভারী বৃষ্টিপাতের আশংকা রয়েছে।
বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা
অতিবৃষ্টির কারণে ফেনী ও নোয়াখালী জেলায় সৃষ্ট বন্যা ও জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি নিয়ে বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের সভায় আলোচনা হয়েছে। সভায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বন্যা ও তৎপরবর্তী গৃহীত ব্যবস্থা নিয়ে তাদের মতামত ও করণীয় তুলে ধরেন।
প্রতিবেদন তৈরিতে সাহায্য করেছেন, মোরেলগঞ্জ (বাগেরহাট), গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী), কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং ফেনী প্রতিবেদক।